ঢাকা, বুধবার, ১২ ফাল্গুন ১৪৩১, ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২৬ শাবান ১৪৪৬

বাংলানিউজ স্পেশাল

রাতের ঢাকায় ‘উদ্বেগ-আতঙ্ক’, কঠোর অবস্থানে সরকার

আবাদুজ্জামান শিমুল, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯৪১ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৫, ২০২৫
রাতের ঢাকায় ‘উদ্বেগ-আতঙ্ক’, কঠোর অবস্থানে সরকার ফাইল ছবি

ঢাকা: রাতের ঢাকা যেন ‘আতঙ্ক আর উদ্বেগে’র সমার্থক হয়ে উঠেছে। গত কয়েকদিন ধরেই ঢাকার বিভিন্ন স্থানে চুরি, ছিনতাই ও হামলার মতো ঘটনার খবর সামনে আসছে।

এসব ঘটনায় রাজধানীবাসীর মধ্যে আতঙ্ক বাড়ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও এসব বিষয় নিয়ে নেটিজেনরা তাদের উদ্বেগ জানাচ্ছেন। তবে পরিস্থিতি মোকাবিলায় কঠোর অবস্থান নিয়েছে সরকার।

রোববার রাতে ঘটে যায় তিনটি ঘটনা, যেগুলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। প্রথমটি হলো, রাজধানীর বনশ্রী এলাকায় ব্যবসায়ী আনোয়ার হোসেনকে গুলি করে স্বর্ণ ও টাকা ছিনতাইয়ের ঘটনা। দ্বিতীয়টি ধানমন্ডির শংকরে একটি স্কুলের গলিতে ধারালো অস্ত্র নিয়ে মহড়ার কথা জানিয়ে ডাকাত আতঙ্কের বিষয়ে মসজিদের মাইকে এলাকাবাসীকে সতর্ক করার ঘটনা। অন্য ঘটনাটি ঘটে রাজধানীর আদাবর শেখেরটেক এলাকায়। সেখানে এক রিকশাআরোহী ছিনতাইকারীর কবলে পড়েন।  

ঘটনাগুলোর সত্যতা তাৎক্ষণিক যাচাই করতে না পারলেও ভিডিও ক্লিপগুলো সামাজিক মাধ্যমে একের পর এক আসতে থাকায় ঢাকাবাসীর মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। এমন পরিস্থিতিতে রাতে চলাচলের ক্ষেত্রে রাজধানীবাসী অনেকটাই অনিরাপদবোধ করার কথা জানান।
রাজধানীর মোহাম্মদপুর, আদাবর, ধানমন্ডি, উত্তরা, বনশ্রীসহ বেশ কয়েকটি এলাকার বাসিন্দাদের সঙ্গে বাংলানিউজের পক্ষ থেকে কথা বলা হয়েছে। তারা আতঙ্কের কথা জানিয়েছেন। তবে বিদ্যমান পরিস্থিতিতে নিরাপত্তা বিবেচনায় কেউই তাদের নাম প্রকাশ করতে চাননি। তারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।

বনশ্রীতে ব্যবসায়ী আনোয়ার হোসেনের ওপর হামলার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে তাতে দেখা যায়, ছিনতাইকারীরা গুলি করে ব্যাগ নিয়ে চলে যাচ্ছে। এই ঘটনার পর আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে বনশ্রীর আশপাশের এলাকাগুলোতেও। স্থানীয়দের ভাষ্য, তারা গত দুই দশকেও এমন ঘটনা দেখেননি। পরে ঘটনাস্থলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিপুল সংখ্যক সদস্য উপস্থিত হন।

আর ধানমন্ডি শংকর এলাকার স্থানীয় এক বাসিন্দা বাংলানিউজকে বলেন, রোববার রাতে হঠাৎই মসজিদ থেকে মাইকিং করে এলাকাবাসীকে সাবধান করা হয়। মাইকে বলা হয়, এলাকাবাসী সাবধান থাকুন। শোনা যাচ্ছে, স্কুলের গলিতে দেশীয় অস্ত্র হাতে নিয়ে কিছু ডাকাত প্রবেশ করেছে।  
তিনি বলেন, মাইকে ঘোষণা শোনার পরপরই এলাকার বাসিন্দাদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। এলাকাবাসীর অনেকেই তাৎক্ষণিকভাবে লাঠিসোঁটা নিয়ে রাস্তায় নেমে আসেন। এরপর পরপরই ঘটনাস্থলে হাজারীবাগ থানার পুলিশ অবস্থান নেয়। পুলিশ আশপাশের সিসিটিভির ফুটেজ পুলিশ সংগ্রহ করেছে। তারা কী দেখেছে, তারাই বলতে পারবে।

বনশ্রীর ছিনতাইয়ের ঘটনা নিয়ে রামপুরা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আতাউর রহমান আকন্দ বাংলানিউজকে বলেন, বনশ্রী ডি ব্লকের তিনটি মোটরসাইকেলে সাত ছিনতাইকারী ওই ব্যবসায়ীকে ঘিরে ধরে। ছিনতাইকারীদের অধিকাংশেরই মাথায় হেলমেট ও মুখে মাস্ক ছিল। তবে একজন ছিনতাইকারীর মাথায় ও মুখে কিছুই ছিল না। ঘটনাস্থলের আশপাশে সিসিটিভি ফুটেজ সবকিছুই দেখা হয়েছে। ছিনতাইকারীদের ধরতে রোববার রাতেই অভিযান শুরু হয়, যা অব্যাহত রয়েছে।

শংকরের ঘটনা নিয়ে জানতে চাইলে হাজারীবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. সাইফুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, আলী হোসেন উচ্চ বিদ্যালয়ের গলিতে ১০ থেকে ১৫ জন কিছু ছেলে অবস্থান নিয়েছিল। তবে সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গেছে তাদের হাতে কোনো দেশীয় অস্ত্র ছিল না। পুলিশ গিয়ে সেখানে তাদের পায়নি।  

তিনি আরও বলেন, কিছুদিন আগে এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে একটি মিটিং করা হয়। সেখানে তারা একটি বিষয় উপস্থাপন করেন, এলাকায় কোনো কিশোর গ্যাং দেখা গেলে কিংবা অপরাধ হলেই যেন মসজিদ থেকে মাইকে সতর্ক করা হয়। এই কারণেই এলাকার কেউ মসজিদে কল দিয়ে মাইকিং করতে বলেন।
আদাবরে রিকশাআরোহীর ছিনতাইয়ের শিকার বলে ছড়িয়ে পড়া ভিডিও নিয়ে কথা হয় আদাবর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এসএম জাকারিয়ার সঙ্গে। তিনি বলছিলেন, ভিডিওটি আমিসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও দেখেছেন। রাতভর ঘটনাস্থল শনাক্তের চেষ্টা করেছি। পাশাপাশি মোহাম্মদপুর থানার ওসিসহ অন্যরাও কাজ করছেন। এখন পর্যন্ত কেউ ওই বিষয়ে অভিযোগ করেননি বা ঘটনার সত্যতা পাওয়া যায়নি।

এসব নিয়ে জানতে চাইলে মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার ও গোয়েন্দা প্রধান রেজাউল করিম মল্লিক বলেন, ঢাকাবাসীকে নিরাপদে থাকার জন্য গোয়েন্দা পুলিশ কাজ করে যাচ্ছে। এ ছাড়া ঢাকা শহরের যেখানেই কোনো ঘটনা ঘটছে, ডিবি পুলিশ তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিচ্ছে।

তিন ঘটনার রাতেই জরুরি সংবাদ সম্মেলন ডাকেন অন্তর্বর্তী সরকারের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। তিনি বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে টহল কার্যক্রম আরও বাড়ানোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। আজ থেকে যেন কোথাও কোনো অপরাধ না ঘটে, তারা সে ব্যবস্থা নেবে।

তিনি বলেন, আর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যদি এই নির্দেশনা কার্যকর করতে না পারে, তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি দিনে দিনে আরও উন্নত হবে। অবনতি হওয়ার কোনো আশঙ্কা নেই।

পরে সোমবার বিকেলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে কোর কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়। বিকেল ৩টায় সভা শুরু হয়ে বিকেল সোয়া ৪টায় শেষ হয়।

আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে মানুষের মধ্যে বিদ্যমান আতঙ্ক নিয়ে এক সাংবাদিক জানতে চাইলে উপদেষ্টা বলেন, মানুষকে আশ্বস্ত করতেই আজকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সভা করা হয়েছে। সন্ধ্যার পর থেকে আপনারা পরিস্থিতি টের পাবেন।

এই সভা শেষে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম জানান, ঢাকার যেসব স্থানে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে, সেসব স্থানে প্যাট্রল বাড়বে। সন্ধ্যা থেকে পুলিশ, সেনাবাহিনী, বিজিবি ও নৌবাহিনীর যৌথ প্যাট্রল শুরু হবে। পুরো ঢাকা শহরে অনেক জায়গায় চেকপোস্ট (তল্লাশিচৌকি) বসবে। আইনশৃঙ্খলা নজরদারি করা হবে।

বিদ্যমান আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এবং ঢাকাবাসীর আতংক নিয়ে বাংলানিউজ কথা বলেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের শিক্ষক এবং অপরাধ বিশেষজ্ঞ তৌহিদুল হকের সঙ্গে।

তিনি বলেন, ডাকাতি, চুরি, ছিনতাই ও আধিপত্য বিস্তার বা অস্ত্র নিয়ে মহড়া— এসব ঘটনা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি নির্দেশ করে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যেসব বক্তব্য দিচ্ছে, সেসবের সঙ্গে বর্তমান পরিস্থিতির মিল নেই। গত ছয় মাস ধরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী একটি পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এই পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে বাহিনীগুলো দৃশ্যমান পরিবর্তন তৈরি করতে পারছে না। বিষয়টি আমাদের ভাবাচ্ছে।  

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শৃঙ্খলা রক্ষার ভূমিকাগত ঘাটতিকে কাজে লাগিয়ে অপরাধীরা নানাভাবে সক্রিয় হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, অপরাধীরা নানাভাবে গ্যাং তৈরি করছে, অপরাধের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছে এবং রাজনৈতিক প্রতিহিংসাও সহিংস কায়দায় বাস্তবায়ন হচ্ছে। দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করার দায়িত্ব শুধুমাত্রই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সশস্ত্র বাহিনী, রাজনৈতিক দল ও সাধারণ জনগণ সক্রিয় ভূমিকা রাখলে পরিস্থিতির উন্নতি হবে।  

এই অপরাধ বিশেষজ্ঞ বলছিলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যাদের সহায়ক শক্তি হিসেবে পাওয়ার কথা, তাদের পাচ্ছেন না। আর যাদের পাচ্ছে, তারাও সক্রিয়ভাবে কাজ করছে না। অপারেশন ডেভিল হান্ট পরিচালিত হচ্ছে। মনে হচ্ছে এই হান্ট শুধু একপক্ষীয়। শুধু রাজনৈতিক ডেভিলদের ধরতে অভিযান চালালে অপরাধীরা সুযোগ পেয়ে যাবে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতির ক্ষেত্রে যে বা যারা জড়িত, সব ডেভিলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।
 
তিনি মনে করেন, সাধারণ মানুষ ও ভুক্তভোগীরা মনে করছেন, ডেভিল হান্ট হচ্ছে শুধুমাত্র রাজনৈতিকভাবে। সামগ্রিকভাবে অভিযান পরিচালনা চালাতে না পারলে এখান থেকে কোনো সামগ্রিক ফল তৈরি হবে না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আরও সোচ্চার হতে হবে, কারো কারো মধ্যে ঢিলেমি ভাব আছে, এই ঢিলেমি ভাব দূর করতে হবে। সামগ্রিকভাবে অভিযান চালানো হলে অপরাধীদের মাঝে সতর্কবার্তা তৈরি হবে।

বাংলাদেশ সময়: ০৯৪০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৫, ২০২৫
এমএমআই/এজেডএস/আরএইচ
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।