ঢাকা, বুধবার, ৯ বৈশাখ ১৪৩২, ২৩ এপ্রিল ২০২৫, ২৪ শাওয়াল ১৪৪৬

বাংলানিউজ স্পেশাল

সাক্ষাৎকার

পাসপোর্টে ‘এক্সসেপ্ট ইসরায়েল’ আমাদের গৌরবান্বিত করেছে: ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রদূত

তৌহিদুর রহমান, ডিপ্লোম্যাটিক করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮৩৯ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৮, ২০২৫
পাসপোর্টে ‘এক্সসেপ্ট ইসরায়েল’ আমাদের গৌরবান্বিত করেছে: ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রদূত

ঢাকা: ঢাকায় ফিলিস্তিনের রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন ইউসুফ এস ওয়াই রামাদান। তিনি ফিলিস্তিন-ইসরায়েল সংকট নিয়ে বাংলানিউজের সঙ্গে কথা বলেছেন।

গত ১৫ এপ্রিল ঢাকাস্থ ফিলিস্তিন দূতাবাসে তার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন বাংলানিউজের ডিপ্লোম্যাটিক করেসপন্ডেন্ট তৌহিদুর রহমান।

বাংলানিউজ: সম্প্রতি বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে লাখো জনতা ফিলিস্তিনের পক্ষে নানা কর্মসূচি পালন করেছে। আপনি নিশ্চয়ই সেটা প্রত্যক্ষ করেছেন?

ইউসুফ এস ওয়াই রামাদান: বাংলাদেশের জনগণ কখনো ন্যায় ও অন্যায়ের মাঝখানে ছিল না। তারা সব সময় ন্যায়ের পক্ষে ছিল। ইসরায়েলের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ও ফিলিস্তিনের পক্ষে ছিল। কেননা তারা দেখছে, গত ৭৭ বছর ধরে ফিলিস্তিনের জনগণ নিজেদের অধিকারের জন্য সংগ্রাম করছে। ফিলিস্তিনিদের জন্য বাংলাদেশের বার্তা খুব স্পষ্ট—আমরা তোমাদের (ফিলিস্তিনের) পাশে আছি। এজন্য আমি বাংলাদেশে ফিলিস্তিনের রাষ্ট্রদূত হিসেবেও গৌরব বোধ করি।

বাংলানিউজ: ফিলিস্তিনে দীর্ঘ দিন ধরে গণহত্যা চলে আসছে। তবে আমরা দেখছি, আরব বিশ্ব নীরবতা পালন করছে। আপনার মন্তব্য কী?

ইউসুফ এস ওয়াই রামাদান: এটা খুব দুর্ভাগ্যজনক যে, ফিলিস্তিনে গণহত্যা চলছে। শুধু আরবই নয়, সাধারণভাবে পুরো বিশ্বই নীরবতা পালন করছে। আর শুধু নীরবই নয়, কিছু দেশ এই গণহত্যার জন্ম দিচ্ছে, সেটা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে হোক না কেন। আর এটা ঘটছে এখন এই বিংশ শতাব্দীতে এসে, যখন আমরা মানবতা-গণতন্ত্র রক্ষা ও সকল নীতি নৈতিকতার কথা বলছি। যখন আমরা এসব বলছি, তখন কার্যকর ক্ষেত্রে আমরা দেখছি, সম্পূর্ণ এর বিপরীত এক চিত্র। আমাদের ধর্ম, বর্ণ আলাদা হতে পারে। তবে সবার সাথে আমাদের যে মিল আছে, সেটা হলো আমরা সবাই মানুষ। আমাদের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করার কথা, আমাদের অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করার কথা, আমাদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করার কথা, প্রকৃতপক্ষে যারা মানবতার বিরুদ্ধে তাদের সকলের বিরুদ্ধেই আমাদের লড়াই করার কথা। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমরা সেটা করছি না।

তবে ফিলিস্তিনের জনগণ প্রকৃতপক্ষে মানবতার জন্যই লড়াই করছে। এই লড়াই অশুভশক্তির বিরুদ্ধে। এটা শুধু তাদের নিজেদের জন্য লড়াই নয়। আমি বিশদভাবে বলতে চাই না, কোন দেশ কী ভূমিকা পালন করছে। আমি বলতে  চাই, বিশ্ব কিছুই করছে না। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও কোনো ভূমিকা পালন করছে না। যদিও তারা চেষ্টা করছে, তবে কিছু করতে পারছে না, কারণ তারাও চাপে রয়েছে। এখন আমরা কী করতে পারি? আমরা লড়াই বন্ধ করে দিতে পারি না। কেননা আমাদের অনেক মূল্য দিতে হচ্ছে। আমাদের শুধু ১৭ হাজার শিশুই মারা গেছে! পুরো বিশ্ব সেটা দেখছে। এখানে তো মানবতা নীরব।

বাংলানিউজ: ফিলিস্তিন ইস্যুতে জাতিসংঘ তেমন কোনো জোরালো ভূমিকা নিতে পারছে না। এ ক্ষেত্রে আপনি কী বলবেন?

ইউসুফ এস ওয়াই রামাদান: ফিলিস্তিন ইস্যুতে জাতিসংঘ অনেক উদ্যোগ নিয়েছে। আমরা জাতিসংঘকে অনেক সম্মান করি। তারা যতটা পারে, সেই চেষ্টাও করেছে। জাতিসংঘের ১৩০ জন কর্মী ইসরায়েলের আগ্রাসনে নিহত হয়েছে। তবে তাদের (জাতিসংঘের) ভূমিকা সীমিত। কারণ, তারা অপহৃত হয়েছে। আইনের ক্ষেত্রে তাদের পুরোপুরি কর্তৃত্ব নেই। কেননা সেখানে যুক্তরাষ্ট্র বারবার ইসরায়েলের সমর্থনে ভেটো দিয়ে আসছে, আর এটাই হলো প্রকৃত বাস্তবতা।

বাংলানিউজ: বাংলাদেশ গত সপ্তাহে পাসপোর্টে ‘এক্সসেপ্ট ইসরায়েল’ (ইসরায়েল ব্যাতিত) বাক্যটি সংযুক্ত করেছে। আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে যেটা প্রত্যাহার করা হয়েছিল। এ বিষয়ে আপনার প্রতিক্রিয়া কী?

ইউসুফ এস ওয়াই রামাদান: ১৯৭২ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের পাসপোর্টে এটা (এক্সসেপ্ট ইসরায়েল) লেখা ছিল। তবে ২০২২ সালে বাংলাদেশ সরকার এই বাক্যটি পাসপোর্ট থেকে প্রত্যাহার করে। আমার শক্তিতে যতটুকু কুলায়, তখন আমি সাধ্যমতো চেষ্টা করেছিলাম, যেন সরকার ওই সিদ্ধান্তটা বাতিল করে। তবে সেটা সম্ভব হয়নি। আমার মনে আছে, সে সময়ের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর (আসাদুজ্জামান খান কামাল) সঙ্গে আমার একটি বৈঠক হয়েছিল। সেখানে আমি খুব স্পষ্ট করে বলেছিলাম—যখন আমাদের ফিলিস্তিনিদের রক্ত ঝরছে, শিশুদের রক্ত ঝরছে, গাজা উপত্যকায় এখনো আমরা অধিকার হারা আর এই মুহূর্তে এটা করা হলে ইসরায়েলকে একটি উপহার দেওয়া হবে। তবে তার (স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর) উত্তর ছিল—আমরা ফিলিস্তিনের প্রতি সমর্থন অব্যাহত রাখব, (পাসপোর্ট) আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করার জন্যই এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আমি স্পষ্ট বলেছিলাম, এটা গ্রহণযোগ্য নয়। তবে চূড়ান্তভাবে আমরা সব দেশের সার্বভৌমত্বকে সম্মান করি। আমরা চেষ্টা করি, কখনো সফল হই, কখনো হই না।

তবে এখন যেটা আবার হয়েছে, এটা বাংলাদেশের জনগণের পক্ষ থেকে ফিলিস্তিনের জনগণের প্রতি অবিচল সমর্থন ও সংহতি ঘোষণা। গত সপ্তাহে ঢাকায় প্রায় ২০ লাখ লোক সমবেশ করে সংহতি জানিয়েছেন। আর পাসপোর্টে ‘এক্সসেপ্ট ইসরায়েল’ যুক্ত হয়েছে। এই দুই ঘটনা আমাদের গৌরাবান্বিত করেছে।

 

বাংলানিউজ: ফিলিস্তিনে দীর্ঘদিন গণহত্যা চলছে। কীভাবে ফিলিস্তিন সংকটের সমাধান হতে পারে?

ইউসুফ এস ওয়াই রামাদান: এটা মিলিয়ন ডলারের একটি প্রশ্ন। এটা সমাধান সম্ভব, তবে অন্য অংশে ইসরায়েল এই সংকটের সমাধান চায় না। কারণ তাদের শক্তি আছে, তাদের পেছনে আমেরিকা আছে। এখানে ভুল বা সঠিক কোনো ইস্যু নেই, এখানে রয়েছে—শক্তি আর শক্তিহীনতার ইস্যু। আমরা এই সংকট সমাধানে ১৯৯০ সাল থেকে ইসরায়েলের সাথে আলোচনা করে আসছি।  ইতোমধ্যে ৩৫ বছর অতিবাহিত হয়েছে। কিন্তু কিছুই হয়নি। এর মধ্যে দিয়ে ফিলিস্তিনিরা মারা যাচ্ছে, রক্ত ঝরছে। আর তারা আমাদের বেশিরভাগ ভূমি দখলে নিয়েছে। আপনারা জানেন, ঐতিহাসিক ফিলিস্তিন মাত্র ২৭ হাজার বর্গ কিলোমিটার। আমরা শুধুমাত্র ২২ শতাংশ ভূমি চেয়েছি, আমাদের রাষ্ট্রের জন্য। আর তাদের ৭৮ শতাংশ। কিন্তু তারা এটাও মানছে না। তাদের উদ্দেশ্য হলো, ‘গ্রেটার ইসরায়েল’ প্রতিষ্ঠা করা। তারা শুধু ফিলিস্তিন নয়, মধ্যপ্রাচ্যের অধিকাংশটাই চায়। তারা যতক্ষণ না মাথা থেকে এই অসুস্থতা না সরাবে, ততক্ষণ শান্তি আসবে না।

বাংলানিউজ: হামাস (ফিলিস্তিনের একটি ইসলামি রাজনৈতিক দল, যারা গাজা শহর নিয়ন্ত্রণ করে) ও ফাতাহ (প্যালেস্টাইন ন্যাশনাল লিবারেশন মুভমেন্টের) এর মধ্যে বিভক্তির জন্য ফিলিস্তিন সংকট সমাধান হচ্ছে না বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন। গত বছর চীনের মধ্যস্থতায় তাদের মধ্যে একটি চুক্তিও হয়েছিল। এ বিষয়ে আপনার মন্তব্য কী?

ইউসুফ এস ওয়াই রামাদান: এই বিভক্তি আসলেই দুঃখজনক একটি অধ্যায়। এই বিভক্তির কোনো ন্যায্যতা নেই। তবে দুভার্গ্যজনক হলেও এটা হয়েছে। তবে বিভক্তি থাকলেও সংকট সমাধান করা যাবে না, সেটা সত্য নয়। এটা ইসরায়েলের প্রচারণা, এর পেছনে যাওয়া উচিত নয়। আমরা এ বিষয়ে খুব সতর্ক। আমরা (হামাস-ফাতাহ) একই জিনিস চিন্তা করি। আমরা আমাদের নিজস্ব দেশ চাই। তবে তারা (হামাস) ভিন্নভাবে বিশ্বাস করে। তারা ভিন্ন পন্থা বিশ্বাস করে। আর আমরা (ফাতাহ) বিশ্বাস করি, আলোচনা ও শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভের মাধ্যমে সমস্যার সমাধান। আমরা শান্তিপূর্ণ পথেই শান্তি আনতে চাই। কেননা আমরা ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার মতো অবস্থানে নেই। আমাদের আলোচনাই করা উচিত। আমরা ইসরায়েলের সাথে আলোচনা করেই এই সংকটের সমাধান চাই। এ ছাড়া আমাদের অন্য কোনো বিকল্প নেই। আমরা যুদ্ধের জন্য যুদ্ধ করতে চাই না। হত্যার জন্য সংগ্রাম করতে চাই না। রক্তপাত চাই না। এটা আমাদের ধরন। তবে আপনি যদি চাপিয়ে দেন, আমরা সেটা করতে বাধ্য হব। আমরা ১৯৬৫ সাল থেকে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছি, আর এখনো ইসরায়েলের সঙ্গে আলোচনা করতে চাই। আমরা যদি আলোচনায় ব্যর্থ হই, তাহলে তখন হামাস বলতে পারে—তোমরা ব্যর্থ, এখন একমাত্র উপায় যুদ্ধ।

আমি বলতে চাই, প্রতিটি ফিলিস্তিনির উচিত পিএলও (প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন)-এর ব্যানারে একত্রিত হওয়া, যেটা ফিলিস্তিনিদের বৈধ প্রতিনিধিত্বকারী সংস্থা। আশা করি, আমাদের হামাসের ভাইয়েরা এখানে এগিয়ে আসবেন। আর ফিলিস্তিনের জনগণকেই ভোটের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নিতে দিন, কে তাদের নিয়ন্ত্রণ করবে। তবে যতই বিভক্তি থাকুক না কেন, এখন এটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে, আমাদের উভয়ের শত্রু একই। এটাই এখন বাস্তবতা। আমরা বিভক্তিকে পাশ কাটিয়েই সামনে এগিয়ে যেতে চাই।

বাংলানিউজ: আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
ইউসুফ এস ওয়াই রামাদান: আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ।

বাংলাদেশ সময়: ০৮৩৬ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৮, ২০২৫
টিআর/এমজেএফ
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।