ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ বৈশাখ ১৪৩২, ০২ মে ২০২৫, ০৪ জিলকদ ১৪৪৬

বাংলানিউজ স্পেশাল

বিডিআর বিদ্রোহ: হাসিনা ও ভারতের সম্পৃক্ততার ইঙ্গিত করে যেসব তথ্য

পিংকি আক্তার, সিনিয়র রিপোর্টার | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১:৩৬, এপ্রিল ৩০, ২০২৫
বিডিআর বিদ্রোহ: হাসিনা ও ভারতের সম্পৃক্ততার ইঙ্গিত করে যেসব তথ্য

২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকার পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহ চলাকালে ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তাসহ মোট ৭৪ জনকে হত্যা করা হয়। এই বিদ্রোহের ঘটনায় সে সময় গঠিত তদন্ত ও বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়।

শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর সেই বিতর্ক জোরালো হয়েছে। ঘটনা সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এমন কিছু তথ্য মিলেছে, যাতে হাসিনা ও ভারতের সংশ্লিষ্টতার ইঙ্গিত পাওয়া গেছে।  

ডিএডি তৌহিদ কি আসলেই বিডিআর হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনার সঙ্গে জড়িত? প্রশ্ন তুলেছেন তৎকালীন তদন্ত কমিশনের সদস্য ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ হাসান নাসির। বাংলানিউজের সঙ্গে তার একান্ত সাক্ষাৎকারের আজ থাকছে বাকি অংশ।
 
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) হাসান নাসির জানান, তদন্তে তারা জানতে পারেন, বেলা এগারোটার পর থেকে সৈনিক লাইনের ৫তলা ভবনে তৌহিদ ও লে. কর্নেল কামরুজ্জামান লুকিয়ে ছিলেন বলে দাবি করেন। বেলা তিনটার দিকে সেখান থেকেই ডিএডি তৌহিদকে ডেকে আনা হয় প্রধানমন্ত্রীর অফিসে যাওয়ার জন্য। আর এইখানে তিনি প্রশ্ন তোলেন, তৌহিদ হত্যার সাথে জড়িত থাকলেও এর ব্যাপকতা তার জ্ঞানের বা আওতার বাইরে চলে যাওয়ায় তিনি হতভম্ব হয়ে লুকিয়ে যান না কি স্বেচ্ছায় তিনি সেখান থেকেই পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছিলেন? বেলা এগারোটার পূর্বে ও সন্ধ্যার পর থেকে তিনি কি করেছিলেন তা অস্পষ্ট রয়ে গিয়েছে। এ বিষয়টি এখনও তদন্তের দাবি রাখে বলে মনে করছেন তিনি।
 
তদন্তের সার্বিক পর্যালোচনায় তিনি জানান, বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনায় হত্যার বিষয়টি প্রাধানমন্ত্রী ছাড়াও গুটিকয়েক আওয়ামী নেতা, মূল পরিকল্পনাকারী বিদেশি সংস্থার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। আর তাই সেদিন দরবার হলে দাবি দাওয়া আদায়ের বিশৃঙ্খলা পরিস্থিতির পূর্বেই তৃতীয় পক্ষ ঢুকে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালায়।

তিনি ষ্পষ্ট করেই জানান, এই হত্যাকাণ্ডের সাথে আওয়ামী নেতা শেখ সেলিম, জাহাঙ্গীর কবির নানক, ব্যারিস্টার তাপস, মির্জা আজমসহ বেশ কিছু নেতা জড়িত ছিলেন। তবে অসহযোগিতামূলক আচরণের জন্য সে সময় বিষয়টি প্রমাণসহ নিশ্চিত করা যায়নি।
 
এদিকে সেদিন দরবার হলে ঘটে যাওয়ার মধ্যে সবচাইতে বিস্ময়কর ঘটনার একটি হলো লে. কর্নেল শামসের আচরণ। ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হাসান নাসির জানান, যেখানে দরবার হলের নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিলেন লে. কর্নেল শামস অথচ আমরা তদন্তে দেখতে পাই, তিনি অফিসারদের নিরাপত্তায় কোনো পদক্ষেপ গ্রহণতো করেনইনি বরং এই জঘণ্য হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে জড়িত থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করেন। তার ইউনিটের অস্ত্র (৪৪ রাইফেলস ব্যাটেলিয়ন) ব্যবহার করে সিপাহী মঈন ডিজির দিকে তাক করে মর্মে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করে। এছাড়া তার ব্যাটালিয়নের সৈনিক লাইনে নিয়ন্ত্রণ কক্ষ স্থাপন করে মাইক দিয়ে এই বিদ্রোহ/হত্যাকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করা হয়। বিদ্রোহী ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক হওয়া সত্ত্বেও তিনি এখন তার বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ অস্বীকার করে বলছেন, এটি ৪৪ নয় ১৩ রাইফেলস ব্যাটালিয়ানের অস্ত্র। কিন্তু এটি ডিজির মুখের কথা ছিল বলে নিশ্চিত হয়, সেই সময়ে গঠিত ন্যাশনাল কমিশনের কাছে, দাবি করেন হাসান নাসির।  

লে. কর্নেল শামসের ভূমিকা ব্যাপকভিত্তিক তদন্তের মাধ্যমে আরো ষ্পষ্ট করা জরুরি বলে দাবি করেন জনাব নাসির। সেই সময়ে তদন্ত কমিশনে উঠে আসা তদন্তের ব্যাখ্যা দিয়ে বাংলানিউজকে তিনি বলেন, কমিশনের সামনে দেওয়া তার সেদিনের বর্ণনায় স্পষ্ট করেননি, ডিজির স্পষ্ট নির্দেশ সত্ত্বেও তিনি দরবার হল থেকে বের হয়ে সরাসরি তার ইউনিটে না গিয়ে, নিকটস্থ জেসিওর বাসায় লুকাতে গেলেন। বরং বহনকারী পিকআপ কর্তৃক গোলাবারুদ বণ্টনের বর্ণনা এমন ছিল, যেটি ঘটনাস্থলে পিকআপের পাশে তার অবস্থান না থাকলে তার পক্ষে সুক্ষ্ম বর্ণনা দেওয়া কোনোভাবেই সম্ভব না। এরপর জনাব নাসির প্রশ্ন তোলেন, মইনের হাতের অস্ত্র যদি ১৩ রাইফেলসের হয়েও থাকে, তবে তিনি নিরাপত্তার দায়িত্ব প্রাপ্ত হওয়ার পরও কেন দরবার হলের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হলেন?
 
সশস্ত্র বিদ্রোহে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ও প্রধানমন্ত্রীর করা মিটিংকে বিরল ও সন্দেহজনক মন্তব্য করে তিনি তদন্ত নিয়ে বাংলানিউজকে জানান, সেদিন ১৪ জন হত্যাকারী প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে গিয়ে কথা বলেন। তবে এদের পরিচিতি সংক্রান্ত কোনো রেকর্ডই তদন্ত কমিশন কোথাও পায়নি। প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে কেউ যাবে (এমনকি একদল প্রমাণিত হত্যাকারী) আর সেটির রেকর্ড কোথাও থাকবে না, এও কি সম্ভব! আর কেউ না জানুক এসএসএফ, পিজিআর, এনএসএই, ডিজিএফএই এবং স্পেশাল ব্রাঞ্চকে নিশ্চিত জানা বাঞ্চনীয় ছিল। ‘আমরা শুধু মিডিয়াতে ৫ জনের চেহারা দেখলাম যারা বেরিয়ে কথা বলল। বাকিদের কোনো নাম, ঠিকানা বা হদিস কোথাও মেলেনি! এ থেকে স্পষ্ট হওয়া যায় যে এটির সাথে শুধু সরকারি সংস্থাই জড়িত ছিল না, জড়িত ছিল তৎকালীন সরকার প্রধানও। ’
 
তদন্ত কমিশন ধারণা করছে, ২৫ ফেব্রুয়ারি ৩টা থেকে সাড়ে ৩টা পর্যন্ত ৩o—৪০ জনের মতো অফিসার খুন হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়। অর্থাৎ শেখ হাসিনা সরকার চাইলেই বাকি হত্যা দমন করতে পারতেন কিন্তু তিনি তা না করে ১৪ জন হত্যাকারীকে ফিরে যেতে দিলেন সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে এবং পরবর্তীতে যেটি দেখা গেল, হত্যাকাণ্ডের সামনের সারিতে নেতৃত্ব দেওয়া ওই ১৪ জন পিলখানায় ফিরে গিয়ে বাকি অফিসারদের নির্মমভাবে হত্যা করল, জানান হাসান নাছির।
 
তদন্তে গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টি তিনি বাংলানিউজকে জানান, ৫৪ জন অফিসারের একটা উল্লেখযোগ্য সংখ্যক অফিসারকে বিভিন্ন জায়গা থেকে তাড়াহুড়ো করে বিডিআরে যোগদান নিশ্চিত করা হয় এবং ২৫ তারিখে এই দরবার হলে উপস্থিত নিশ্চিত করা হয়। এমনকি তড়িঘড়ি করে বাইরের টেইলার্স দিয়ে তাদের ইউনিফর্ম তৈরি করা হয়। আর এদের মধ্যে চৌকস অফিসার কর্নেল গুলজার অন্যতম। আর এই তড়িঘড়ি বদলির বিষয়ই সরকারের প্রতি সন্দেহ আরও ঘনীভূত করে। আর এই বদলির প্রক্রিয়া শুরু হয় ২০০৮ সালের মাঝ থেকে অর্থাৎ নির্বাচনের আগে থেকেই। আর এ বিষয়টি স্পষ্ট তদন্ত করলেই খুনের রহস্য উদঘাটন সম্ভব বলে জানান সাবেক এই সেনা কর্মকর্তা।
 
বাইরের লোক জড়িত
২৫ তারিখ রাতে পিলখানায় ৪টা আনরেজিস্টার্ড অ্যাম্বুলেন্স ৪ নম্বর গেট দিয়ে ঢোকে এবং এরা কারা, গাড়িতে করে কারা প্রবেশ করে বের হলো সেই রেকর্ড আমরা কোথাও পেলাম না, বলেন হাসান নাসির। আর এই বিষয়গুলোই নিশ্চিত করে এইটা কোন বিডিআর বিদ্রোহ নয়, বরং পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড, যেটির সাথে জড়িত বাইরের শক্তি।

তিনি মনে করছেন, এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আরও ব্যাপকভাবে তদন্ত করে সত্য উন্মোচন করা বর্তমান কমিশনের জন্য বড় রকমের চ্যালেঞ্জ, যেটির মাধ্যমে আসল হত্যাকারীদের চিহ্নিত করা সম্ভব।   

২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি স্থানীয় আওয়ামী নেতা-কর্মীরা কয়েক দফায় ৪০-৫০ জনের মিছিল নিয়ে পিলখানায় প্রবেশ করে কিন্তু বের হওয়ার সময় সেই মিছিলে লোক সংখ্যা দ্বিগুণ বা তার অনেক বেশি দেখা যায়। আর এ বিষয় থেকে আমরা তদন্তে স্পষ্ট হই যে মিছিলের আড়ালে বিডিআর সদস্যদের বের করে আনা হয় (সম্ভবত তারাই হত্যাকারী)। এছাড়া সেদিন জনৈক এডি অফিসারদের প্রাণ রক্ষা করতে গিয়ে শহীদ হন। তবে তার বিষয়টি উপেক্ষিত থেকে যায়, যেটি এই তদন্ত কমিশনকে সামনে নিয়ে আসার জন্য পরামর্শ দেন হাসান নাসির।
 
এ সময় প্রয়াত বিএনপি নেতা নাসির উদ্দিন আহমেদ পিন্টুকে গ্রেফতারের বিষয়টি পুরোটাই ছিল সাজানো নাটক বলে জানান জনাব হাসান নাসির। তিনি বলেন, কমিশনের কাছে একটি বেনামী চিঠি আসে যেটি র‌্যাব অফিসেই টাইপ করা হয়েছিল বলে একান্তে বর্ণনা করেন চিঠি বহন করা র‌্যাব সদস্য। প্রথা মোতাবেক সেই বেনামি চিঠি তদন্ত কমিশন আমলে না নেওয়া সত্ত্বেও তিনি জানতে পারেন, পরবর্তীতে ঐ চিঠির ভিত্তিতেই গ্রেফতার করা হয় নাসির উদ্দিন আহমেদ পিন্টুকে। এটি রাজনৈতিকভাবে বিএনপিকে জড়িত করার সুপরিকল্পিত নাটক ছিল বলে মনে করেন তিনি।
 

পিএ/এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।