ঢাকা: জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুনের বিশেষ মিশন নিয়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গন চষে বেড়াচ্ছেন ওসকার ফার্নান্দেজ তারানকো। জাতিসংঘের রাজনীতি বিষয়ক সহকারী মহাসচিব তিনি।
আর সেই দায়িত্ব নিয়ে গত শুক্রবার বাংলাদেশের মাটিতে পা রাখার পর উদয়াস্ত ছুটছেন এই আর্জেন্টাইন কূটনীতিক। প্রধানমন্ত্রী থেকে বিরোধী দলীয় নেতা, সিভিল সোসাইটির প্রতিনিধি থেকে শুরু করে সাংবাদিক-ধরণা দিচ্ছেন সর্বমহলে। ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে সঙ্কট সমাধানের অমীয় মন্ত্রে দীক্ষিত করতে চাইছেন সবাইকে।
তাই আসার পর এখন পর্যন্ত ফেরার নাম মুখে নিচ্ছেন না চৌকস এই আর্জেন্টাইন। রোববার জামায়াতের হরতালেও কর্মব্যস্ত দিন কেটেছে তার। সকালে জার্মান রাষ্ট্রদূত আলব্রেখট কোনৎসে’র বাসায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মজীনা, চীনা রাষ্ট্রদূত লী জুন ও কানাডীয় হাই কমিশনার হেডেন ক্রুডেনের সঙ্গে বৈঠক দিয়ে শুরু করা দিন আরো ব্যস্ত হয়ে উঠেছে বেলা বাড়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে।
কিন্তু নিজের কর্মব্যস্ততার কোন কিছুই আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করছেন না তারানকো। যেন বরফ না গলিয়ে মুখ খুলবেন না বলে ফন্দি এঁটেছেন পেশাগত জীবনে বহুবার অসম্ভব পরিস্থিতিকে সম্ভব করে তোলা এই ‘ক্রাইসিস ম্যানেজার’।
এরই মধ্যে বিরোধী দলীয় নেতা খালেদা জিয়ার সঙ্গে এক দফা বৈঠক হয়েছে তার। তার আগে বিএনপি নেতাদের সঙ্গে আলাদা একটা বৈঠকও করেছেন তিনি। এখন শোনা যাচ্ছে, সোমবার দুপুরে আরো একবার খালেদা জিয়ার কাছে যাবেন মধ্যস্থতাকারী হিসেবে সুনাম কুড়োনো এই অতিথি কূটনীতিক।
জাতিসংঘ সূত্রে জানা গেছে, যেখানে সব ধরনের মধ্যস্থতার আশা শেষ হয়ে যায়, সেখান থেকেই কাজ শুরু করেন তারানকো। আলোচনায় কোন ফল না পাওয়ার রেকর্ড নাকি তার জীবনের অভিধানেই নেই।
আর এমন গুণের কারণেই বেনিনে জাতিসংঘ স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করা তারানকো বহু ঘাট মাড়িয়ে উঠে এসেছেন জাতিসংঘের মতো বিশ্ব সংগঠনের ‘ক্রাইসিস ম্যানেজার’ এর ভূমিকায়।
২০০৯ সালের মার্চে তাকে রাজনীতি বিষয়ক সহকারী মহাসচিবের দায়িত্ব দেন জাতিসংঘ মহাসচিব। তার হাতে তুলে দেন জাতিসংঘের সঙ্গে আমেরিকা, এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল, ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য ও পশ্চিম এশিয়ার সম্পর্ক সামলানোর দায়িত্ব। একই সঙ্গে ডিকলোনাইজেশন আর ফিলিস্তিনী অধিকার নিয়ে কাজ করারও দায়িত্ব তুলে দেওয়া হয় তার কাঁধে।
সদর দপ্তরের নথিপত্র ও মাঠের দৌড়-ঝাঁপে সমান দক্ষ তারানকো ২৫ বছর ধরে জাতিসংঘ পদ্ধতি নিয়েই কাজ করেছেন। অনেক জটিল পরিস্থিতিতেও জ্বালিয়েছেন সমাধানের আলো। মধ্যপ্রাচ্য, লাতিন আমেরিকা, ক্যরিবীয় অঞ্চল, আফ্রিকা ও ইউরোপে তার রাজনীতি, শান্তিগঠন ও মানবিক তৎপরতা সর্বমহলের প্রশংসা পেয়েছে।
ফিলিস্তিনীদের সহায়তায় ১৯৯৪ সাল থেকে ’৯৮ সাল পর্যন্ত তিনি প্রশাসকের উপ বিশেষ প্রতিনিধির দায়িত্ব পালন করেছেন গাজা ও পশ্চিম তীর কর্মসূচিতে। ছিলেন উপ সহকারী প্রশাসক। ইউএনডিপিতে আরব রাষ্ট্রগুলোর উপ আঞ্চলিক ব্যুরো পরিচালক ছিলেন ৫ বছর।
১৯৯৮-২০০১ সাল পর্যন্ত জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধি ছিলেন। পালন করেছেন আবাস সমন্বয়কের দায়িত্ব। মহাসচিবের বিশেষ উপ প্রতিনিধি হিসেবে সামলেছেন হাইতি পরিস্থিতি।
বর্তমান পদে নিয়োগ পাওয়ার প্রাক্কালে তাঞ্জানিয়ায় আবাস সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করছিলেন তারানকো। সেখানকার সংস্কার তৎপরতাতেও তার ছিলো উল্লেখযোগ্য ভূমিকা।
তার আগে তিনি জাতিসংঘ ক্যাপিটাল ডেভেলপমেন্ট ফান্ড কর্মসূচিতে পালন করেন কান্ট্রি অফিসারের দায়িত্ব। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির অধীনে একই দায়িত্ব পালন করেন লাতিন আমেরিকা ও ক্যারিবীয় অঞ্চলে।
১৯৫৭ সালে জন্ম নেওয়া তারানকো অর্থনীতি নিয়ে পড়াশোনা করেন কর্নেল ইউনিভার্সিটি ও ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে। পরে শহুরে-আঞ্চলিক অর্থনীতি পরিকল্পনা বিষয়ে নেন উচ্চতর ডিগ্রি।
এতো অভিজ্ঞতা ও কারিশমা সত্ত্বেও অবশ্য বাংলাদেশ পরিস্থিতি সামলাতে বেশ বেগ হতে হচ্ছে তারানকোকে। দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের দুই শীর্ষ নেত্রীকে একগুঁয়ে মনোভাব থেকে বের করে এনে সংলাপে বসানোর টার্গেটে তিনি কতোটা সফল হন সেটাই এখন দেখার বিষয়।
বাংলাদেশ সময়: ২১২৯ ঘণ্টা, মে ১২, ২০১৩
জেডএম/