ঢাকা, বুধবার, ২৮ মাঘ ১৪৩১, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২ শাবান ১৪৪৬

বাংলানিউজ স্পেশাল

বিষাদের সাক্ষী অধর চন্দ্র বিদ্যালয়, পাঠে ফিরছে রোববার

ইসমাইল হোসেন, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০৫৩ ঘণ্টা, মে ১৮, ২০১৩
বিষাদের সাক্ষী অধর চন্দ্র বিদ্যালয়, পাঠে ফিরছে রোববার

ঢাকা: অধরচন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়। রানা প্লাজা ট্রাজেডির জীবন্ত সাক্ষী।

ভবন ধসের পর শত শত মৃতদেহের অস্থায়ী ঠাঁই হয়ে উঠেছিল এই বিদ্যালয়ের মাঠ। স্বজনদের খোঁজে আসা প্রিয়জনদের গগণবিদারী কান্না, আর তাদের অশ্রুজল কাঁদিয়েছে অধরচন্দ্র বিদ্যালয়কেও। প্রতিষ্ঠার একশ’ বছরের মাথায় রানা প্লাজা ট্রাজেডি আকাশসম বিষাদ বুকে ধারণ করতে বাধ্য করেছে এই বিদ্যালয়কে।

গত ২৪ এপ্রিল সাভারের রানা প্লাজা ধসে পড়ার পরপরই বেলা ১২টার দিকে বন্ধ করে দেওয়া হয় অধর চন্দ্র বিদ্যালয়। বহু মানুষ নিয়ে ধসে পড়া ভবনটিতে হতাহত অনেক, তাদের মৃতদেহ রাখার আশপাশে কোনো বড় মাঠ না থকায় সাভার বাস স্ট্যান্ডের প্রায় এক কিলোমিটার অদূরে এই বিদ্যালয় মাঠকেই বেছে নেয় স্থানীয় প্রশাসন।

হতাহতদের উদ্ধার করে মরদেহ প্রথমেই নিয়ে আসা হয় এই বিদ্যালয় মাঠে। সাইরেন বাজিয়ে লাশবাহী গাড়ি এলে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়েছিল অধর চন্দ্র উচ্চবিদ্যালয় মাঠে। দিনের পর দিন অপেক্ষমান স্বজনদের কাছে এখানেই শনাক্ত হয়ে কারো লাশ গেছে পরিবারের কাছে। প্রশাসনের মাধ্যমে প্রত্যেক মৃতব্যক্তির পরিবারকে অনুদান দিয়ে মরদেহ পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়। আর যে সব মৃতদেহ শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি, হতভাগ্য সে সব মৃতদেহের মর্গ থেকে শেষ ঠিকানা হয়েছে রাজধানীর জুরাইন কবরস্থান।

সাভারের জমিদার বাবু রাখাল চন্দ্র সাহা ছিলেন বিদ্যুৎসাহী। তাই বাবা অধর চন্দ্র সাহার নামে ১৯১৩ সালের ১০ জানুয়ারি সাত একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠা করেছিলেন একটি হাই স্কুল। কালের পরিক্রমায় শত বছরের মাথায় বিশাল অবয়বে পরিণত অধর চন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়।

কিন্তু সাভার ট্রাজেডিতে শোকাহত গোটা জাতি, যে যার সাধ্যমত সহায্য, সহযোগিতা ও সহমর্মিতার হাত বাড়িয়েছে ভুক্তভোগীদের প্রতি। অধর চন্দ্র বিদ্যালয় পরিবারও শামিল হয়েছিল সেই সারিতে।

দুই সিফটে প্রায় এক হাজার ২০০ ছাত্র-ছাত্রী অধর চন্দ্র বিদ্যালয়ে। এছাড়াও প্লে গ্রুপ থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত রাখাল চন্দ্র একাডেমিতেও প্রায় ৩০০ ছাত্র-ছাত্রী। adhar-chandra-01

দীর্ঘ ২৪ দিন বন্ধ থাকার পরে শনিবার খুলছে এই বিদ্যালয়। এতো দিন বিদ্যালয়ের একাডেমিক কার্যক্রম চালাতে না পারলেও ক্ষোভ নেই বিদ্যালয় পরিবারের। শিক্ষক-শিক্ষার্থী-অভিভাবকরা সামান্য ক্ষতি পুষিয়ে জাতীয় দুর্যোগে নিজেদের বিলিয়ে দিয়ে সেবা করতে কার্পণ্য করেননি।

মৃতদেহের জন্য আসা স্বজনরা দিনরাত কাটিয়েছেন এই বিদ্যালয়ে। প্রথম দিকে কয়েক হাজার মানুষ থেকেছে বিদ্যালয়ে, পরবর্তীতে অবশ্য দুই থেকে তিনশ’ স্বজন অপেক্ষা করছিল।

বিদ্যালয়ের পূর্ব-পশ্চিম লম্বা দ্বিতল ভবনের নিচতলা এবং রায় ননী বালা ষোড়শী মোহন পাঠাগারের বারান্দায় সাদা পলিব্যাগে ভরা মৃতদেহগুলো সারিবদ্ধভাবে রাখা হয়েছিল। আর বিদ্যালয়ের দেওয়ালে ছিল হাজার হাজার নিখোঁজের নোটিশ। দেওয়াল যেন হয়ে উঠেছিল ‘নিখোঁজদের জন্য নোটিশ বোর্ড’।

বিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষ, টয়লেট ব্যবহারে কোন বিধি নিষেধ রাখেনি কর্তৃপক্ষ। স্থানীয়দের পাশাপাশি বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও মাঝে মধ্যে খাওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন তাদের। মৃতদেহ হস্তান্তর করতে স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তারাও ব্যবহার করেছেন স্কুলের অবকাঠামোসহ প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা।

অধর চন্দ্র উচ্চ বিদ্যায়ের প্রধান শিক্ষক (ভারপ্রাপ্ত) মো. হারন-অর-রশিদ বাংলানিউজকে বলেন, “জাতীয় দুর্যোগে আমরাও নিখোঁজদের স্বজনদের পাশে দাঁড়াতে পেরেছি, এটা অনেক বড় ব্যাপার। ”

১৩ মে উদ্ধার তৎপরতা শেষ হয় রানা প্লাজা থেকে। সরকারি হিসেবে মোট ৩ হাজার ৫৫৩ জনকে উদ্ধার করা হয়েছে, যার মধ্যে ২ হাজার ৪৩৮ জন জীবিত। মোট ১ হাজার ১১৫ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে ভবন থেকে। মোট মৃতের সংখ্যা ১ হাজার ১৩০ জন। ৮৩৪টি মরদেহ তাদের আত্মীয়-স্বজনের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে ৫৯টি মরদেহ রাখা আছে। আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলামের মাধ্যমে ২৩৪টি মরদেহ দাফন করা হয়েছে। জীবিত উদ্ধারকৃতদের মধ্যে হাসপাতালে ১৫ জন মারা যান। হাসপাতাল থেকে মরদেহ সরাসরি আত্মীয়-স্বজন গ্রহন করেছেন ৩টি। বর্তমানে বিভিন্ন হাসপাতালে আহতদের মধ্যে ৩১৯ জন চিকিৎসাধীন রয়েছে।
adhar-chandra-02
নিহতদের বেশিরভাগেরই লাশ নিয়ে আসা হয়েছিল অধর চন্দ্র মাঠে। প্রধান শিক্ষক হারুন-অর-রশিদ বাংলানিউজকে বলেন, “শুক্রবার স্কুলে ধোয়ামোছা শেষ হয়েছে। শনিবার মিলাদ ও দোয়া মাহফিল শেষে রোববার থেকে ক্লাস শুরু হবে। ”

এবার এসএসসি পরীক্ষায় প্রায় ৯৮ শতাংশ শিক্ষার্থী কৃতকার্য হয়েছে এই বিদ্যালয়ে। ২০৩ জন অংশ নিয়ে ১৯৮ জন পাস ও ১৯ জন জিপিএ-৫ পেয়েছে বলে জানিয়েছে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।

প্রধান শিক্ষক হারুন-অর-রশিদ বলেন, দীর্ঘ দিন স্কুল বন্ধ থাকায় যে ক্ষতি হয়েছে তা পুষিয়ে উঠতে গ্রীষ্মের ছুটির মধ্যে (১৮ মে-৬ জুন) ক্লাস নেওয়া হবে।

বিদ্যালয়ের শতবর্ষে পদার্পণের বছরে বিষাদকে ছাপিয়ে পাঠদানে মনোনিবেশ করে জ্ঞানের আলোর গতিধারায় আবারও শামিল হবে অধর চন্দ্র বিদ্যালয় পরিবার।  

বাংলাদেশ সময়: ১০৩৩ ঘণ্টা, মে ১৮, ২০১৩
এমআইএইচ / সম্পাদনা : শাহজাহান মোল্লা নিউজরুম এডিটর/জেডএম; [email protected];জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।