ঢাকা, বুধবার, ২৮ মাঘ ১৪৩১, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২ শাবান ১৪৪৬

বাংলানিউজ স্পেশাল

মালয়েশিয়ায় পাসপোর্ট লোপাট

হাইকমিশনেই সক্রিয় সিন্ডিকেট!

মাজেদুল নয়ন, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪৪৩ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ৪, ২০১৪
হাইকমিশনেই সক্রিয় সিন্ডিকেট!

ঢাকা: মালয়েশিয়ায় রোহিঙ্গাসহ অবৈধভাবে অবস্থানকারী বাংলাদেশিদের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নিতে পাসপোর্ট খোয়া যাচ্ছে বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে। প্রতিটি পাসপোর্ট বিক্রি হচ্ছে দেড় লাখ থেকে আড়াই লাখ টাকায়।

পাসপোর্ট চুরি ও বিক্রির পুরো প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করছে একটি শক্তিশালী চক্র। মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশ হাইকমিশনের একটি সিন্ডিকেটের তৎপরতায় এমনটা হচ্ছে বলে দেশটির একাধিক সূত্র বাংলানিউজকে জানিয়েছে।

মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশের হাইকমিশনার আতিকুর রহমানও বাংলানিউজের কাছে ৫০০ পাসপোর্ট খোয়া যাওয়ার কথা স্বীকার করেছেন।

যদিও পাসপোর্ট চুরির পুরো বিষয়টিতে সূচনা রানী হালদার নামে এক কর্মকর্তার দিকে সন্দেহের তীর ছুড়েছে দূতাবাস।

সূচনা বাড়তি সময় দপ্তরের বাইরে অবস্থান করছেন বলে হাই কমিশনের তরফ থেকে অভিযোগ জানানো হয়েছে ঢাকাস্থ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে।

‘দালালদের মাধ্যমে দূতাবাসের কর্মকর্তারা পাসপোর্ট বিক্রি করছেন মর্মে অভিযোগ রয়েছে’ জানালে মন্তব্য করতে রাজি হননি আতিকুর রহমান।
 
তবে এ নিয়ে কুয়ালালামপুর পুলিশের কাছে অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে বলে জানান তিনি।  

তিনি বলেন, ‘তদন্ত টিম গঠন করা হয়েছে। তারা ণূএ বিষয়ে কাজ করছে।

তিনি বলেন, ‘তদন্ত কমিটি করে দেয়া হয়েছে, আগামী সপ্তাহে রিপোর্ট হাতে পেলে তা দেশে পাঠানো হবে।

মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশ দূতাবাসেরই একটি সূত্র বাংলানিউজকে জানিয়েছে, পাসপোর্ট চুরির নামে এটি মূলত এক ধরনের সাজানো নাটক। গত নভেম্বরে মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশ দূতাবাসে সরেজমিন অনুসন্ধান চালিয়েও বাংলানিউজ এ ধরনের তথ্য পেয়েছিলো।

সূত্র জানায়, দূতাবাসের কর্মকর্তারা দালালদের মাধ্যমে সাদা পাসপোর্ট বের করে দিচ্ছে। এগুলো কোতরায়াসহ মালয়েশিয়ার বিভিন্ন স্থানে বাঙালি ও রোহিঙ্গাদের মধ্যে দেড় থেকে তিন লাখ  টাকা দরে বিক্রি করা হয়।
 
সূত্র মতে, আগামী কয়েক মাসের মধ্যে মালয়েশিয়া সরকার অবৈধ প্রবাসীদের বৈধ হওয়ার সুযোগ দেবে। এর আগ মুহুর্তেই এসব পাসপোর্ট বিক্রির জন্যে বের করা হয়েছে। এর আগেও ২০১২ সালে একই ঘটনা ঘটেছে।
 
কুয়ালালামপুরে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিয়োজিত এক প্রবাসী বাংলাদেশি বাংলানিউজকে বলেন, গত এক মাস ধরেই এখানকার পুলিশের হাতে বাংলাদেশিরা জাল পাসপোর্টসহ ধরা পড়ছিল। বিশেষ করে ২১ জানুয়ারি থেকে অবৈধদের ধরতে অভিযান চালালে বাংলাদেশি পাসপোর্ট হাতে অনেক রোহিঙ্গা এবং অবৈধ বাংলাদেশি গ্রেপ্তার হয়। আসল পাসপোর্টে জাল স্বাক্ষর এবং ভিসা পাওয়াতে দূতাবাস থেকে পাসপোর্ট বের হওয়ার বিষয়টি বোঝা যায়।
 
দূতাবাস সূত্র জানায়, পাসপোর্ট ব্ল্যাকিংয়ের এ অবৈধ কাজে জড়িত রয়েছেন দূতাবাসের অনেক উর্ধ্বতন কর্মকর্তাও। বৈধ পাসপোর্টের মতোই বাজারে বিক্রি হওয়া এসব পাসপোর্টে রয়েছে সেকেন্ড সেক্রেটারি মিজানুর রহমানের স্বাক্ষর। তবে মিজানুর রহমান দাবি করেছেন স্বাক্ষর জাল করা হয়েছে।
 
পাসপোর্ট ডেলিভারির দায়িত্বে থাকা পল্লবের নামও উঠে এসেছে অভিযোগে।
 
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নাম ভাঙ্গিয়ে মালয়েশিয়াতে রয়েছে বেশ কয়েকটি শাখা কমিটি। এসব কমিটি নিজেদের ‘আসল মালয়েশিয়া আওয়ামী লীগ’ বলে পরিচয় দেয়। এ রাজনীতির সঙ্গে জড়িত রয়েছে মালয়েশিয়ার বিভিন্ন স্তরের ব্যবসায়ী ও দালাল। দূতাবাসের অন্যসব দুর্নীতির মতো পাসপোর্ট ‍সরিয়ে বাজারে বিক্রিতে জড়িত রয়েছে তারা।
 
মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশ দূতাবাসের বেশ সক্রিয় দালাল বশির আহমেদ ফারুক। লেবার ভিসাতে অবস্থান করলেও নিজেকে বাংলাদেশের একটি বেসরকারি টেলিভিশনের ‍কুয়ালালামপুর প্রতিনিধি হিসেবে পরিচয় দেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দূতাবাসের একজন কমকর্তা জানান, অনেক সিনিয়র কর্মকর্তারও হাইকমিশনারের রুমে প্রবেশ করতে অনুমতি লাগে। তবে বশিরের প্রয়োজন হয় না।
 
ওই কমর্কর্তা জানান, সেকেন্ড অফিসার মিজানুর রহমানের ওপর নির্দেশনা রয়েছে বশিরের কাজগুলো যেনো করে দেওয়া হয়। মূলত বশিরের মাধ্যমেই সাদা পাসপোর্টগুলো বাজারে বের করতেন তারা। তবে দূতাবাসের পাসপোর্ট বাজারে বিক্রির প্রমাণ মিললে,  চ্যান্সেরি স্টক থেকে  পাসপোর্টগুলো চুরি  হয়েছে বলে বিষয়টি ধামাচাপা দেবার চেষ্টা করছেন দূতাবাসের কর্মকর্তারা।
 
তবে একসঙ্গে এতোগুলো পাসপোর্ট সরানোর ঘটনা ফাঁস হয়ে পড়ায় বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছে দূতাবাস। ঘটনাটি জানাজানি হওয়াতে বিক্রির অভিযোগ ধামাচাপা দিতে এখন চুরির কথা বলে একে অপরকে দোষারোপ করে জলঘোলা করছেন কর্মকর্তারা। বশিরকেও আপাতত দূতাবাস এলাকায় যেতে নিষেধ করা হয়েছে।
 
দূতাবাসের ওই কর্মকর্তা আরো অভিযোগ করে বলেন, মালয়েশিয়া দূতাবাস থেকে পাসপোর্ট খোয়া যাওয়ার নাটক নতুন কিছু নয়। এখানে কর্মকর্তা আর দালালদের যৌথ ব্যবসা এটি। আগেও ২০১২ সালে দূতাবাস থেকে কয়েক হাজার পাসপোর্ট খোয়া যায়। পরে সেসব পাসপোর্ট কোতরায়াসহ অনেক স্থানেই বিক্রি হয়েছে দালালের মাধ্যমে।

তিনি বলেন, হাইকমিশনার সাহেব সব কিছুই জানেন। অনেক অভিযোগও এসেছে মালয়েশিয়া পুলিশ এবং এখানকার প্রফেশনাল ভিসাধারীদের কাছ থেকে। তবে তিনি কোনো উদ্যেগ নেন নি।

পাসপোর্ট হারানোর বিষয়টি তদন্তের জন্য হাইকমিশনের প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা এয়ার কমোডর এম আবুল বাশারকে প্রধান করে তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে।

সূত্র জানায়, বাংলাদেশ হাইকমিশনের সুরক্ষিত ভান্ডারে (ভল্টরুমে) সূচনা রানী হালদারের কামরাটি অবস্থিত। হাইকমিশনের পাসপোর্ট তার জিম্মায় থাকে।

এদিকে পুরো বিষয়টি তদন্ত করতে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয় এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের নিয়ে গঠিত একটি উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত দল শিগগিরই মালয়েশিয়া যাচ্ছে।

মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, কয়েকদিনের মধ্যে কুয়লালামপুরে গঠিত তদন্ত দলের প্রতিবেদনও পাওয়া যাবে।

বাংলাদেশ সময় ১৪২২ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ৪, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।