ঢাকা, বুধবার, ২৮ মাঘ ১৪৩১, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২ শাবান ১৪৪৬

বাংলানিউজ স্পেশাল

বিদেশি অপরাধী (পর্ব-১)

পর্যটক-ব্যবসায়ী পরিচয়ে সক্রিয় বিদেশি অপরাধীরা

আদনান রহমান, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৭৪৮ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৬, ২০১৪
পর্যটক-ব্যবসায়ী পরিচয়ে সক্রিয় বিদেশি অপরাধীরা

ঢাকা: পর্যটন খাতে ও গার্মেন্ট ব্যবসায়ে বিনিয়োগের ‘অজুহাতে’ বাংলাদেশে এসে অপরাধ সংগঠন করছে অনেক বিদেশি অপরাধী। সম্প্রতি আটক প্রায় অর্ধশত বিদেশি নাগরিকের কাছে এমন তথ্য পেয়েছে র‍্যাব ও গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ।


 
গত চার মাসে রাজধানীতে আটক ৪৪ জন অপরাধীর মধ্যে জাল টাকা চক্রের চারজন আফ্রিকান, পাকিস্তানি জঙ্গি সংগঠনের সদস্য তিন জন, অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসায়ী চীনা ও তাইওয়ানের নাগরিক রয়েছে ৩৭ জন।
 
পুলিশের খসড়া পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বিভিন্ন অপরাধে ২০১১ সালে তিন জন, ২০১২ সালে ২৯ জন এবং ২০১৩ সালে ৬৭ জন বিদেশিকে গ্রেফতার করা হয়। চলতি বছর এপর্যন্ত গ্রেফতার হয়েছেন সাত জন।
 
কেন তাদের প্রতারণার কেন্দ্রবিন্দু বাংলাদেশ? কি উদ্দেশ্য নিয়ে তারা বাংলাদেশে এবং কী করে? তাদের অপরাধের সাথে বাংলাদেশের কোন নাগরিকের যোগসাজশ আছে কি না? কেনইবা তারা উত্তরা এবং বারিধারাকেন্দ্রিক অভিজাত এলাকায় বসতি গড়ে তোলে? -এসব প্রশ্নের উত্তর মিলেছে বাংলানিউজের অনুসন্ধানে।
 
যে সব পরিচয়ে বিদেশি অপরাধীরা বাংলাদেশে...
বাংলানিউজের অনুসন্ধানে বিদেশি অপরাধীদের পাসপোর্ট যাচাই করে দেখা গেছে, তারা সাধারণত পর্যটক, গার্মেন্ট ব্যবসায়ী, আমদানি-রফতানি ব্যবসায়ী হিসেবে বা  তথ্য-প্রযুক্তি ও টেলিকম সেক্টরে ব্যবসার কারণ দেখিয়ে বাংলাদেশে আসে। আর এসব পরিচয়ের আড়ালে তারা অপরাধ সংগঠন করে যাচ্ছে।
 
র‍্যাব-১ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল কিসমত হায়াৎ বাংলানিউজকে বলেন, আটককৃতদের অধিকাংশই ব্যবসায়ী ও বিনিয়োগকারী পরিচয়ে আসে। তবে পর্যটক (টুরিস্ট) ভিসা নিয়ে বাংলাদেশে এসে অপরাধ করার সংখ্যাও কম না।
 
তবে এর বাইরে ট্রানজিট ভিসা নিয়েও বাংলাদেশে এসে অপরাধ সংগঠন করছে বিদেশিরা।
 
র‍্যাবের মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক এটিএম হাবিবুর রহমান বলেন, আরেক শ্রেণির প্রতারক অন্য দেশে যাবার কথা বলে ট্রানজিট ভিসা নিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। পরে নিজেদের পাসপোর্ট নষ্ট করে ফেলে অথবা তারা পাসপোর্টের সঙ্গে তাদের নিজের বলা নামের মিল থাকে না।
 
অনুসন্ধানে জানা গেছে, অনেকে  স্টুডেন্ট ভিসা নিয়ে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থী হিসেবে এসে বিভিন্ন অপরাধ সংগঠন করে যাচ্ছে।
 
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ, নর্থ সাউথ, ইস্ট ওয়েস্ট, ইন্ডিপেন্ডেন্ট, আমেরিকান আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলকভাবে বেশি বিদেশি শিক্ষার্থীরা অধ্যয়ন করে।
 
ডিএমপির যুগ্ম-কমিশনার মনিরুল ইসলাম গত সপ্তাহে জাল টাকািও জাল টাকা থেরির কেমিক্যালসহ আটক তিন আফ্রিকানকে নিয়ে ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, বেশিরভাগ অপরাধী বাংলাদেশে ট্যুরিস্ট ভিসায় আসে। ট্যুরিস্ট হিসেবে তাদের স্বাগত জানানো হয়। আর এই সুযোগটিরই অপব্যবহার করে তারা।
 
বিদেশিদের অপরাধ ও বাংলাদেশিদের যোগসাজশ
অনুসন্ধানে জানা গেছে, বাংলাদেশে আসা বিদেশি অপরাধীরা এদেশে প্রবেশের আগেই দেশীয় এজেন্টদের সঙ্গে যোগাযোগ করে থাকে। এদেশে প্রবেশের পর তারা অভিজাত হোটেলগুলোতে অবস্থান নেয়। পরে এজেন্টদের মাধ্যমে গুলশান, বনানী, বারিধারা কিংবা উত্তরা এলাকায় বাসা ভাড়া নিয়ে থাকতে শুরু করে।
 
বিদেশিদের সেই এজেন্টরা হচ্ছে বাংলাদেশি নাগরিক, বাংলাদেশে বসবাসরত বিদেশি কূটনীতিক এবং প্রিমিয়ার লীগ খেলতে আসা আফ্রিকান ফুটবল খেলোয়াড়রা।
র‍্যাব-পুলিশ এসব তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করলেও কারও বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট অভিযোগের কথা বলেনি।
 
র‍্যাবের মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক এটিএম হাবিবুর রহমান বলেন, “প্রতিটি বিদেশির অপরাধের পেছনে আছে দেশি ২/১ জনের যোগসাজস। অনেক বিদেশি বাংলাদেশি নারী বিয়ে করে এবং বাংলাদেশের নাগরিক হয়ে অপরাধ সংগঠন করে। ”
 
এভাবে বৈবাহিক সম্পর্ক তৈরি করেই তারা মাদকদ্রব্য বিক্রি ও পাচার, অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসা, ক্রেডিট কার্ড জালিয়াতি, বাংলাদেশি টাকা ও ডলার জালিয়াতিসহ বড় ধরনের অপরাধ সংঘটন করে।
 
র‍্যাব -১ এর অধিনায়ক লে.কর্নেল কিসমত হায়াৎ বলেন, ‘বিদেশিরা আধুনিক কৌশলে বাংলাদেশে প্রতারণার ব্যবসায় জড়িত। সর্বশেষ চীনা ও তাইওয়ানের অপরাধীদের ধরতে আমরা লন্ডনের ডিজিটাল ফরেনসিক টেকনিশিয়ানদের সাহায্য নিই। ’
 
কেন বাংলাদেশ?
বিদেশিরা প্রায়ই বাংলাদেশকে নিজেদের আন্তর্জাতিক অপরাধের ঘাঁটি বানায়। এর অন্যতম কারণ- বাংলাদেশে বিদশিদের অনেক ছাড় এবং সম্মান দেওয়া হয়। এছাড়াও বিদেশিরা বাংলাদেশের আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণকারী বাহিনীকে অদক্ষ ও দুর্বল ভাবে।
 
এ বিষয়ে র‌্যাব-১ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল কিসমত হায়াৎ বলেন, “অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে তুলনামূলক কম খরচে প্রবেশ, থাকা-খাওয়া ও ইন্টারনেট সুবিধা রয়েছে। এছাড়াও তাদের ‘দুর্ভাগ্য’ যে তারা বাংলাদেশের আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে অনেক দুর্বল ভেবেছিল। ”
 
অন-অ্যারাইভাল ভিসার অপব্যবহার
বাংলাদেশে আসতে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, রাশিয়া, চীন, জাপান, সিঙ্গাপুর, মালয়শিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া আরব-আমিরাত, সৌদি আরব, কাতার, কুয়েত, ওমান, বাহরাইন এবং ইউরোপীয় পাসপোর্টধারীদের ৩০ দিনের অন-অ্যারাইভাল ভিসা দেওয়া হয়।
 
অর্থাৎ তাদের বাংলাদেশি এয়ারপোর্টে এসে ভিসা নিলেই চলে। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশি দূতাবাসের ভেরিফিকেশন করার কোনো সুযোগ থাকে না। একে কাজে লাগিয়েই অন্য দেশের নাগরিকরা বাংলাদেশে এসে অপরাধ করছে।
 
র‍্যাব কর্মকর্তা লে. কর্নেল কিসমত হায়াৎ এ বিষয়ে আরও বলেন, অন্যান্য দেশের সাথে আমাদের কূটনীতিক সুসম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে অপরাধীরা বাংলাদেশে এসে অপরাধ করছে।
 
বাংলাদেশ সময়: ০৭৪৪ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৬, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।