রহমতের মাস, মাগফিরাতের মাস, মুক্তির মাস ফিরে এসেছে আমাদের মাঝে। এ বরকতময় মাসে প্রিয় নবীর (সা) ওপর অবতীর্ণ হয়েছিল মহাগ্রন্থ পবিত্র আল-কোরআন।
আরবি শব্দ সাওমের বহুবচন হচ্ছে সিয়াম। আভিধানিক অর্থ বিরত থাকা। আর ইসলামের পরিভাষায় এর অর্থ হচ্ছে, সুবহে সাদিক ঘোষণা থেকে শুরু করে সূর্যাস্ত পর্যন্ত যে কোনো রকমের পানাহার ও কামনা থেকে বিরত থাকা। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ পাক ঘোষণা করেন, হে ঈমানদারগণ! তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমন তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছিল, যাতে তোমরা তাকওয়া বা সাবধানতা অবলম্বন করো।
মাহে রমজানের নির্দেশিত কর্ম হলো সাধারণভাবে আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য পানাহার ও কাম থেকে বিরত থাকা। মাহে রমজানের রোজা মানুষকে সব ধরনের অন্যায় ও অমঙ্গল কাজ থেকে বিরত রাখে। আমাদের হাত যাতে কোনো অন্যায়কে স্পর্শ না করে; চুরি, ঘুষ বা কারো অবাঞ্ছিত অর্থ গ্রহণ না করে; জিহ্বা যাতে তিকর কোনো শব্দ উচ্চারণ না করে সেজন্য রোজা অতন্দ্র প্রহরীর কাজ করে। এজন্যই রমজানের রোজা এত মহীয়ান। রোজার এ শিা শুধু একদিনের জন্য নয়। বরং ৩৬৫ দিনের জন্য ৭২০ ঘণ্টাব্যাপী রমজানের এই সুমহান প্রশিণ।
পবিত্র রমজানের ৩০টি দিনকে তিন ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। এর প্রথম ১০ দিন রহমতের, মধ্যবর্তী ১০ দিন মাগফিরাত এবং শেষ ১০ দিন দোজখ থেকে মুক্তির। এ প্রসঙ্গে হাদিস শরিফে বর্ণিত হয়েছে। হজরত উবাদাহ ইবনে ছামিত (রা) থেকে বর্ণিত আছে যে, মহানবী (সা) রমজানের কিছু আগে আমাদের বলেন যে, মাহে রমজান আগতপ্রায়। এটি বড় বরকতের মাস। আল্লাহ পাক এতে তোমাদের প্রতি বিশেষ দৃষ্টি নিপে করেন, গোনাহ মাফ করে দেন, দোয়া কবুল করেন, ইবাদতের প্রতি তোমাদের দেখতে থাকেন এবং ফেরেশতাদের কাছে গর্ব করেন। সুতরাং আল্লাহপাককে সৎকাজ করে দেখাও। হতভাগা ওই ব্যক্তি যে এই মহান বরকত ও ফজিলতের মাসে আল্লাহর খাস রহমত থেকে বঞ্চিত রইল। মহানবী (সা) বলেন, রমজানের মধ্যভাগে মাগফিরাত শুরু হয়, কারণ রোজার একাংশ অতিবাহিত হওয়ার দরুন তার প্রতিদান মা দিয়ে শুরু হয় এবং শেষাংশে দোজখ থেকে মুক্তিলাভ। কাজেই রোজা কেবল সুবহে সাদিক থেকে নিয়ে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার থেকে শুধু বিরত থাকা নয়, এ রোজা আমাদের হাতের রোজা, আমাদের পায়ের রোজা, আমাদের চোখের রোজা, আমাদের রক্তের রোজা, আমাদের জিহ্বার রোজা, এ রোজা আমাদের কান ও অন্তরের রোজা। এক কথায় রোজা আমাদের গোটা সত্তারই রোজা। এভাবে এক মাসের সিয়াম সাধনার অগ্নিপরীার ভিতর দিয়ে অস্তিত্বকে বাস্তব ও সত্য করে তোলে মানুষের জীবনে পবিত্র মাস রমজান। তাই রমজান মাস আসার সাথে সাথে বেহেশতকে সুসজ্জিত করা হয়। কোনো কোনো বর্ণনায় আছে, রমজানের জন্য বছরের প্রথম থেকে জান্নাতকে সুন্দরভাবে সাজানো হয়।
মাহে রমজানের আগমনে আল্লাহপাকের প থেকে রোজাদারদের ওপর মেঘবর্ষণের মতো রহমত নাজিল হতে থাকে এবং প্রকৃত রোজাদারের জন্য আল্লাহর প থেকে কয়েকটি পুরস্কার রয়েছে। বেহেশতের আটটি দরজা। এর মধ্যে একটির নাম রাইয়ান (তৃপ্তি)। এই দরজা দিয়ে বেহেশতে প্রবেশ করার সৌভাগ্য লাভ করবেন শুধু রোজাদাররা। প্রত্যেক রোজাদারের জন্য একটি আনন্দ রয়েছে। একটি ইফতারের সময় এবং অপরটি হলো আল্লাহপাকের দিদার লাভ। রোজাদারের পূর্ববর্তী সব গোনা মাফ হয়ে যায়। রোজাদারের নিদ্রা ও ইবাদত এবং তার পে চুপ থাকা তসবিহস্বরূপ গণ্য হবে।
হজরত সালমান ফারসি (রা) থেকে বর্ণিত যে, মহানবী (সা) শাবান মাসের শেষ তারিখে আমাদের নসিহত করেছেন যে, তোমাদের মাঝে মোবারক মাস রমজান ছায়াস্বরূপ আসছে, যার মধ্যে লাইলাতুল কদর নামে একটি রাত আছে যা হাজার মাস থেকে উত্তম। আল্লাহতাআলা তোমাদের উপর রোজা ফরজ করেছেন এবং রাত্রি জাগরণ অর্থাৎ তারাবিহ পড়াকে তোমাদের জন্য পুণ্যের কাজ করে দিয়েছেন। যে ব্যক্তি এ মাসে নফল আদায় করল সে যেন রমজানের বাইরে একটি ফরজ আদায় করল; যে ব্যক্তি এ মাসে একটি ফরজ আদায় করল সে যেন অন্য মাসে সত্তরটি ফরজ আদায় করল। নবী করিম (সা) আরো বলেন, এটা সবরের মাস এবং সবরের বিনিময়ে আল্লাহপাক জান্নাত রেখেছেন। এ মাসে মুমিন বান্দাদের রিজিক বৃদ্ধি করে দেওয়া হয়।
যে ব্যক্তি এ মাসে আপন গোলাম ও মজদুর থেকে কাজের বোঝা হালকা করে দেন আল্লাহপাক তাকে মা করে দেবেন এবং জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তি দান করবেন। যে ব্যক্তি এ রকম পানি পান করাবে আল্লাহপাক কিয়ামতের দিন তাকে হাওজে কাওসার থেকে এ রকম পানি পান করাবেন। তারপর থেকে বেহেশতে প্রবেশ পর্যন্ত আর পানির কোনো পিপাসা হবে না। হজরত আবু সায়িদ খুদরি (রা) থেকে বর্ণিত হুজুর (সা) বলেন যে, রমজানের প্রতিটি দিবারাত্রিতে আল্লাহর দরবারে দোজখ থেকে অসংখ্য কয়েদিকে মুক্তি দেওয়া হয় এবং প্রত্যেক মুসলমানের দিবা ও রাত্রে একটি করে দোয়া কবুল হয়। হজরত আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত প্রিয় নবী (সা) বলেন যে, ব্যক্তি বিনা ওজরে ইচ্ছাপূর্বক রমজানের একটি রোজা ভঙ্গ করেছে, অন্য সময়ের সারা জীবনের রোজা ওই মাসের রোজার সমক হবে না। অতএব দেখুন, মাহে রমজানের একটি রোজা কতই না মূল্যবান।
আমরা মুসলিম উম্মাহ অত্যন্ত উৎসাহ-উদ্দীপনার সাথে রোজা পালন করে থাকি। অর্থাৎ যথারীতি পানাহার ও জৈবিক লালসা চরিতার্থ করা থেকে বিরত থাকি। কিন্তু সর্বণের জন্য যা হারাম ও অবৈধ, যার পংকিলতা থেকে মুক্তিদান করাই রোজার এই মহান প্রশিণ, তা আমরা মোটেই পরিত্যাগ করতে পারি না। রোজার প্রকৃত উপকারিতা পেতে হলে মিথ্যা বলা, গিবত, কুদৃষ্টি, হারাম উপার্জন, অশ্লীল গানবাজনাসহ যাবতীয় গোনাহ থেকে বিরত থাকতে হবে।
হযরত উসমান (রা) থেকে বর্ণিত নবী করিম (সা) বলেন, তোমাদের মধ্যে ওই ব্যক্তি সর্বশ্রেষ্ঠ যিনি কোরআন শরিফ নিজে শিখেছেন এবং অপরকে আল কোরআনের শিা দিয়েছেন। অতএব রমজান মাস কোরআন নাজিলের মাস আর জিকিরের মধ্যে সর্বোত্তম জিকির হলো কোরআন তিলাওয়াত। আল্লাহপাক যেন আমাদের সুষ্ঠুভাবে রোজার পূর্ণাঙ্গ হক আদায়সহ রোজা রাখার তৌফিক দান করেন। আমিন।
লেখক : ধর্ম বিষয়ে লেখালেখি করেন
e-mail:[email protected]