টিপাইমুখ থেকে কলকাতা ফিরে: ভারতের বহুল আলোচিত টিপাইমুখ জলবিদ্যুৎ প্রকল্পকে প্রয়োজনে বুকের রক্ত দিয়ে ঠেকানো হবে বলে ঘোষণা দিয়েছে মনিপুরের আদিবাসীদের একটি ছাত্র সংগঠন ‘এইচএসএ’।
মার স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের (এইচএসএ) টিপাইমুখ ইউনিটের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি রিঙ্গা খাবরু প্রস্তাবিত টিপাইমুখ বাঁধ এলাকায় দাঁড়িয়ে বাংলানিউজের এই প্রতিনিধির কাছে এ মন্তব্য করেন।
মণিপুরসহ মিজোরম ও নাগাল্যান্ড এলাকায় বসবাসকারী অন্যতম প্রধান আদিবাসী মার (ইংরেজিতে এইচ-এম-এ-আর দিয়ে মার লেখা হয়)। এদের প্রধান সংগঠন মার পিপলস কনভেনশন (ডেমোক্রাটিক)। সেই সংগঠনের ছাত্র শাখা এইচএসএ।
টিপাইমুখ এলাকায় বাঁধ বিষয়ক যেকোনও ধরনের মন্তব্য ও কথাবার্তা বলার একমাত্র অধিকার এই ছাত্র সংগঠনটি নিয়ে রেখেছে। বাঁধ সম্পর্কিত ব্যাপারে জানতে বাইরের কেউ সেখানে গেলে এইচএসএ’র মাধ্যমেই কথা বলতে হয় বলেও স্থানীয়রা জানান।
টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে কথা বলতে গেলে এইচএসএ’র ভারপ্রাপ্ত সভাপতি রিঙ্গা খাবরুর আচরণে বাঁধ নিয়ে বেশ রক্ষণশীলতাই প্রকাশ পেল।
মার উপজাতির মানুষ হলেও স্পষ্ট ও সাবলীল ইংরেজিতে কথা বলেন তিনি। মেঘালয়ের শিলংয়ের খ্রিস্টান মিশনারি স্কুল ও কলেজে লেখাপড়া করা রিঙ্গা এখন নিজ এলাকায় ‘মানুষদের উন্নয়নে’ সংগঠন করছেন বলে জানান।
বাঁধ নিয়ে কথা বলার আগে ওই এলাকা ঘুরে দেখার প্রস্তাব দেন রিঙ্গা। এইচএসএ’র স্থানীয় কয়েকজন নেতাকর্মীকে সঙ্গে প্রায় ঘণ্টা চারেক কয়েকটি পাহাড় ঘুরে দেখান তিনি। সবশেষে নৌকায় চড়ে বরাক নদীতে বাঁধের স্থানে নিয়ে যান।
মণিপুরের চুরাচান্দপুর জেলার সেনবুম ও সিপিইকোন এলাকা সংলগ্ন টিপাইমুখ এলাকার প্রায় ৫ হাজারের মতো আদিবাসীর বাস। এরা সবাই মার উপজাতির। তবে পাশ্ববর্তী মিজোরামের কিছু এলাকায় মিজো উপজাতির কিছু মানুষও রয়েছেন।
এলাকাটি ঘুরে দেখার সময় রিঙ্গা খাবরু মন্তব্য করেন, ‘এখানে কিসের বাঁধ হবে! কে করবে?’
কিছুটা উত্তেজিত হয়ে তিনি বলেন, ‘যেকোনও মূল্যেই টিপাইমুখ বাঁধ ঠেকানো হবে। ’
রিঙ্গা বলেন, ‘টিপাইমুখ এলাকার আদিবাসী জনবসতি বাঁধ হলে কোথায় যাবে, তারা সব হারাবে। ’
তিনি বলেন, ‘এই এলাকার পাহাড়কে ঘিরেই আমাদের বসবাস, খাদ্য সংগ্রহ, জীবিকা চলে। ’
বাঁধ হলে প্রায় ২৩ হাজার হেক্টর এলাকার বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হবে এবং পাহাড়গুলোর চূড়ার কাছাকাছি পর্যন্ত পানিতে ডুবে যাবে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘পুনর্বাসন করার তো প্রশ্নই উঠে না, আমরা এখানে বংশপরম্পরায় বাস করছি। এই এলাকা ছেড়ে কোথায় যাবো। ’
রিঙ্গা বলেন, ‘আমরা উদ্বাস্তু হয়ে কোথাও যাবো না। কারণ যেখানেই যাবো, সেখানে আমরা ভূমিপুত্র (খিলোঞ্জিয়া) মর্যাদা হারাবো। ’
টিপাইমুখ বাঁধ তৈরি করার পদক্ষেপ থেকে ফিরে যেতে মণিপুর রাজ্য সরকার ও ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতি তাদের আগের জানানো আহ্বানের কথা বাংলানিউজের কাছে পুনর্ব্যক্ত করেন রিঙ্গা।
‘মণিপুরের মানুষ বিরোধিতা করছে, কিন্তু রাজ্য সরকার কেন তা শুনছে না’ এ প্রশ্নের জবাবে রিঙ্গা বলেন, ‘মণিপুর রাজ্য সরকার তো মণিপুর উপজাতির মানুষের সরকার। সেখানে আমাদের (মার) কথা কে বলবে?’
তিনি বলেন, ‘টিপাইমুখ বাঁধের একটি পাথরও আমরা ফেলতে দেবো না, প্রয়োজনে বুকের রক্ত দিয়ে মার’রা এটা ঠেকাবে। ’
‘কেউই এখানে বাঁধ নির্মাণ করতে আসতে পারবে না’ বলেও মন্তব্য করেন এইচএসএ’র এই নেতা।
রিঙ্গা খাবরু কথা প্রসঙ্গে আরও জানান, মনিপুর ও মিজোরামে বসবাসকারী মার উপজাতিদের জন্য আলাদা রাজ্য গঠনের দাবি করে আসছেন তারা। এইচপিসি-ডি তাদের সঙ্গে একমত। এই দাবিতে তারা দীর্ঘদিন সশস্ত্র সংগ্রাম করে আসছে।
তাদের প্রস্তাবিত রাজ্যটির নাম ‘মাররাম’। মিজোরামের মিজো উপজাতিদের মতো তারা এ নাম নিয়েছে।
অবশ্য মনিপুরের মারদের প্রধান সংগঠন এইচপিসি-ডি সরকারের সঙ্গে শান্তি আলোচনার জন্য গত বছর থেকে অবশ্য অস্ত্র সম্বরণ করেছে।
রিঙ্গা খাবরু টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান সম্পর্কে বাংলানিউজের এ প্রতিবেদকের কাছে জানতে চেয়ে বলেন, ‘২০০৯ সালে বাংলাদেশ থেকে কারা যেন আসবে শুনেছিলাম। হেলিকপ্টার নিয়ে তারা আসে, কিন্তু এখানে নামতে পারেনি। ’
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের কিছুই করতে হবে না, আমরাই এখানে বাঁধ ঠেকাবো। ’
টিপাইমুখ প্রকল্প বাস্তবায়নের আগে যৌথ সমীক্ষার জন্য বাংলাদেশের প্রস্তাবে নয়াদিল্লির সম্মতির কথা জানালে রিঙ্গা বলেন, ‘সমীক্ষা করে কী হবে, আর কারা সমীক্ষা করতে আসে সেটা পরে দেখা যাবে!’
এ ব্যাপারে আরও কয়েকটি প্রশ্ন করলে তার উত্তর দেননি রিঙ্গা খাবরু
বাংলাদেশ সময়: ১৬১৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০৬, ২০১২