টিপাইমুখ থেকে কলকাতা ফিরে: ভারতের বহুল আলোচিত প্রস্তাবিত টিপাইমুখ বাঁধ প্রকল্প ঘেঁষা বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা পালন করছে উগ্রপন্থী সংগঠনের সদস্যরা।
ভারতের মণিপুর রাজ্যে বিভিন্ন দাবিতে কয়েকটি জঙ্গি সংগঠন সক্রিয় থাকলেও ‘মার পিপলস কনভেনশন-ডেমোক্রাটিক’ (এইচপিসি-ডি) সেখানকার সবচেয়ে প্রভাবশালী একটি উগ্রপন্থী সংগঠন।
মণিপুরের জিরিবাম, সেনবুম ও চুরাচান্দপুর জেলার বিভিন্ন দুর্গম ও পাহাড়ি এলাকা কয়েকদিন ধরে ঘুরে এসব তথ্য জানা গেছে।
এইচপিসি-ডি বরাক নদীতে বাঁধ হতে দিতে চায় না। যেকোনওভাবে টিপাইমুখ প্রকল্প করতে না দিতে তারা একাধিকবার অঙ্গীকার করেছে বলেও জানা যায়।
আসামের শিলচর থেকে টিপাইমুখের প্রায় দেড়শ’ কিলোমিটার পথের প্রথম ৫০ কিলোমিটারের পর থেকেই রয়েছে এইচপিসি-ডি’র তৎপরতা।
একইপথে ভারতীয় সেনাবাহিনী, মণিপুরের পুলিশ ও বনবিভাগের চেকপোস্ট রয়েছে। তারা নৌকায় এসে তাদের মতো করে তল্লাশি ও খোঁজখবর নেয়। তবে জাকুরাডহর পেরোলেই যেন অন্যরাজ্য।
মণিপুরের জিরিবাম মহাকুমার জাকুরাডহরের পর উগ্রপন্থা নিয়ে লুকোছাপার কোনও বালাই নেই। এখানে সবকিছু চলে এইচপিসি-ডি’র দাপটে। সরকারের সঙ্গে শান্তি আলোচনার জন্য অস্ত্রসম্বরণে রয়েছে আদিবাসীদের সংগঠনটি। তবে এরপরও তারা তাদের উপস্থিতির জানান দিতে পিছপা হয় না।
দুর্গম মণিপুর রাজ্যের একটি বড় অংশের যোগাযোগ ও বাণিজ্যের মাধ্যম হলো বরাক নদী। আসামের শিলচর থেকে সরাসরি এসব নৌ-বাণিজ্য হয়। টিপাইমুখ বন্দরই এইসব নৌকার শেষ গন্তব্য।
মণিপুর রাজ্যের লাগোয়া আসাম রাজ্যের কাছাড় জেলার ফুলেরতল বন্দর হলো মণিপুর ও আসামের একটি মিলনস্থল। ফুলেরতল বাজারের পাইকারি ব্যবসায়ী প্রদীপ পাল। নিজের দোকানে বসেই কথা বলেন বাংলানিউজের সঙ্গে। তিনি বলেন, টিপাইমুখ এলাকাসহ চুরাচান্দপুর জেলার প্রায় পুরোটাই এমনকি মনিপুরের প্রায় এক তৃতীয়াংশ মানুষের নিত্যপণ্যের চাহিদার যোগান যায় এই ফুলেরতল বন্দর থেকে। ফুলেরতল বাঙালি অধ্যুষিত এলাকা হলেও সেখানে মারভাষীদেরই প্রাধ্যান্য।
এসব বাণিজ্য হয় নৌপথেই। কারণ মণিপুরের ওই এলাকাগুলোর সঙ্গে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা খুবই নাজুক। খাড়া পাহাড়ের চুড়া ছুঁয়ে দুর্গম ওই রাস্তায় ছোট জিপগাড়ি ছাড়া আর কিছুই চলতে পারে না। তারও মাঝেমধ্যেই গাড়িগুলো গর্তে আটকে যায়, নিচে গিরিখাতে পড়ে যাওয়ার ভয় তো রয়েছেই!
আসাম থেকে বিভিন্ন পণ্য নৌকায় টিপাইমুখ ও এর আশেপাশের পাহাড়ি এলাকায় নিয়ে যাওয়ার পর মাথায় করে তা আরও ২০ থেকে ৫০ কিলোমিটার দূরে নিয়ে যাওয়া হয় বলেও ফুলেরতলের ব্যবসায়ীরা জানান।
যেহেতু বরাক নদীই টিপাইমুখসহ ওই এলাকায় যাওয়ার সবচেয়ে সহজসাধ্য পথ; তাই এই নদীর ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করাই মার উগ্রপন্থী এইচপিসি-ডিসহ অন্য উগ্রপন্থীদের একমাত্র লক্ষ্য।
বরাক নদী মণিপুর রাজ্যে প্রবেশ করে ফুলেরতল থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে। সেখানে জিরি নামে একটি নদী আসাম ও মণিপুরকে বিভক্ত করেছে। এই জিরিমুখ নামক স্থানে ভারতীয় সেনাবাহিনীর একটি ক্যাম্প রয়েছে।
জিরিমুখ থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার যাওয়ার পর জাকুরাডহরে রয়েছে মণিপুর রাজ্যপুলিশের নৌ ইউনিটের ক্যাম্প। সেখানে নৌকায় বসেই মণিপুর পুলিশের চেকপোস্টে বরাক নদীতে চলাচলকারী নৌকার হিসাব রাখা হয়। যা নৌকায় বসে একজন পুলিশ কর্তা খাতায় লিপিবদ্ধ করেন।
ভারতীয় সেনাবাহিনী ও মনিপুর রাজ্য পুলিশের নৌ ইউনিটের সঙ্গে সাক্ষাতের পর টিপাইমুখ পর্যন্ত নৌপথে আর কোনও বৈধ অস্ত্রধারীর দেখা পাওয়া যায় না। অন্তত সাতদিন ধরে দিনরাত্রি ওই এলাকাগুলোতে থেকে তাই জানা গেছে।
উগ্রপন্থী এইচপিসি-ডি’র চেকপোস্ট:
জাকুরাডহর পার হওয়ার পর প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে রয়েছে উগ্রপন্থী এইচপিসি-ডি’র চেকপোস্ট। এই এলাকাটির নাম কচুরবালি।
নদীতীরের পাহাড়ের ঢালে পতপত করে ওড়ে তিনরঙা এইচপিসি-ডি’র নিজস্ব পতাকা। পতাকার উপরে সবুজ ও নিচে গেরুয়া রং। মাঝের সাদা অংশটির মধ্যে একটি তারকা চিহ্ন। এই পতাকার পাশেই একটি চালাঘর রয়েছে।
বরাকে চলাচলকারী যেকোনও ধরনের নৌকারই এই চেকপোস্টে থামা ‘বাধ্যতামূলক’। বরাকের এই অংশটি দিয়ে ইঞ্জিনচালিত বড় নৌকা, হাতে ঠেলা ছোট নৌকা বা মৎস্যজীবীদের নৌকা মিলিয়ে প্রায় ৫০টি নৌকা প্রতিদিন চলাচল করে।
বরাক দিয়ে আসাম থেকে টিপাইমুখ পর্যন্ত চলাচলকারী বড় ইঞ্জিন নৌকার জন্য ভারত সরকারের কোনও লাইসেন্স নিতে হয় না, বা প্রয়োজেও পড়ে না। এইচপিসি-ডি’র দেওয়া ‘লাইসেন্স’ ছাড়া কোনও নৌকা ওই নদীতে চলতে পারে না। ‘লাইসেন্স’ হিসেবে তারা আট ইঞ্চি বাই আট ইঞ্চি আকারের টিনের ওপর হাতে লেখা একটি নম্বর দেয়। যা নৌকার সামনে সেঁটে দিতে হয়।
বরাকে বড় নৌকা চলতে বছরে এইচপিসি-ডিকে ২ হাজার টাকা (ভারতীয় মুদ্রায়) দিতে হয়।
বাৎসরিক এই ফি ছাড়াও প্রতিবার যাতায়াতে কচুরবালি চেকপোস্টে একটি নির্দিষ্ট অর্থ আদায় করে এইচপিসি-ডি।
শুধু নৌকার জন্য ১০ টাকা। এছাড়া যাত্রী ও মালের জন্য আলাদা হিসাব। যেমন এক বস্তা মালের জন্য একশ থেকে আড়াইশ’ টাকা। পণ্যের ধরণ অনুযায়ী এই হার ওঠানামা করে। এছাড়া উজানের পাহাড় থেকে কাটা বাঁশ ভাসিয়ে ভাটিতে নেমে যেতেও দিতে হয় অর্থ।
কচুরবালিতে যাওয়ার পর নৌকার চালকরা নিজেরাই ওই ঘাটে নৌকা ভিড়িয়ে দেন। হাতে টাকা নিয়ে তারা পাহাড়ের ঢালে থাকা এইচপিসি-ডি’র চেকপোস্টে গিয়ে ‘নাম লিখিয়ে’ আনেন। এরপর চালক ফিরে আসে, সঙ্গে আসেন একজন এইচপিসি-ডি’র উগ্রপন্থী। তার হাতে স্বাভাবিকভাবেই থাকে একটি একে-৪৭! এটি দেখে আতঙ্কিত হওয়ার কোনও কারণ নেই! কারণ তারা এখন ‘সিজ ফায়ারে’ আছেন, জানালেন একজন নিত্যযাত্রী।
ওই ব্যক্তি নৌকায় এসে বস্তা বা ব্যাগে তল্লাশি চালান। যাত্রীদের ব্যাগ খুলে তাকে দেখাতে হয়। এছাড়া বস্তার ভেতর কি আছে তা তিনি বেশ কিছু সময় ধরে পরখ করে দেখেন। এরপর টাকা-পয়সার বনিবনা করে নৌকা ছেড়ে যাওয়ার নির্দেশ দেন।
বরাকে চলাচলকারী একটি ইঞ্জিন চালিত নৌকার মালিক নাম না প্রকাশের শর্তে বাংলানিউজকে জানান, উগ্রপন্থীদের এই অর্থ আদায় নিয়ে তাদের কোনও ভয় নেই। তারা খুশি হয়েই এটা দেন!
ওই নৌকা মালিক আরও বলেন, ‘তিন চার বছর আগে, জাকুরাডহর থেকে উজানে যেতে কোনও নিশ্চয়তা ছিল না। জীবন বাজি রেখে যেতে হতো। এখন ওদের জন্য আমরা অনেকটাই নিশ্চিন্ত। ’
জাকুরাডহর থেকে টিপাইমুখ এলাকা পর্যন্ত উঁচু খাড়া পাহাড়ের বিভিন্ন এলাকাতেই ইংরেজি বড় অক্ষরে রঙ দিয়ে হাতে লেখা ‘এইচপিসি-ডি’ চোখে পড়ে।
উগ্রপন্থীদের উপদলীয় বিচরণ:
বরাকে চলাচলকারী নৌকার মালিক ও চালকসহ যাত্রীরা এইচপিসি-ডি’র হাত থেকে এখন খুববেশি আতঙ্কিত না থাকলেও ছোটখাটো উগ্রপন্থী উপদলীয় গোষ্ঠী মাঝেমধ্যেই অশান্তির কারণ ঘটায়। এই উগপন্থীদের আচরণ অনেকটা বাংলাদেশের সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর মতো; যারা অনেক সময় চাঁদাবাজ, অনেক সময় ডাকাত বা কখনও দস্যুদের মতো আচরণ করে।
বাংলানিউজের টিপাইমুখ যাত্রাকালে এধরনের কয়েকটি ‘ছোট’ উগ্রপন্থী গোষ্ঠীর মুখোমুখি হওয়ার অভিজ্ঞতা হয়। স্থানীয়ভাবেই এদের ‘নানাভাবে ম্যানেজ’ করতে হয়। এসব ম্যানেজ করার ঘটনা নিজের চোখে দেখলে শরীরে হিম ধরে যাওয়া অস্বাভাবিক নয়!
এসব ছোট গোষ্ঠীরও দাবি দাওয়া থাকে। তারা নৌকার মাল ও যাত্রীরা কোথায় যাচ্ছে, কেন যাচ্ছে এসব প্রশ্ন করতে থাকে।
ছোট গোষ্ঠীদের এসব দাবি দাওয়া মেটাতে কখনও ৬ থেকে ৭ ঘণ্টাও লেগে যায়। তারা কিছুতেই থামতে চায় না, কিছু শুনতে চায় না; কারণ এরা মদের নেশায় চুর হয়ে থাকতেই যে ভালোবাসে!
বরাকে টিপাইমুখ পর্যন্ত চলাচলকারী একটি নৌকার চালক জানালেন, ‘এই ছোট উগ্রপন্থীরা আবার এইচপিসি-ডির সদস্যদের ভয় পায়। এমনকি এইচপিসি-ডি বলে দিয়েছে, এই পথে কেউ যদি ঝামেলা করে তবে তাদের যেকোনওভাবে ধরে এনে কচুরবালি ক্যাম্পে যেন দিয়ে দেওয়া হয়। ’
ওই নৌকা চালক আরও বলেন, ‘কয়েক মাস আগে এ রকম কয়েকজনকে ধরে কচুরবালি নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু পরে ওদের ভাগ্যের কথা শুনে এখন আর কচুরবালি নিয়ে যেতে ইচ্ছা হয় না। কারণ ছোট উগ্রপন্থী হলেও ওরাও তো মানুষ। তাই স্থানীয়ভাবেই ওদের দাবিদাওয়া মিটিয়ে দিই। ’
বাংলাদেশ সময়: ১৭০০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০৯, ২০১২