দমনমূলক নীতি ও বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের ওপর নানামুখী নির্যাতনের বিরুদ্ধে আত্মরক্ষামূলক প্রতিরোধ গড়তে আওয়ামী লীগের গত আমলের শেষ ভাগে জামায়াত, এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি (জাপা) ও ইসলামী ঐক্যজোটকে নিয়ে চার দলীয় ঐক্যজোট গড়ে বিএনপি। পরবর্তীতে ইসলামী ঐক্যজোট থেকে বেরিয়ে খেলাফত মজলিস এ জোটে থেকে গেলেও বেরিয়ে যান এরশাদ।
ঢাকা: আগামী ১২ মার্চের মধ্যে জোট সম্প্রসারণের কাজ চূড়ান্ত করার কথা থাকলেও আপাতত এ ব্যাপারে ভাবছেন না জোট নেতা ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। চলমান আন্দোলনের পাশাপাশি তত্ত্বাবধায়ক ইস্যুতে সরকারের সঙ্গে সমঝোতার পথেই হাঁটছেন তিনি।
সম্প্রতিককালের রাজনৈতিক ঘটনা প্রবাহে দেখা যায়, রাজপথের আন্দোলনে সহায়ক শক্তি হিসেবে চার দলীয় জোট শরিকদের পাশাপাশি সমমনা ছোট ছোট রাজনৈতিক দলকে সঙ্গে নিয়ে চারটি সফল রোডমার্চ করেন খালেদা জিয়া।
সূত্রমতে, এসব সফল রোডমার্চের পর খালেদা জিয়া ভেবেছিলেন ১২ মার্চের ‘চল চল ঢাকা চল’ (মহাসমাবেশ) কর্মসূচির আগেই তত্ত্বাবধায়ক ইস্যুতে সরকারের পক্ষ থেকে আলোচনার প্রস্তাব আসবে। সেই আলোচনায় যাওয়ার আগে নিজেদের অবস্থান আরও সুদৃঢ় করতে জোট সম্প্রসারণের কাজ চূড়ান্ত করবেন তিনি।
কিন্তু, তত্ত্বাবধায়ক ইস্যুতে আলোচনার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে কোনো প্রস্তাব না আসায় ও বিরোধী দলের আন্দোলনের ব্যাপারে সরকারের অবস্থান আরও কঠোর হওয়ায় জোট সম্প্রসারণের চিন্তা বাদ দিয়ে আত্মরক্ষামূলক ব্যবস্থা হিসেবে সরকারের সঙ্গে সমঝোতার কথাই ভাবছেন খালেদা।
চারদলীয় জোট ও সমমনা দলের একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, খালেদা জিয়া এই মুহূর্তে মনে করছেন- টু-থার্ড মেজরিটি নিয়ে ক্ষমতায় থাকা মহাজোট সরকারের বিরুদ্ধে তত্ত্বাবধায়ক ইস্যুতে আন্দোলন করে কোনো ফল হবে না। ঐতিহ্য অনুয়ায়ী যেভাবেই হোক দলীয় সরকারের অধীনেই নির্বাচনের দিকে এগুবে আওয়ামী লীগ।
সেক্ষেত্রে তত্ত্বাবধায়ক না হোক অন্য কোনো ফরমেটে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের ব্যাপারে আওয়ামী লীগকে রাজি করানো যায় কি না সেটিই ভাবছেন খালেদা জিয়া।
সম্প্রতি ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের বার্ষিক কাউন্সিল ও চাঁদপুরে আয়োজিত জসভায় ‘তত্ত্বাবধায়ক না হোক ভিন্ন কোনো নামে হলেও নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের’ আহ্বান জানান খালেদা জিয়া।
খালেদা জিয়ার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বিভিন্ন সভা সেমিনারে একই ভাষায় কথা বলছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
সূত্র জানায়, যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে রাজপথে আন্দোলনের জন্য জোট সম্প্রসারণের ব্যাপারে সমমনাদের সঙ্গে ঐকমত্যে পৌছেছিলেন সেটি আর এখন মুখ্য বিষয় হয়ে থাকছে না খালেদা জিয়ার কাছে। বরং কিভাবে আগামী নির্বাচনটি নির্দলীয় সরকারের অধীনে আদায় করা যায় সেটি নিয়েই ভাবছেন তিনি।
এদিকে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের পাঁচজন করে প্রতিনিধি নিয়ে ১০ সদস্য’র একটি অন্তবর্তীকালীন সরকার গঠনের কথাও শোনা যাচ্ছে রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে।
সূত্রের দাবি, সংসদে গিয়ে অন্তঃবর্তীকালীন সরকারের বিল উত্থাপনে সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর আহ্বানের বিষয়টিও বিবেচনায় রেখেছে বিএনপি। এ পরিস্থিতিতে জোট সম্প্রসারণের মতো কোনো প্যাকেজ কর্মসূচি হাতে নিয়ে বাড়তি ঝামেলা পোহাতে রাজি নন খালেদা জিয়া।
এদিকে নতুন জোটের নাম নিয়েও কিছু ঝামেলার কথা শোনা যাচ্ছে।
সূত্রমতে, জাতীয়তাবাদ ও ইসলামী মূল্যবোধ’র শ্লোগান নিয়ে চারদলীয় জোট গঠন করা হলে সম্প্রসারিত জোটের নাম ‘জাতীয়’ শব্দ দিয়ে শুরু করতে চান বেশির ভাগ ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল। অন্যদিকে খালেদা জিয়ার পছন্দ ‘জাতীয়তাবাদ’ শব্দটি।
কিন্তু, টেকনিক্যাল কারণেই জাতীয়তাবাদ ও জাতীয় শব্দ দু’টি একই সঙ্গে পাশাপাশি রাখা সম্ভব হচ্ছে না। এ দু’টি শব্দের মধ্যে একটিকেই বেছে নিতে হবে নতুন জোটের নামে হিসেবে।
সূত্রমতে, এতগুলো বিষয় নিয়ে এই মুহূর্তে না ভেবে তত্ত্বাবধায়ক ইস্যুতে সরকারের সঙ্গে সমঝোতা করা যায় কি না সে বিষয়টি নিয়েই ভাবছেন খালেদা জিয়া।
অবশ্য এরই মধ্যে নতুন জোটে আসতে আগ্রহী লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি এলডিপি (অলি আহমেদ বীর বিক্রম, অধ্যাপিকা জাহানারা বেগম), বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি (সৈয়দ মুহাম্মদ ইব্রাহিম বীর প্রতীক, আব্দুল মালেক চৌধুরী), জাগপা (শফিউল আলম প্রধান, খন্দকার লুৎফর রহমান), এনপিপি (শেখ শওকত হোসেন নীলু, ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদ), বাংলাদেশ ন্যাপ (জেবেল রহমান গানি, এম গোলাম মোস্তফা ভুইয়া), জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ (শায়েখ আব্দুল মবিন, মুফতি মুহাম্মদ ওয়াক্কাস), এনডিপি (খন্দকার গোলাম মোর্ত্তজা, আলমগীর মজুমদার), বাংলাদেশ লেবার পার্টি (ডা. মোস্তাফিজুর রহমান ইরান, হামদুল্লাহ আল মেহেদী), বাংলাদেশ মুসলিম লীগ (এএইচএম কামরুজ্জামান খান, আতিকুল ইসলাম), বাংলাদেশ ইসলামিক পার্টি (অ্যাডভোকেট আব্দুল মবিন, এম এ রশিদ প্রধান) ও ন্যাপ ভাসানী (শেখ আনোয়ারুল হক, হাসরত খান ভাসানী) জোট সম্প্রসারণের আশা ছেড়ে দিয়েছেন।
এলডিপির এক শীর্ষ নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলানিউজকে বলেন, ‘আমরা মোটামুটি নিশ্চত হয়ে গেছি খালেদা জিয়া জোট সম্প্রসারণ করবেন না। কেবল মুলা ঝুলিয়ে রাখবেন। আমরাও আপাতত জোট সম্প্রসারণ নিয়ে ভাবছি না। সরকারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ইস্যুতে নিজেদের মতো আন্দোলন করে যাব। ’
ইসলামী ঐক্যজোটের মহাসচিব আব্দুল লতিফ নেজামী বাংলানিউজকে বলেন, ‘১২ মার্চের আগেই জোট সম্প্রসারণের ব্যাপারে একটি ঐকমত্যে পৌঁছেছিলাম আমরা। কিন্তু ২২ জানুয়ারি মিটিংয়ের পর এ ব্যাপারে আমাদের সঙ্গে আর কোনো আলাপ হয়নি। দেখা যাক তারা কি করে। ’
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বাংলানিউজকে বলেন, ‘আমাদের মূল লক্ষ্য ছিল তত্ত্বাবধায়ক পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন আদায়। এ জন্যই সকল দলকে সঙ্গে নিয়ে আন্দোলনের কথা বলেছিলেন খালেদা জিয়া। ’
সরকারের সঙ্গে সমঝোতা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘বৃহত্তর স্বার্থে যে কোনো বিষয় নিয়ে সরকারের সঙ্গে আলোচনা হতে পারে। কিন্তু রাজপথের চলমান আন্দোলন অব্যাহত থাকবে। ’
- জোট সম্প্রসারণ-১
অনিবন্ধিত ও নামসর্বস্ব দল নিয়েই এগুচ্ছেন খালেদা - জোট সম্প্রসারণ-২
খালেদার কালক্ষেপণে হতাশ সমমনারা
বাংলাদেশ সময়: ০৪১৩ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৬, ২০১২