ঢাকা: বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশে ‘ইউনিপেটুইউ’র বিভিন্ন ব্যাংকের লেনদেন স্থগিত করা হলেও বেনামে নতুন অ্যাকাউন্ট খুলে গ্রাহকদের সেখানে টাকা জমা দেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছে কোম্পানিটি। বেশি লাভের আশায় সহজ সরল গ্রাহকরা সে আহ্বানে সাড়া দিয়ে প্রতারিত হয়ে চলেছেন।
জানা গেছে, কেন্দ্রীয় পর্যায়ের অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ হওয়া এবং সুপ্রিম কোর্টের নিষেধাজ্ঞার কারণে প্রয়োজনীয় টাকা তুলতে ব্যর্থ হয়ে প্রতিষ্ঠানটি নতুন ফন্দি বের করে। তারা বিশ্বস্ত এজেন্টদের নামে বিভিন্ন ব্যাংকে পৃথক পৃথক অ্যাকাউন্ট খুলে সেগুলোর মাধ্যমে লেনদেন চালু রেখেছে এবং মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে।
আন্তর্জাতিক বাজারে স্বর্ণ ব্যবসা পরিচালনার কথা বলে মাল্টিলেবেল মার্কেটিংয়ের মাধ্যমে জনসাধারণের কাছ থেকে টাকা নেওয়া শুরু করে কোম্পানিটি।
বাংলানিউজ’র অনুসন্ধানে জানা গেছে, জনসাধারণের কাছ থেকে নেওয়া কোটি কোটি টাকা ব্যবসায় না খাটিয়ে দেশের ব্যাংকেই ফেলে রাখছে ইউনিপে-টুইউ। প্রতি মাসে সেখানে জমা পড়ছে ১৮ থেকে ২০ কোটি টাকা।
কেন্দ্রীয় অ্যাকাউন্টে জমা হওয়া এ টাকা থেকে প্রতি মাসে লাভের অংশ বাবদ তিন কোটি টাকা নতুন করে সদস্যদের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে।
ব্যবসায় মূলধন না খাটিয়েও লভ্যাংশ দেওয়ার নজিরবিহীন এ ঘটনাকে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা ‘অস্বাভাবিক’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ইউনিপে-টুইউ’র ঘোষিত ‘সিটি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট’টির লেনদেনের ওপর কড়া নজরদারি চলছে।
উল্লেখ্য, গত ১৩ মে থেকে ইউনিপে-টুইউ এবং ইউনিপে-টুইউ বাংলাদেশ লিমিটেড কোম্পানি ও এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক (১) মো. মুনতাসীর হোসেন, পিতা মো. মোস্তাফিজুর হোসেন, মাতা হাসিনা মোশাররফ (২) পরিচালক মো. মাসুদুর রহমান, পিতা মো. মাহবুবুর রহমান, মাতা মাজেরা বানু এবং (৩) পরিচালক মো. সাইদুজ্জামান, পিতা মো. হাজী আবুল মাজেদ, মাতা মৃত মেহেরুন্নেছা- এদের পরিচালিত সব ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করার নির্দেশ দেন বাংলাদেশ ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মানি লন্ডারিং বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, মানি লন্ডারিং আইন অমান্য করে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ও প্রতিষ্ঠানের কয়েকজন শীর্ষ কর্মকর্তা লেনদেন করছে- এ অভিযোগ পাওয়ার পরই এ ব্যবস্থা নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃপক্ষ।
তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের এ নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতের আশ্রয় নেয় প্রতিষ্ঠানটি। কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের রায়ের কারণে বাংলাদেশ থেকে টাকা পাচারের অভিযোগ থাকায় আরও বেশি বিপাকে পড়ে কোম্পানিটি।
প্রতি মাসে ইউনিপে-টুইউ কে তাদের অ্যাকাউন্ট থেকে সর্বোচ্চ তিন কোটি টাকা উত্তোলনের নির্দেশ দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্ট। শুধু গ্রাহকদের পাওনা মেটানোর জন্যই এ টাকা উত্তোলনের ক্ষমতা দেওয়া হয়।
দেখা গেছে, সিটি ব্যাংকের ওই অ্যাকাউন্ট থেকে মাত্র এক মাসেরও কম সময়ে জমা পড়ে ১৮ কোটি ২৭ লাখ ১৯ হাজার ১৬০ টাকা। তবে এখান থেকে তোলা হয়েছে মাত্র ১ কোটি ৩৩ লাখ ৪০ হাজার ৪ শ’ ২৪ টাকা। বাকি ১৬ কোটি ৯৩ লাখ ৭৮ হাজার ৭ শ’ ৩৬ টাকা মজুদ রয়েছে ব্যাংকেই।
বিনিয়োগের টাকা দেশের ব্যাংকেই পড়ে রয়েছে, অন্যদিকে স্বর্ণ রয়েছে বিদেশের ভল্টে- তাহলে ইউনিপে-টুইউ’র মুনাফা আসে কোত্থেকে? কীভাবে প্রতি মাসে তারা গ্রাহকদের দ্বিগুণ লাভ দিচ্ছেÑএ প্রশ্নের কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি কোম্পানির কর্মকর্তারা।
ইউনিপে-টুইউ, বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মুনতাসীর হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, ‘ইউনিপে-টুইউ’র কর্পোরেট অফিস কীভাবে লাভ করে তা আমি জানি না। আমি শুধু জানি, দেশের টাকা দেশেই থাকে, আর মানুষ লাভ পায়। কেউ প্রতারিত হয় না। ’
তিনি আরও বলেন, ‘তবে শুনেছি, তারা বাংলাদেশের ব্যাংকে সংরতি টাকার বিপরীতে বিদেশে ব্যাংক গ্যারান্টি দিয়ে স্বর্ণ ব্যবসা করে। ’
নতুন ফন্দিতে টাকা পাচার !
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কেন্দ্রীয় পর্যায়ের অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ হওয়া ও সুপ্রিম কোর্টের নিষেধাজ্ঞার কারণে প্রয়োজনীয় টাকা ওঠাতে ব্যর্থ হয়ে প্রতিষ্ঠানটি নতুন ফন্দি বের করে। তারা বিশ্বস্ত এজেন্টদের নামে পৃথক পৃথক ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলে সেগুলোর মাধ্যমে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ইউনপে-টুইউ’র সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এক সূত্র জানায়, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট সংক্রান্ত জটিলতা হওয়ার পর গত জুন মাস থেকেই এজেন্টদের নামে পৃথক পৃথক অ্যাকাউন্ট খোলার ব্যবস্থা করা হয়। এজেন্ট ও শাখা কর্মকর্তাদের মাধ্যমে তা জানিয়ে দেওয়া হয় হাজার হাজার গ্রাহক-সদস্যদের। তারা এখন ইউনিপে-টুইউ বাংলাদেশের সিটি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে টাকা জমা না করে এজেন্টদের অ্যাকাউন্টগুলোতে টাকা জমা করছেন।
রাজধানীতে ইউনিপে-টুইউ’র এজেন্টদের নামে ব্র্যাক ব্যাংক, সিটি ব্যাংক ও যমুনা ব্যাংকসহ অন্যান্য ব্যাংকে দেড় শতাধিক অ্যাকাউন্ট পরিচালিত হচ্ছে। ভিন্ন ভিন্ন নামের অ্যাকাউন্টগুলো থেকে প্রতি ইংরেজি মাসের ১২-১৫ তারিখের মধ্যে সব টাকা তুলে নেন প্রতিষ্ঠানটির মূল কর্মকর্তারা।
এদিকে পরিচালকদের অ্যাকাউন্টের ওপর নজরদারি থাকায় এখন বাংলাদেশের গ্রাহকদের কাছ থেকে টাকা সংগ্রহ ও তা ইউনিপ-টুইউ’র কর্পোরেট অফিস মালয়েশিয়ায় পাঠাতে শীর্ষ পর্যায়ের ২০ এজেন্টকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তারা এসব টাকার সিংহভাগই হুন্ডির মাধ্যমে পাঠানোর চেষ্টা করছে।
তবে এসব বেনামী অ্যাকাউন্টের ব্যাপারে কিছুই জানে না বাংলাদেশ ব্যাংকের মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ বিভাগ।
বাংলাদেশ সময় : ১৭৪৯ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৬, ২০১০