চট্টগ্রাম: ২০১৭ সালের ২ জুলাই নগরের এম এম আলী সড়কের একটি কমিউনিটি সেন্টারসংলগ্ন বড় নালায় পড়ে তলিয়ে যান শীলব্রত বড়ুয়া (৬২)। পরেরদিন প্রায় ছয় কিলোমিটার দূরে মিয়াখান নগরে চাক্তাই খালে তার মরদেহ পাওয়া হয়।
জানা যায়, ২০১৭ সালে নগরের জলাবদ্ধতা নিরসনে খাল পুনঃখনন এবং ড্রেনেজ ব্যবস্থা উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় ৩৬টি খাল পুনঃখনন ও সংস্কারে ৫ হাজার ৬১৬ কোটি টাকার প্রকল্প গ্রহণ করে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)। কয়েক দফা সময় বাড়ানোর পর ২০২৪ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে এ প্রকল্প শেষ হওয়ার কথা ছিল। গত বছরের নভেম্বরে প্রকল্প ব্যয় আরও ৩ হাজার ১০ কোটি টাকা বাড়ানো হয়। বর্তমানে ৮ হাজার ৬২৬ কোটি টাকার এ প্রকল্পের কাজ চলমান রয়েছে।
সিডিএ’র প্রধান প্রকৌশলী হাসান বিন শামস বাংলানিউজকে বলেন, জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের আওতায় ৩৬টি খালের মধ্যে ১৯টি খালের সম্পূর্ণ কাজ শেষ হয়েছে। বাকি খালগুলোর ৬০-৭০ শতাংশ কাজ হয়েছে। বিগত সরকারের কাছে আমরা কাজ চালিয়ে নিতে এক হাজার ৫০০ কোটি টাকা চেয়েছিলাম। কিন্তু সরকার আমাদের বলেছিল অর্ধেক টাকা ঋণ নিতে হবে। কিন্তু আমরা এই টাকা পাব কোথায়? এ জন্য হিজড়া খালে আমরা কাজ ধরতে পারিনি। অন্তর্বর্তী সরকার বাস্তব অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে ইতোমধ্যেই ৬৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। এখন হিজড়া খালসহ বাকি কাজগুলো করতে পারবো।
সূত্র জানায়, নগরের এক হাজার ৬০০ কিলোমিটারের নালা-নর্দমা আর খালের মধ্যে সিডিএ’র আওতায় রয়েছে ৩০০ কিলোমিটার। বাকিটা রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের।
শুক্রবার (১৮ এপ্রিল) সাত মাসের সেহেরিজ তার মা ও দাদির সঙ্গে কাপাসগোলার ফুফুর বাসায় যাচ্ছিল। রিকশায় করে যাওয়ার সময় সেটি হিজড়া খালে পড়ে গেলে সে নিখোঁজ হয়। সেহেরিজের মা-দাদিকে স্থানীয়রা খালে নেমে তাদের উদ্ধার করে। অথচ সেইদিন মাত্র ২ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছিল নগরে তাতেই খালের পানিতে ডুবে যায় সড়ক। এ খালেও সিডিএ’র ওই প্রকল্পের আওতায় কাজ চলছে। ওই খালের অস্থায়ী নিরাপত্তা বেষ্টনী হিসেবে বাঁশের ব্যারিকেড দেওয়া হয়। তবে প্রকল্পের কাজ করার জন্য বাঁশের ওই ব্যারিকেড খোলা হয়েছিল। শুধুমাত্র ২০২১ সালেই খাল ও নালায় পড়ে মারা যান ৫ জন। যার মধ্যে মুরাদপুর মোড়ে নালায় পা পিছলে তলিয়ে যাওয়া সবজি বিক্রেতা ছালেহ আহমেদের খোঁজ এখনও মেলেনি। ২০২২ সালে ষোলশহর এলাকায় শিশু কামাল নালায় পড়ে নিখোঁজ হয় এবং তিন দিন পর পাওয়া যায় তার মরদেহ। এরপর ২০২৩ সালের ৭ অগাস্ট নন্দীরহাট এলাকার বাদাম তল এলাকায় বৃষ্টির মধ্যে নালায় পড়ে মৃত্যু হয় কলেজ ছাত্রী নিপা পালিতের (২০)। একই বছর আগ্রাবাদের রঙ্গীপাড়ায় নালায় পড়ে নিখোঁজ হয় দেড় বছরের শিশু ইয়াছিন আরাফাত। ২০২৪ সালের ১১ জুন চাক্তাই খালের স্লুইস গেট এলাকায় এক শিশু নিখোঁজ হয়, ১৪ ঘণ্টা পর তার রাজাখালী খাল থেকে মরদেহ পাওয়া যায়।
প্রতিটি মৃত্যুর পর নগরবাসীর পক্ষ দাবি উঠে মৃত্যুফাঁদ হয়ে ওঠা এসব বিপৎজনক খাল ও নালাকে নিরাপদ করতে বেষ্টনী ও স্ল্যাপ দেওয়ার। তবে সেই দাবি কয়েকদিন পর চাপা পড়ে যায়। কাপাসগোলায় খালে পড়ে শিশু সেহরিজের মৃত্যুর পর নগরবাসীর সেই দাবি আবার ফিরে এসেছে, জানিয়েছেন ক্ষোভ।
ছালেহ আহমেদের নালায় তলিয়ে যাওয়ার ঘটনায় তৎকালীন মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের নির্দেশে গঠিত কমিটির তদন্তেও সিডিএ ও সিটি করপোরেশনকে দায়ী করা হয়েছিল।
চার বছর ধরে বাবা ছালেহ আহমদের মরদেহ খুঁজে বেড়াচ্ছেন ছেলে মহিম। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, ৪ বছর ধরে বাবার মরদেহের খোঁজে আছি। কিন্তু কেউ খোঁজ দিতে পারেনি। আমার বাবার কোনো কবর নেই, আমি এক দুর্ভাগা সন্তান। যাদের নগর দেখভালের কথা তাদের ব্যর্থতার জন্য এখনো নালায়-খালে পড়ে মানুষ মরছে।
তিনি আরও বলেন, আমার বাবা পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন। বাবাকে হারালেও কারও থেকে কোনো ক্ষতিপূরণ পাইনি। সিটি করপোরেশন থেকে একটা পেট্রোল পাম্পে শ্রমিকের কাজ দেওয়া হয়েছিল। আমি তাদের বলেছিলাম পড়ালেখা চালিয়ে নিতে অন্তত পিয়ন পদে হলেও নিয়োগ দিতে কিন্তু তারা দেয়নি। পরে পড়ালেখা চালিয়ে নিতে চাকরি ছেড়ে দেই। টিউশনি করে কোনোরকমে সংসার চালাচ্ছি।
শনিবার (১৯ এপ্রিল) চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, নগরের ৩৬টি খালে জলাবদ্ধতা প্রকল্পের কাজ করছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ। বাকি একটি খালে কাজ করছে চসিক। উন্মুক্ত নালায় রিটার্নিং ওয়াল তৈরির জন্য আমরা উদ্যোগ নিয়েছি। কাজ চলমান রয়েছে। শুক্রবার রাতে কাপাসগোলার যে স্থানে দুর্ঘটনা ঘটেছে সেখানে বাঁশ দিয়ে নিরাপত্তা বেষ্টনী তৈরি করে দিয়েছে সিটি করপোরেশন।
প্রাণহানি ঠেকাতে নগরের অরক্ষিত খাল-নালা ও ড্রেনের তথ্য চেয়ে গণবিজ্ঞপ্তি জারি করেছে চসিক। এজন্য নগরের ৪১ ওয়ার্ড তদারকির জন্য ৬ জন কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
মেয়র জানান, চসিক নগর পরিচ্ছন্ন রাখতে বিশেষ অভিযান শুরু করেছে। সিটি করপোরেশনের স্পেশাল ম্যাজিস্ট্রেট ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা নগরজুড়ে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছে।
তবে যথাযথ বর্জ্য ব্যবস্থাপনা গড়ে না তুললে এ জলাবদ্ধতা থেকে সহজেই মুক্তি মিলছে না নগরবাসীর। এক্ষেত্রে নগরবাসীর সচেতনাও জরুরি বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরামের সহ-সভাপতি স্থপতি সুভাষ বড়ুয়া বাংলানিউজকে বলেন, এতদিন ধরে নালা-খালে পড়ে মানুষের মৃত্যু হচ্ছে কিন্তু এর কোনো সমাধান যারা দায়িত্বে রয়েছেন তারা করতে পারেননি। আমরা অনেকবার এটা নিয়ে কথা বলেছি তারা কর্ণপাত করেননি। বিশ্বে যেকোনো কাজ করার আগে সেইফটি অ্যান্ড সিকিউরিটি দিকটি বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু এখানে প্রকল্পে একেবারেই সেগুলো বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। যার কারণ প্রকল্প পরিচালনায় কোনো যোগ্য লোক নিয়োগ দেওয়া হয়নি। ‘গবুচন্দ্র মন্ত্রী’র মতো কাজ করলে শুধু অর্থব্যয় হবে কোনো সুফল আসবে না।
তিনি আরও বলেন, আমাদের প্রায়োরিটি কি সেটা জানতে হবে। সঠিকভাবে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা না করলে জলাবদ্ধতা প্রকল্প যে কোনো কাজে আসবে না সেটা দেখতেই পারছেন। সামান্য বৃষ্টি হলেই পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে নগর। যতটুকু সামর্থ্য আছে সেটা নিয়েই পরিকল্পনা সাজাতে হবে।
বাংলাদেশ সময়: ১২৫৫ ঘণ্টা, এপ্রিল ২২, ২০২৫
পিডি/টিসি