চট্টগ্রাম: গাইনোকোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. রজত কুমার বিশ্বাস, ওটি থেকে চেম্বার ঘুরতেই কেটে যায় দিন-রাতের অধিকাংশ সময়। সুযোগ পেলে তিনি কণ্ঠে তুলে নেন রবি ঠাকুরের গান।
মনের গতিপথ পরিবর্তনে যখন ওষুধ কাজ করে না, তখন একটা মিষ্টি সুর ভুলিয়ে দিতে পারে সব কষ্ট- এ কথা বলছেন চিকিৎসকরাই। মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা মানসিক রোগীদের সুস্থ করতে ব্যবহার করেন মিউজিক থেরাপি।
পেশায় দন্ত চিকিৎসক ডা. মানস রঞ্জন চৌধুরী টেবিল টেনিসে জাতীয় চ্যাম্পিয়ন। বিখ্যাত গায়ক বাবা প্রয়াত প্রবাল চৌধুরীর মতো তিনিও মজেছেন গানের ভুবনে। বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বাংলাদেশ বেতারে তালিকাভুক্ত সংগীতশিল্পী হিসেবে অসংখ্য আধুনিক গানে নিজের অবস্থান তৈরি করেছেন দুই দশকের বেশি সময় ধরে। প্লে-ব্যাক সিঙ্গার হিসেবেও সুনাম কুড়িয়েছেন বাংলাদেশ টেলিভিশনের এই সংগীত পরিচালক।
গান লিখেছেন ডা. প্রণব কুমার চৌধুরী, ডা.গোলাম মোস্তফা, কণ্ঠে তুলেছেন সুর। সেতার বাদক ডা. অরুণ বিকাশ দে, ডা. মিজানুর রহমান আঞ্চলিক গানের শিল্পী। ডা. এম এ মতিন, ডা. ফারজানা বাশার ও ডা. রুপা দত্ত পছন্দ করেন গাইতে। এছাড়াও চট্টগ্রামে আরও কয়েকজন চিকিৎসক রয়েছেন যারা সংগীত শিল্পী হিসেবেও পরিচিত। অপারেশনের টেবিলে গান গেয়ে ভাইরাল হয়েছেন চিকিৎসক। ফেলে আসা করোনাকালে এই গানই জুগিয়েছিল তাঁদের মানসিক শক্তি।
সংগীতপ্রেমীদের কাছে গানের জন্য বিশেষ কোনো দিন না থাকলেও বিশেষভাবে উদযাপনের জন্য ২১ জুন বিশ্ব সংগীত দিবসের আবির্ভাব। বর্তমানে ১২০টিরও বেশি দেশে এই দিবস উদযাপিত হয় পৃথিবীতে শান্তি ও ইতিবাচক চিন্তা ছড়িয়ে দিতে।
বাংলাদেশ টেলিভিশন চট্টগ্রাম কেন্দ্রের লোকসংগীত শিল্পী শিক্ষক সনাতন দাশ বলেন, কবি জয়দেব রচিত সংস্কৃত কাব্য গীতগোবিন্দ বাংলা সাহিত্য ও সঙ্গীতকে বিশেষভাবে উজ্জীবিত করেছিল। বিশেষ করে বিদ্যাপতির পদাবলী এবং বড়ুচণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের মাধ্যমে বাংলার বৈষ্ণবসঙ্গীতের আদিপর্ব শুরু হয়েছিল।
ক্যালিফোর্নিয়া নর্থস্টেট ইউনিভার্সিটির গবেষকরা দাবি করেছেন, স্পিকার বা হেডফোনের মাধ্যমে গান শোনার কারণে সার্জারির পর রোগীরা দ্রুত সেরে ওঠেন। যেসব রোগী সার্জারির পর গান শোনেন তাদের মধ্যে ব্যথা, উদ্বেগ, ওপিওয়েড (আফিম-সদৃশ ওষুধ) ব্যবহার ও হার্ট রেটের মতো প্রধান ৪টি শারীরিক সমস্যা কম দেখা গেছে। গান মানবদেহের কর্টিসল হরমোনের মাত্রা কমিয়ে দেয়, যা সার্জারির পর সেরে উঠতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। সার্জারি শেষে রোগীর জ্ঞান ফিরে আসার পর থেকে স্বাভাবিক অবস্থায় আসা পর্যন্ত যে পরিবর্তন ঘটে, সেই পরিবর্তনকে মসৃণ করতে সাহায্য করে গান।
যে অসুখে সমাধান দেবে গান
মানসিক চাপ: রোগীকে রিলাক্সেশন থেরাপি দেওয়া হয়, যেখানে মিউজিক থেরাপির সঙ্গে বিভিন্ন ছবি দেখানো হয়। এভাবে রোগীকে শান্ত করা হয় যাতে তিনি নিজের সমস্যার কথা অবলীলায় চিকিৎসকের কাছে প্রকাশ করতে পারেন।
অটিজম: মিউজিক থেরাপি বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুর মন অনেকটা শান্ত করে এবং অন্য মানুষের সাথে যোগাযোগের ক্ষেত্র তৈরি হয়। এই সমস্যা শৈশবেই ধরা পড়ে, তাই যত কম বয়স থেকে মিউজিক থেরাপি আরম্ভ করা যায় তত ভাল।
ডিমেনশিয়া: বয়স্ক রোগী অকারণে উত্তেজিত হয়ে ওঠে। ডিমেনশিয়ার ক্ষেত্রে রোগীর হার্ট বা সেরিব্রাল স্ট্রোকের সম্ভাবনা বেড়ে যায়। মিউজিক থেরাপি এই সম্ভাবনা কমিয়ে দিতে পারে এবং রোগীর মধ্যে সহযোগিতা করার মনোভাব জাগে।
অবসাদ: বয়স্কদের এবং মহিলাদের ক্ষেত্রে এই রোগ সারাতে মিউজিক থেরাপি খুবই কার্যকর।
স্লিপ ডিজঅর্ডার: যাদের সহজে ঘুম আসে না, তাদের ক্ষেত্রে মিউজিক থেরাপি কার্যকরী। ঘুমানোর একঘণ্টা আগে থেকে আলো নিভিয়ে বা হালকা আলো জ্বালিয়ে, কোনও হালকা সুরে মিউজিক শুনলে মন শান্ত হয়ে যায় এবং ঘুম আসে।
এছাড়া যেসব শিশুর আইকিউ লেবেল কম, যেসব রোগীর হাইপ্রেশার বা শারীরিক ব্যথা-তাদের জন্য মিউজিক থেরাপি কার্যকর।
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. রুমা সিদ্দিকী বলেন, যুদ্ধ, ধ্বংস- একটা কঠিন অবস্থার মধ্যে ভয় পাচ্ছে মানুষ, হারাচ্ছে বিশ্বাস-আস্থা। সঙ্গীতের মতো আগলে রাখার ক্ষমতা, অতি যন্ত্রণায় জড়িয়ে রাখার ক্ষমতা দ্বিতীয় আর কিছুতেই নেই। মিউজিক থেরাপি মানুষের মস্তিষ্কের সঙ্গে জড়িত প্রত্যেকটি স্নায়ুতন্ত্রকে প্রভাবিত করে। স্নায়ুকে পুনর্গঠন করে, পুনর্বৃদ্ধি করতে এবং আরও শক্তিশালী করতে সাহায্য করে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সংগীত বিভাগের সহকারী অধ্যাপক শান্তা গুহ বলেন, সঙ্গীত ও সুরের মধ্যে মন ও স্মৃতি পুনর্গঠনের রহস্য লুকিয়ে আছে। সঙ্গীত আমাদের মনকে আচ্ছন্ন করে, শান্তি দেয়, নতুন করে ভাবতে শেখায়। কঠিন সময়ে জীবনে নতুন পথের সন্ধান দিতে পারে সঙ্গীত।
এসি/টিসি