চট্টগ্রাম: নগরের এস এস খালেদ রোডে অবস্থিত অভিজাত চট্টগ্রাম ক্লাব এখনও চলছে ব্রিটিশ শাসনামলের ভাবধারায়। ড্রেস কোডের দোহাই দিয়ে সেখানে নিষিদ্ধ বাঙালির পোষাক পাঞ্জাবি।
জানা গেছে, ব্রিটিশ আমলে ১৮৭৬ সালে চা বাগান মালিক ডব্লিও এ ক্যাম্পবেল চট্টগ্রাম ক্লাব প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন।
পাঞ্জাবি পরে চট্টগ্রাম ক্লাবে যাওয়ায় চট্টগ্রামের অনেক স্বনামধন্য ব্যক্তিত্ব ও ব্যবসায়ীকে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। অপমানে তারা আর কখনো ওই ক্লাবে যাননি। ক্লাব কর্তৃপক্ষের এমন আচরণে রীতিমতো বিব্রত অনুষ্ঠান আয়োজকরা। ক্লাব সদস্যরাও বলছেন, এই নিয়ম বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক। পরিচালনা কমিটি সভায় ব্রিটিশদের চাপিয়ে দেওয়া এমন নিয়ম বাতিল করা দরকার।
ক্লাব সূত্রে জানা গেছে, মেমোরেন্ডাম অ্যান্ড আর্টিকেল অব অ্যাসোসিয়েশন অব চট্টগ্রাম ক্লাব লিমিটেড ও সদস্যদের নিয়ন্ত্রণে ক্লাবের বাই-লস অনুযায়ী ক্লাব পরিচালিত হয়। মেমোরেন্ডাম অ্যান্ড আর্টিকেলে পরিবর্তন আনতে হলে ইজিএমের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তবে নির্বাচিত কমিটি বাই-লসে যে কোনো ধরনের পরিবর্তন বা সংশোধন আনতে পারে।
জানা গেছে, ক্লাবের সদস্য এবং অতিথিদের নির্ধারিত ড্রেসকোড পরে ক্লাবে আসতে হয়। টি-শার্ট ও শার্টের সঙ্গে পরতে হয় ফরমাল সু বা ক্লাব নির্দেশিত স্যান্ডেল। তবে পাঞ্জাবি পরে প্রবেশ করা যাবে না। ড্রেসকোড না মানলে ব্যবস্থাও নেওয়া হয়।
অভিযোগ রয়েছে, কয়েক বছর আগে প্রাইম ব্যাংকের একটি অনুষ্ঠানে অতিথি ছিলেন দেশের স্বনামধন্য একটি শিল্প গ্রুপের চেয়ারম্যান। পাঞ্জাবি পরায় তাঁকে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। ২০২১ সালে ট্রাস্ট ব্যাংক লিমিটেডের শীর্ষ কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ীদের নিয়ে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। পাঞ্জাবি পরায় একজন ব্যবসায়ীকে ক্লাব থেকে বের করে দেওয়া হয়।
ট্রাস্ট ব্যাংক চট্টগ্রাম অঞ্চলের প্রধান মিজানুর রহমান বলেন, ক্লাবের হল ভাড়া নেওয়ার সময় ড্রেসকোডের বিষয়ে আমাদের বলা হয়নি। স্বাধীন দেশে ব্রিটিশদের গোলামির নিয়ম থাকা উচিত নয়, এই নিয়ম পরিবর্তন করা দরকার।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী বলেন, চট্টগ্রাম ক্লাব অনেকাংশে ভূমিদস্যুর ও নষ্ট মাফিয়াদের দখলে। আমি আর সেখানে যাই না। এখন আমার সদস্যপদও নেই।
চট্টগ্রাম ক্লাবের সাবেক চেয়ারম্যান এমএ ছালাম বলেন, ক্লাবটি এখনো ব্রিটিশদের অনেক নিয়ম মেনে চলছে। ড্রেসকোডও তার অংশ। এই ড্রেসকোড নিয়ে অনেক সদস্যের ক্ষোভ আছে। কালের পরিক্রমায় অনেক ক্লাব তাদের নিয়মে পরিবর্তন এনেছে। এখানেও এই নিয়ম পরিবর্তন করা দরকার। ঢাকা ক্লাবে এখন পাঞ্জাবি পরিধান গ্রহণযোগ্য হয়েছে।
শুধু পাঞ্জাবি নিয়ে বিতর্কই নয়, শোকের মাসে বিদেশি শিল্পী এনে গত ১১ আগস্ট সংগীতানুষ্ঠানের আয়োজন করে সমালোচনার মুখে সেই অনুষ্ঠান বাতিল করতে বাধ্য হয় ক্লাব কর্তৃপক্ষ। রয়েছে বিদ্যুতের অপচয়, রাজস্ব ফাঁকির অভিযোগও। গত পাঁচ বছরে অন্তত ২০ কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকি দেওয়ার তথ্য উদ্ঘাটন করে চট্টগ্রাম ভ্যাট কমিশনারেট।
চট্টগ্রাম ক্লাব লিমিটেডে অনুমোদিত বার এর মাধ্যমে ক্লাব সদস্যদের জন্য মদ আমদানি ও স্থানীয়ভাবে সংগ্রহ করা হয়। এখানে সরবরাহ করা মদের ওপর ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক প্রযোজ্য। ২০১৫-১৬ অর্থবছর থেকে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ক্লাবের বারে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের চার কোটি ৮৮ লাখ ৭৪ হাজার ৩৭৬ টাকার মদ সরবরাহ করা হয়। এই মদের বিপরীতে ভ্যাট আসে ৮৭ লাখ ৯৭ হাজার ৩৮৭ টাকা ও সম্পূরক শুল্ক এসেছে ৯৭ লাখ ৭৪ হাজার ৮৭৫ টাকা।
একই সময়ে স্থানীয়ভাবে সংগ্রহ করা বিভিন্ন ব্র্যান্ডের মদের ওপর প্রযোজ্য ভ্যাট এসেছে ৫৫ লাখ ৪৪ হাজার ৪৪৬ টাকা ও সম্পূরক শুল্ক এসেছে ৬১ লাখ ৬০ হাজার ৪৯৬ টাকা। সবমিলিয়ে আমদানি করা মদের ওপর প্রযোজ্য মোট ভ্যাট প্রায় দেড় কোটি টাকা এবং সম্পূরক শুল্ক এক কোটি ৫৯ লাখ ৩৫ হাজার ৩৭১ টাকা। তবে এই পরিমাণ মদের বিপরীতে চট্টগ্রাম ক্লাবের পক্ষ থেকে মাত্র ৭৯ লাখ ৭৩ হাজার ১৭৮ টাকার সম্পূরক শুল্ক পরিশোধ করা হয়।
চট্টগ্রাম ভ্যাট কমিশনারেটের প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০১৫-২০১৬ অর্থবছর থেকে বিগত অর্থবছরের জুলাই পর্যন্ত প্রায় ছয় বছরে চট্টগ্রাম ক্লাব লিমিটেড ১১৪ কোটি ৮৪ লাখ ৩৮ হাজার ৫২৯ টাকার সেবা সরবরাহ ও পণ্য বিক্রি করে। এর বিপরীতে প্রযোজ্য ভ্যাটের পরিমাণ ১৭ কোটি চার লাখ ৪৩ হাজার ৭৭৩ টাকা। অডিটোরিয়াম, ব্যাঙ্কোয়েট হল, লাউঞ্জ, লাউঞ্জ স্টোর, ক্যাটারিং, মেস স্টোর, সেলুন, কনফারেন্স রুম, গেস্ট হাউস, লন ক্যাফে, বেকারি স্টোর, মিষ্টান্ন, কনফেকশনারি, সুইমিংপুলসহ বিভিন্ন খাতে এই সেবা ও পণ্য বিক্রি করা হয়েছে। অথচ প্রতিষ্ঠানটির ভ্যাট রিটার্ন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, এ সময়ে চট্টগ্রাম ক্লাব কর্তৃপক্ষ মাত্র চার কোটি ১৫ লাখ ৭৮ হাজার টাকার রাজস্ব পরিশোধ করেছে। অন্যদিকে ফাঁকি দিয়েছে ১৪ কোটি ৩২ লাখ সাত হাজার ৬০৮ টাকা রাজস্ব।
সবমিলিয়ে বিভিন্ন সেবা সরবরাহ ও পণ্য বিক্রির বিপরীতে চট্টগ্রাম ক্লাব লিমিটেড গত ছয় বছরে ১৫ কোটি ১১ লাখ ৬৯ হাজার ৮০১ টাকা টাকার রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছে। আর পাঁচ বছরে প্রতিষ্ঠানের ব্যয়ের বিপরীতে উৎসে ভ্যাট ফাঁকি দিয়েছে প্রায় পাঁচ কোটি ৩৪ লাখ টাকা। সেবা সরবরাহ ও পণ্য বিক্রি এবং ব্যয়ের বিপরীতে প্রতিষ্ঠানটি মোট ২০ কোটি ৪৫ লাখ ৮৮ হাজার ৮২২ টাকার রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছে।
চট্টগ্রাম ক্লাবের বর্তমান চেয়ারম্যান নাদের খান বলেন, ড্রেসকোড মেনেই ক্লাবে আসতে হবে এবং বাই-লস মেনেই ক্লাব পরিচালনা করতে হবে। নির্ধারিত নিয়ম-নীতির বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই আমাদের। সদস্যরা এজিএম ও ইজিএমের মাধ্যমে সংশোধনী আনতে পারেন।
বাংলাদেশ সময়: ১৪২০ ঘণ্টা, আগস্ট ১৭, ২০২২
টিসি