ঢাকা, রবিবার, ২ আষাঢ় ১৪৩১, ১৬ জুন ২০২৪, ০৮ জিলহজ ১৪৪৫

দিল্লি, কলকাতা, আগরতলা

কলকাতার পহেলা বৈশাখ কড়চা

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০৩৩ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৩, ২০১৫
কলকাতার পহেলা বৈশাখ কড়চা

কলকাতা: বাঙালিদের কাছে ইংরেজি বছর হিসাবের বছর আর বাঙলা বছর হৃদয়ের বছর। ইংরেজি তারিখ ধরে মাসের পহেলা তারিখে অফিসের বেতন হয়।

তাই এই ইংরেজি তারিখ ধরে মাসের যাবতীয় খরচের হিসাবও সেরে ফেলতে হয়।

তবে বাঙালির কাছে বৈশাখ অন্য আবেগ নিয়ে আসে। কারণ বৈশাখ দিয়ে একদিকে যেমন নতুন বাঙলা বছরের শুরু, আরেক দিকে এই বৈশাখেই (২৫ বৈশাখ) কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মদিন। সত্যি কথা বলতে, এই দুটি দিনই কলকাতার বাঙালিরা বাঙলা তারিখে মনে রাখেন।

কলকাতায় বাঙলা নতুন বছর উদযাপনের চেহারাটা কেমন? ঢাকায় বসে খুব সহজে অনুভব করতে পারছি, বাঙলা বর্ষবরণের উদ্দীপনার ক্ষেত্রে দুই বাঙলার মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য আছে।

ঢাকায় পহেলা বৈশাখ বরণের যে চিত্র চোখে পড়ছে তার সঙ্গে কলকাতা কেন বিশ্বের কোনো অঞ্চলেরই বাঙলা নতুন বছর উদযাপনের তুলনা করা যায় না। এই বাংলা নববর্ষের ঊষালগ্নে ঢাকায় বসে অনুভব করতে পারছি নববর্ষ বরণের আবেগ।

ভারতের পশ্চিমবঙ্গে শুধু পহেলা বৈশাখ পালিত হয় তেমনটা কিন্তু নয়। এই দিনেই আসাম, উড়িষ্যা, পাঞ্জাব রাজ্যেও পহেলা বৈশাখ নববর্ষের দিন হিসেবে পালন করা হয়।

পশ্চিমবঙ্গে ১৫ এপ্রিল পহেলা বৈশাখ হিসেবে পালন করা হয়। কিন্তু পঞ্জাবে ১৪ এপ্রিল পালন করা হয় নতুন বছর শুরুর উৎসব ‘বৈশাখী’। ভারতের উড়িষ্যা রাজ্যে ১৪ এপ্রিল পালন করা হয় নতুন বছর শুরুর উৎসব ‘পানা সংক্রান্তি’।

আসামে বাংলা নতুন বছর শুরুর উৎসবের নাম ‘রঙ্গোলি বিহু’ বা ‘বোহাগ বিহু’। ১৫ এপ্রিল দিনটিকে এখানে বৈশাখের প্রথম দিন হিসেবে ধরা হয়। ১৪ এপ্রিল থেকে টানা তিন দিন এই উৎসব চলে।

তবে কলকাতায় বাঙলা নতুন বছর শুরুর উৎসবের চেহারা ক্রমেই মলিন থেকে মলিনতর হয়ে উঠছে। বেশিরভাগ মধ্যবিত্ত বাঙালির কাছে বাঙলা বছরের দু’টি দিন ছাড়া অন্য দিনগুলো মনে থাকে না। প্রথমটি পহেলা বৈশাখ আর দ্বিতীয়টি ২৫ বৈশাখ।

লক্ষ করে দেখেছি, বাঙালি মধ্যবিত্ত বাড়ির গৃহ পরিচারিকারা বাঙলা মাসের দিন-তারিখ সহজেই বলে দিতে পারেন। কবে পূর্ণিমা, কবে আমাবস্যা কিংবা সংক্রান্তির দিন-ক্ষণ তাদের নখদর্পণে থাকে। বিষয়টা বেশ অবাক করার মতো।

কিন্তু কলকাতার বাঙালিদের কেন বাঙলা বছর- মাসের দিন-ক্ষণ মনে রাখার অভ্যাস চলে গেছে? এর সমাজতাত্ত্বিক কারণ হিসেবে পাশ্চাত্যের অপ্রতিরোধ্য প্রভাবকেই মনে করা হয়। ঠিক একইভাবে চীন, জাপানসহ আরও কিছু দেশ সংস্কৃতির এই একই অবস্থা মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে। তাই এই সমস্ত জায়গায় একদিকে শিক্ষা, অর্থনীতি, প্রশাসন পরিচালনায় ইংরেজি ক্যালেন্ডার, অন্যদিকে জাতীয় সংস্কৃতি বজায় রাখতে নিজেদের ক্যালেন্ডার চালু রাখতে হয়েছে।

তবে শহর কলকাতার চিত্র বিচার করে পশ্চিমবঙ্গের আমজনতার কথা বিচার করলে চলবে না। পশ্চিমবঙ্গের গ্রামের সাধারণ বাঙালি যারা চাষের ক্ষেতে সারা বছর কাজ করেন, যে বাঙালি নদীর বুকে পাল তোলেন, যারা গ্রামের মধ্যে দোকান চালান, যারা গ্রামে গ্রামে ঘুরে ফেরি করে বেড়ান, যারা আজও অপেক্ষায় থাকেন কবে গঞ্জে আসবে নতুন যাত্রাপালা- তারা কিন্তু আজও মেনে চলেন বাঙলা সাল, মাস, তারিখের হিসাব।

রোজকার অফিস, মাস শেষের টার্গেট, ই-মেইল, ফেসবুক, মাল্টিপ্লেক্সের চলচ্চিত্র আর শপিংমলের ঠাণ্ডা ঘেরাটোপের ছোট বৃত্তের বাইরে পশ্চিমবঙ্গের যেসব বাঙালি আছেন তারা কিন্তু দিব্যি বাঙলা মাসের হিসাব রাখেন।

তবে কলকাতার দোকানদার, ব্যবসায়ীরাও বাংলা নববর্ষ পালন করে থাকেন। কলকাতার ‘অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টস’-এর সামনে গোটা রাত ধরে অনুষ্ঠানের আয়োজন করে একটি বেসরকারি সংগঠন। সেখানে পান্তা-ইলিশ, শুটকি খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চলে নানান সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।

কলকাতার বই পাড়ায়ও কিছু প্রকাশক তাদের লেখকদের নিয়ে পহেলা বৈশাখ উদযাপন করে থাকেন। এই দিনে বিশেষ খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন কমবেশি সব বাঙালি বাড়িতেই করা হয়ে থাকে।

কলকাতায় অনেক দিন ধরেই পহেলা বৈশাখের বাঙালি খাওয়া-দাওয়ার বাণিজ্যিক বিপণন শুরু হয়েছে। সেই ধারার সঙ্গে হাত মিলিয়ে তারা যুক্ত ও তারা ছাড়া বেশ কিছু রেস্তোরায় বাঙালি খাবার খেতে পহেলা বৈশাখে ভিড় জমান বাঙালি, অবাঙালি নির্বিশেষে।

কলকাতায় নতুন বছরের শুরুর দিনে তালপাতার তৈরি পাখার বাতাস আর ষোড়শ ব্যঞ্জন পরিবেশনের বিষয়টি এখন শুধুই স্মৃতি। কারণ এই দিন অফিস কাছারি সাধারণ দিনের মতোই খোলা থাকে।

তবে বেশ কয়েক বছর ধরে পশ্চিমবঙ্গ তথা কলকাতায় বাঙলা নববর্ষের অন্য একটা চেহারা ধরা পড়ছে। সেটা হলো- ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে নববর্ষ উদযাপনের প্রবনতা। সেখানে শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয়, জুড়ে যাচ্ছে উড়িষ্যা, পাঞ্জাব, আসামের নতুন বছরের উৎসবও। তবে সেটা ঢাকার নববর্ষ দেখা মানুষের জন্য সমুদ্রের সঙ্গে এক ঘটি পানির তুলনা করার সামিল।

বলা যায়, কলকাতার পহেলা বৈশাখের উৎসব ঢাকার উৎসবের উন্মাদনার কাছে কিছুই না। তবে কলকাতায় এই দিনটিকে ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে উৎসবের দিন হিসেবে পালনের চেষ্টা চালাচ্ছেন অসাম্প্রদায়িক চেতনার মানুষজন। সেটাই একমাত্র আশার কথা।

বাংলাদেশ সময়: ২০৩৩ ঘণ্টা, ১৩ এপ্রিল, ২০১৫
আরএম/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।