ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

দিল্লি, কলকাতা, আগরতলা

হারিয়ে যাওয়া মাটির পুতুল

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০০৩৩ ঘণ্টা, জুন ৩, ২০১৭
হারিয়ে যাওয়া মাটির পুতুল হারিয়ে যাওয়া মাটির পুতুল

কলকাতা: ‘পুতুল নেবে গো পুতুল’ কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গে অলস দুপুরে জানলার পাশে পুতুল বিক্রেতার এই ডাক আজ আর শোনা যায় না। আজ শিশুদের খেলার বস্তু হিসেবে পুতুল থাকলেও সেই পুতুলের নাম, চেহারা, আকৃতি অনেকটাই বদলে গেছে। 
 

মাটির পুতুল, মোমের পুতুল কিংবা কাঠের পুতুল কিছু অবশিষ্ট থাকলেও সেগুলো থাকে বাড়ির কোনে ধুলো ময়লার আস্তরনে। আজকের ব্যাটারি চালিত, দূর নিয়ন্ত্রিত আধুনিক খেলনার সঙ্গে পাল্লা দিতে না পেরে তারা মিউজিয়ামে জায়গা করে নিয়েছে।

পুতুল যে শুধু খেলার সামগ্রী তা নয় বরং পুতুল একটি বিশেষ অঞ্চলের সংস্কৃতি, ইতিহাস এবং সমাজ ভাবনার চিহ্ন বহন করে।
 
বিভিন্ন ধর্মের সঙ্গেও পুতুল অঙ্গাঙ্গিকভাবে যুক্ত। হিন্দু ধর্মের ঝুলন উৎসব কিংবা খ্রিস্ট ধর্মের মা মেরি এবং যীশুর নিয়ে সাজানোর প্রথায় সরাসরিভাবে পুতুল যুক্ত করা হয়। এমনকি সান্তাক্লজের যে চেনা চেহারা আমাদের মনে আঁকা সেটির উৎস আসলে সান্তাক্লজের পুতুল থেকেই।
 
আধুনিক প্রজন্মের শিশুদের হাতে পুতুলের বদলে অন্য খেলা উঠলেও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পুতুলকে কেন্দ্র করে উৎসব পালন করা হয়ে থাকে।  
 
ঐতিহাসিক দৃষ্টিতে দেখলে দেখা যাবে সভ্যতার ঊষা লগ্ন থেকেই পুতুল তৈরি করত মানুষ। তবে সেটি খেলা বা বাড়িঘর সাজানোর থেকে দেবতা এবং অশুভ শক্তির প্রতীক হিসেবেই বেশি।
 
মনে করা যেতেই পারে আদিম মানুষের আঁকা গুহা চিত্র পুতুল তৈরির প্রথম ধাপ। সেক্ষেত্রে আলতামিরার গুহাচিত্রকে পুতুলের উত্তর পুরুষ বলা জেতেই পারে। পুতুল কখনও মানুষের চেহারার কাছাকাছি আবার কখন কোনো পশুর চেহারার অনুকরণে হয়ে থাকে। সেক্ষেত্রে বৃহত্তর দৃষ্টিতে মাটি, কাঠ, মোম, প্লাস্টিকের বানানো পশুপাখি থেকে ফল, গাছ সব কিছুকেই পুতুলের শ্রেণিভুক্ত করা যায়।

অর্থাৎ যে বস্তুগুলিকে শো পিস বলে থাকি সেগুলি আসলে এক একটি পুতুল। মিশরের মমির ভিতরেও অনেক ক্ষেত্রে পুতুল পাওয়া গেছে। অন্যদিকে, মিসরের মমির ধারণার সঙ্গে পুতুলের ধারণার অনেক মিল পাওয়া যায়।
 হারিয়ে যাওয়া মাটির পুতুল
পশ্চিমবঙ্গে আশির দশক পর্যন্ত মাটি, কাঠ এবং মোমের পুতুলের চাহিদা ছিল। নব্বইয়ের দশক থেকে বদলে যেতে থাকে চিত্রটা। পুতুলের জায়গা দখল করে নেয় স্প্রিং দেওয়া গাড়ি, নকল বন্দুক আর চাবি ঘোরানো কলের পুতুল। তারপরে ভারতের বাজার ছেয়ে যায় চীন থেকে আসা বিভিন্ন প্লাস্টিকের পুতুলে। বিদেশি পুতুলের হাত ধরে আসে টেডি থেকে শুরু করে ‘বার্বি ডল’। স্মৃতির অতলে চলে যায় পশ্চিমবঙ্গের মাটির পুতুল।
 
পশ্চিমবঙ্গের কৃষ্ণনগর মাটির পুতুলের জন্য বিখ্যাত। বলা হয়, কৃষ্ণনগরের মাটির শসার সঙ্গে একটি আসল শসা রাখলে পার্থক্য বোঝা যায় না।
 
শিল্পীদের কাছে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বর্তমানে বাড়ি সাজাতে কিছু মাটির পুতুল বিক্রি হয়। এছাড়া পূজা পার্বণেও কিছু পুতুল বিক্রি হয়। আগে পুতুল নাচ, হরবোলার জন্য কিছু পুতুল বিক্রি হতো। বর্তমানে সেগুলি অনেক কমে গেছে। তবে শুধু মাটির পুতুল নয় পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ, সোনামুখি অঞ্চলের শোলার পুতুলও তার নিখুঁত নির্মাণ শৈলীর জন্য জনপ্রিয়। পশ্চিমবঙ্গের ছুতোর মিস্ত্রিদের বানানো ‘মমি পুতুল’, লাট্টু আজও অনেক বাড়িতে রয়েছে।  
 
এছাড়া আছে গালা দিয়ে তৈরি পুতুল, পোড়া মাটির পুতুল, বাঁকুড়ার বিখ্যাত পোড়া মাটির ঘোড়া, ডোকরা প্রভৃতি। বর্তমানে মাটি, কাঠ, মোম বা সোলার পুতুল নির্মাতারা অনেকেই অন্য পেশায় চলে গেছেন।
 
দুর্গা পূজার সময় মণ্ডপ সজ্জার কাজে তাদের ডাক পড়ে। তবুও তারা শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার তাগিদে নিয়মিত পুতুল বানান। তাদের আশা আবার হয়তো ভবিষ্যতে কোনদিন বাবা মায়েরা সন্তানদের হাতে তুলে দেবেন মাটির কিংবা কাঠের পুতুল। সেই হাতেই বেঁচে থাকবে শিল্প বেঁচে থাকবে ঐতিহ্য এবং ইতিহাস।  

বাংলাদেশ সময়: ০৬৩৬ ঘণ্টা, জুন ০৩, ২০১৭
ভিএস/এনটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।