ঢাকা : সারি সারি মৃতদেহের সঙ্গে শুক্রবার দিনভর শুয়ে ছিলেন তিনি ‘মৃতদেহ’ হয়েই। মৃতের সরকারি তালিকাতেও উঠে গিয়েছিল অপর্ণা চট্টোপাধ্যায়ের নাম।
আমরি হাসপাতালের শুক্রবারের সেই অভিশপ্ত ভোররাত। ঘড়ির কাঁটা চারটে ছুঁইছুঁই। অ্যানেক্স বিল্ডিংয়ের পাঁচতলায় নিউরোলজির ৪৪৩ নম্বর বেডে শুয়ে ছিলেন বৃদ্ধা অপর্ণা চট্টোপাধ্যায়। বয়স প্রায় সাতাশি। স্নায়ুঘটিত রোগে আক্রান্ত হয়ে আমরিতে ভর্তি হয়েছেন ৩ ডিসেম্বর।
রাতের ওষুধের জের শরীরে। খানিকটা তন্দ্রাচ্ছন্ন। হঠাৎই প্রচণ্ড ধোঁয়ায় শুরু শ্বাসকষ্ট। ওঠার মতো অবস্থা ছিল না অপর্ণদেবীর। শুধু বুঝতে পারলেন কারা যেন তাকে পাঁজাকোলা করে তুলে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন। চারিদিকে অস্পষ্ট আর্তনাদ।
ফিকে হয়ে যাচ্ছিল সব কিছুই। তারপর....।
আর কিছুই মনে নেই অপর্ণাদেবীর। শুক্রবারের সেই স্বজনহারানোর কান্নাভেজা সকাল। নাকতলার বাসিন্দা অপর্ণাদেবীর বাড়ির লোকজন জানতে পারলেন ঘটে গিয়েছে ভয়ঙ্কর অগ্নিকাণ্ড।
যেখানে ভর্তি ছিলেন অপর্ণাদেবী, ধোঁয়ায় দমবন্ধ হয়ে গিয়ে সেখানে বহু রোগীই মারা গিয়েছেন। একরাশ আতঙ্ক আর উৎকণ্ঠা নিয়ে হাজির হন আমরিতে। কিন্তু কোথায় মা? ব্রততীদেবী একবার যাচ্ছেন কর্তৃপক্ষের কাছে, একবার ঢুকতে চাইছেন অ্যানেক্স বিল্ডিংয়ে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের তরফেও তাকে জানানো হলো, অপর্ণাদেবীর মৃত্যু হয়েছে। মৃতের তালিকাতে রয়েছে নামও।
সারি সারি মৃতদেহের ভিড়ে খোঁজ মিলল না অপর্ণাদেবীর। ব্রততী জানিয়েছেন, আমরি থেকে জানানো হলো- এসএসকেএম হাসপাতালে বিশকিছু মৃতদেহ চলে গিয়েছে। দৌড়ালাম এসএসকেএম-এ। না সেখানেও নেই।
একবার আমরি, একবার এসএসকেএম। দিনভর শুধুই এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত। কোথাও মায়ের খোঁজ নেই। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা। আত্মীয়রা একরাশ ক্ষোভ উগরে দেন আমরি কর্তৃপক্ষের উপরে। ব্রততী জানিয়েছেন, আমরা বললাম আগে মায়ের মৃতদেহ দেখানো হোক আমাদের।
কোথায় আছে খুঁজে বের করুন আপনারাই। বেশ কিছুক্ষণ পর ব্রততীদের জানানো হয় এসএসকেএম-এ রয়েছে অপর্ণাদেবীর মৃতদেহ। ফের এসএসকেএস এ পৌঁছে গেলেন তারা। তখনি বেজে উঠলো মোবাইল ফোন।
আমরি থেকে জানানো হলো অপর্ণাদেবী সুস্থ রয়েছেন। তার চিকিৎসা চলছে আমরিতেই। আপনারা চলে আসুন। কার্যত কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে ফের ব্রততী আসেন আমরিতে। দেখলেন অপর্ণাদেবী শুয়ে রয়েছেন বেডে। স্যালাইন চলছে।
আতঙ্কে একেবারে বাকরূদ্ধ তিনি। কোনোক্রমে অস্ফুটে ব্রততীদেবীকে বললেন দুটো লোক আমাকে বের করে নিয়ে এল। ব্যস, আর কিচ্ছু মনে নেই। ব্রততী জানতে পারলেন সারি সারি মৃতদেহের ভিড়ে দিনভর শুয়ে ছিলেন তিনি জীবন্ত অবস্থায়।
অপর্ণাদেবীর পরিবারের এক শুভানুধ্যায়ী দীপক সাহা জানিয়েছেন, আমাদের চিৎকার চেঁচামেচির পরই টনক নড়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের। মৃতদেহের মধ্য থেকে তখনি তাকে উদ্ধার করে শুরু হয় চিকিৎসা।
হাসপাতালের পক্ষ থেকে এদিন জানানো হয় কোনাভাবেই অপর্ণাদেবীকে মৃতদেহের সারিতে রাখা হয়নি। তাকে চারতলাই মহিলাদের ওয়ার্ডে রাখা হয়েছিল। নাম বিভ্রাটের কারণে এই বিভ্রান্তি ঘটেছে। তবে অপর্ণাদেবীর নাম মৃতের তালিকায় ছিল বলে অবশ্য এদিন স্বীকার করে নেওয়া হয় হাসপাতালের তরফে।
এদিন সকাল মাকে নিতে এসে ব্রততী জানালেন মাকে জীবিত অবস্থা দেখতে পাব ভাবিনি। যেকোনো মুহূর্তে মুত্যুও হতে পারতো। স্ট্রেচারে শায়িত অপর্ণাদেবীর চোখেমুখে তখনো আতঙ্কের ছাঁপ। চিকিৎসকরা ঘুমের ওষুধ দিয়েছেন। শনিবার দুপুরে বাড়ি ফিরে ঘুমিয়েছেন। শান্তির নি:শ্বাস ফেলেছেন ব্রততীরা।
বাংলাদেশ সময়: ১৯০৭ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১১, ২০১১