ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ফিচার

পলাশী-পরবর্তী রাজনৈতিক পালাবদল

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০৩২ ঘণ্টা, জুন ২০, ২০১৭
পলাশী-পরবর্তী রাজনৈতিক পালাবদল মুর্শিদাবাদে নবাব মুবারক আল দৌলার দরবারে ব্রিটিশ রেসিডেন্ট জন হ্যাডলি ডয়লি, ১৭৯০-১৮০০

২৩ জুন ১৭৫৭ সাল। কয়েক ঘণ্টার ‘তথাকথিত-যুদ্ধ’ নামের প্রহসনে পাল্টে গেল বাংলার এবং দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক ভাগ্য। যুদ্ধের বহুমাত্রিক রাজনৈতিক ধারার ঐতিহাসিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে পলাশীর ২৬০ বছর পূর্তিতে পূর্বাপর ঘটনাপ্রবাহ তুলে ধরছেন বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম-এর কন্ট্রিবিউটিং এডিটর ড. মাহফুজ পারভেজ। পড়ুন নবম পর্ব

চক্রান্তকারীদের ঐক্য ও সিরাজ বিরোধী রাজনৈতিক মেরুকরণ  ক্লাইভের পক্ষে রাজধানী দখলের চমৎকার ক্ষেত্র প্রস্তুত করে। আমির বেগ কর্তৃক মীরজাফরের পত্র, জগৎশেঠ ও অন্যান্য ষড়যন্ত্রকারীদের এজেন্টদের প্ররোচনা এবং অর্থ ও ক্ষমতার প্রতিশ্রুতি ক্লাইভকে মুর্শিদাবাদের প্রতি আগ্রহী করে তোলে।

ক্লাইভের পক্ষে অনুধাবন করতে অসুবিধা হয়নি যে, তার সামনে বিরাট সুযোগ অপেক্ষমাণ এবং সুযোগটি হাসিল করার উপযুক্ত ক্ষেত্রও প্রস্তুত হয়ে আছে। অতএব, পুরো পরিস্থিতি নিজের অনুকূলে দেখতে পেয়ে ক্লাইভ কলকাতা থেকে মুর্শিদাবাদের উদ্দেশ্যে পলাশীর প্রান্তরে এসে উপস্থিত হয়।

রিয়াজের বিবরণ অনুযায়ী, কর্মের সময় উত্তীর্ণ হওয়ার পর অর্থাৎ যখন কাজ করা উচিত ছিল তখন না করে সিরাজ ইংরেজ বাহিনীর অগ্রসর হওয়ার সংবাদ পেয়ে রাজধানী মুর্শিদাবাদ ছেড়ে অগ্রসর হন। তিনি মীরজাফরকে যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে তোষামোদ করতে থাকেন। মীরজাফর কপট আনুগত্য প্রদর্শন করে কালক্ষেপন করতে থাকে এবং সিরাজ সেটা টের পেতে অসমর্থ হন।

সিরাজ যখন চুনাখালি থেকে অগ্রসর হন তখন মীরজাফরও অগ্রসর হয়ে সিরাজের সৈন্যবাহিনী থেকে অর্ধ ফারসাখ দূরে শিবির স্থাপন করে। গোলন্দাজ বাহিনীর প্রধান মীর মদন এই সময় নবাব সিরাজকে বলেন যে, ইংরেজরা মীর মুহাম্মদ জাফরের প্ররোচনায় আসছে; সুতরাং মীর মুহাম্মদ জাফরকে প্রথমে শেষ করা উচিত এবং তাকে হত্যা করার সংবাদ পেলে ইংরেজরা আর অগ্রসর হতে সাহস করবে না। এই পরামর্শ সিরাজ গ্রহণ করেননি, তিনি সকলকে সঙ্গে নিয়ে ইংরেজ বিতাড়নে আগ্রহী ছিলেন। এহেন পরামর্শ গ্রহণ না করায় রিয়াজের লেখক কাব্যচ্ছলে লিখেন: “সেই বিজ্ঞ ব্যক্তির পরামর্শের প্রতি/এই তরল-হৃদয় ব্যক্তি (সিরাজ) বধির হয়ে রইল। ”পলাশী

চুনাখালী থেকে সিরাজ দাউদপুর পৌঁছে সংবাদ পান যে, ইংরেজরা কাটোয়া পুড়িয়ে দিয়েছে। রিয়াজের ভাষ্যমতে: সেইসময় মোহনলাল তিরস্কার করে সিরাজকে বলেন, “আপনি আমার সর্বনাশ করেছেন; আমার সন্তানদের পিতৃমাতৃহীন করলেন। ” মোটের ওপর পরদিন সকালে মুতাবিক ৫ শাওয়াল দিল্লিতে বাদশাহ দ্বিতীয় আলমগীরের রাজত্বের তৃতীয় বৎসরে একদিকে ইংরেজ সৈন্যরা পলাশী থেকে এবং অন্যদিকে সিরাজের বাহিনী দাউদপুর থেকে কামানের গোলাবর্ষণ দ্বারা যুদ্ধ আরম্ভ করে। মীরজাফর তার বাহিনীসহ বামদিকে দূরে দাঁড়িয়েছিল। সিরাজ তাকে নিকটে আসবার জন্য তলব করা সত্ত্বেও মীরজাফর নিজ স্থান ত্যাগ করেনি।

ঘোরতর যুদ্ধের সময় যখন রক্তারক্তি চলছে এবং নবাব বাহিনীর বিজয়ের সূচনা দেখা দিয়েছে, সেই সময় অকস্মাৎ একটি কামানের গোলার আঘাতে গোলন্দাজ বাহিনীর প্রধান মীর মদনের পতন হয়। মীরজাফর তখন যুদ্ধ বিরতি প্রদানের জন্য জোর তদবির শুরু করে। এই অবস্থায় দিক-নির্দেশনাহীন সিরাজের সৈন্যদের মনোভাব পরিবর্তিত হয় ও গোলন্দাজরা মীর মদনের লাশ নিয়ে শিবিরে চলে যায়। তখন বেলা দ্বিপ্রহর। শিবিরের লোকেরা পলায়ন আরম্ভ করে। নবাব তখনো যুদ্ধের পরিকল্পনা নিয়ে ষড়যন্ত্রীদের সঙ্গে আলোচনায় ব্যস্ত ছিলেন। আলোচনায় চক্রান্তকারীরা যুদ্ধ বিরতিতে নবাবকে সম্মত করাতে সমর্থ হয়। নবাব যুদ্ধ বিরতি করেছেন, এই সংবাদে কিংকর্তব্যবিমূঢ় নবাব সৈন্যদলের ওপর ক্লাইভ জোরদার আক্রমণ করলে সূর্যাস্তের দু’ঘণ্টা পূর্বে সিরাজের সৈন্যরাও পলায়ন করে। কোন গত্যন্তর না দেখে নবাবও যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করে নিজের প্রতিষ্ঠিত মনসুরগঞ্জে পৌঁছে কোষাগারের দ্বার খুলে সমস্ত অর্থ সৈন্যদের মধ্যে বিতরণ করেন। কিন্তু অত্যধিক উদ্বেগে সেখানে না থাকতে পেরে সন্ধ্যার পর সিরাজ তার বেগম, সন্তান এবং মালমাত্তা, মূল্যবান মণিমুক্তা ও প্রচুর মুদ্রাসহ এক নৌকায় উঠে পূর্ণিয়া ও আজিমাবাদের দিকে রওয়ানা হন।

সিরাজের পরাজয়ের পর মীরজাফর নবাব-শিবিরে প্রবেশ করেন এবং রাত্রিতে ইংরেজ প্রধানদের সঙ্গে পরামর্শ ক্রমে পরদিন সকালে সিরাজের পশ্চাদ্ধাবন করে মুর্শিদাবাদ পৌঁছেন। পরিস্থিতি সম্পূর্ণ অনুকূল দেখে মীরজাফর দুর্গে প্রবেশ করে বাংলার মসনদে আরোহণের বিজয়বাদ্য বাজাবার আদেশ দেন। নগরে শান্তি ও নিরাপত্তা ঘোষণা করে তিনি সুবাদারির পতাকা উত্তোলন করেন। তদীয় জামাতা মীর কাশেমকে একদল সৈন্যসহ সিরাজকে বন্দি করার জন্য প্রেরণ করেন।

কিন্তু সিরাজ নৌকাযোগে রাত্রিকালে দ্রুত মালদহ অতিক্রম করে বাবিয়াল পৌঁছেন। এখানে এসে তিনি জানতে পারেন যে, নাজিমপুরের মুখে নদীতে নৌকা চলাচল করতে পারে না। তখন তিনি বাধ্য হয়ে নৌকা থেকে নেমে সেখানকার অধিবাসী দানশাহ পীরজাদার বাড়ি যান। দানশাহ ইতিপূর্বে সিরাজের হাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন। সিরাজকে নিজের আয়ত্তে পেয়ে সুযোগ বুঝে দানশাহ তাকে প্রতিশ্রুতি এবং সান্তনা দেন এবং বাহ্যত খাদ্য প্রস্তুতের আয়োজন করেন। মুর্শিদাবাদ ১৮৫৮

বাস্তবক্ষেত্রে দানশাহ মীরজাফরের ভ্রাতা আকবরনগরের (রাজমহল) ফৌজদার মীর দাউদ আলী খানকে সিরাজ সংক্রান্ত সংবাদ পাঠান। মীরজাফরের নির্দেশে দাউদ আলী খানের গোয়েন্দারা সিরাজের সন্ধান করছিল। দানশাহের কাছ থেকে সংবাদ পেয়ে তারা চরম উল্লসিত মনে দ্রুত পৌঁছে সিরাজকে বন্দি করে। বন্দি সিরাজকে অত্যন্ত অবমাননাকর ভাবে দানশাহ (সিয়ারে দানাশাহ নামে বর্ণিত)-এর বাড়ি থেকে আকবরনগরে নিয়ে যাওয়া হয়।  

আরেক বিবরণে দেখা যায়, ষড়যন্ত্রকারী ও ক্লাইভের মধ্যে গোপন চুক্তি সফল হওয়ায় যুদ্ধে স্বাভাবিক মোড় অস্বাভাবিকভাবে ইংরেজদের দিকে ঘুরে যেতে দেখে সিরাজ বিকল্প উদ্যোগের লক্ষ্যে যুদ্ধক্ষেত্রের তাঁবু থেকে আত্মগোপন করে সাধারণ বেশে বেরিয়ে গেলেন পাটনার পথে। পাটনা থেকে নতুন সাজে রাজ্য রক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিয়ে মুর্শিদাবাদে ফিরবেন, এই ছিল তাঁর তাৎক্ষণিক পরিকল্পনা। একটি দ্রুতগামী উটে চড়ে নদী পথে পাটনায় পৌঁছাবার লক্ষ্যে তিনি পদ্মার তীরে ভগবানগোলা বন্দর থেকে রাজমহলের দিকে যাত্রা শুরু করেন। রাজমহলে এসে তিনি খাদ্যের সন্ধানে নৌকা থেকে নামেন। কিন্তু দীনহীনমলিন বস্ত্রধারী হলেও তিনি দানা শাহ নামের এক ফকিরের চোখে পড়ে গেলেন। এই দানা শাহ নানা ধর্মীয় ভন্ডামির অপরাধে সিরাজউদ্দৌলার হাতে দণ্ডিত হয়েছিলেন। ফকিরি করে মানুষকে ধোঁকা দেওয়ার অপরাধে দানা শাহর এক কান কেটে মুর্শিদাবাদ থেকে রাজমহলে বহিষ্কার করা হয়। কান কাটা দানা শাহ রাজমহলে বেশ আসর জমিয়ে বসে। এবং পরাজিত ও বিপন্ন সিরাজকে হাতে পেয়ে প্রবল বিক্রমে শত্রুপক্ষের কাছে ধরিয়ে দেয়।

দানশাহের নিকট থেকে গ্রেফতারকৃত সিরাজকে অনতিবিলম্বে মীর কাশিম মুর্শিদাবাদে নিয়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে মীরজাফর তাকে কারারুদ্ধ করে। পরদিন ইংরেজদের পরামর্শে এবং জগৎশেঠের জেদাজেদিতে তাকে হত্যা করা হয় এবং লাশ হাতির পিঠের হাওদায় করে নগর পরিক্রম করানো হয়। সিরাজের হত্যাকারী হিসাবে মোহাম্মদী বেগের কথা জানা যায়, যে বেগকে সিরাজের পিতা লালন-পালন করেন এবং সিরাজের মাতা তার বিয়ের ব্যবস্থা করে তাকে ভূসম্পত্তি দিয়ে সম্মানজনক জীবনের ব্যবস্থা করে দেন। নিহত হওয়ার পরে নবাব মহবত জং-এর সমাধি সৌধ খোশবাগে সিরাজের লাশ দাফন করা হয়। কিছুদিন পরে সিরাজের ছোটভাই মীর্জা মেহদি আলী খানকেও অত্যাচার করে হত্যা করা হয় এবং সিরাজের কবরের পাশে তার লাশ দাফন করা হয়। নবাব সিরাজের নিজামত ছিল মাত্র এক বছর চার মাস।

এতো অল্প সময়ের শাসনামলে একজন নবাবের পক্ষে স্বৈরাচারি হয়ে ওঠা মোটেও সম্ভব নয়। তদুপরি স্বল্প সময়ের অধিকাংশটাই তাকে কাটাতে হয়েছে বিদ্রোহ দমনের কাজে। ফলে নবাব সিরাজের ব্যক্তিগত ও শাসন চরিত্রের বিরুদ্ধে আরোপিত মিথ্যাচার অসার প্রমাণিত হয়। বরং স্বাধীনতাকামী নবাব প্রবলভাবে নিপীড়িত ও লাঞ্ছিত হয়েছিলেন, এটাই ইতিহাসের মূল সত্য। এটাও সত্য যে, মূলত তিনি আবেগ দিয়ে রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে আগ্রহী ছিলেন। যে কারণে চক্রান্তকারীদের চিহ্নিত ও নির্মূল করা তার পক্ষে সম্ভব হয় নি। বরং চক্রান্তকারীদের চক্করে বিভ্রান্ত হয়ে তিনি নিজের শাসন ও জীবন বিসর্জন দেন।

পরবর্তী পর্ব
ষড়যন্ত্রমূলক যুদ্ধের ব্যবচ্ছেদ  

পূর্ববর্তী পর্ব
ষড়যন্ত্রের রাজনৈতিক মেরুকরণ

বাংলাদেশ সময়: ১৬২০ ঘণ্টা, জুন ২০, ২০১৭
জেডএম/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।