দেশের বর্তমান করোনা পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, ১০ মে থেকে ২০ মে পর্যন্ত যে হারে সংক্রমণ বৃদ্ধি পেয়েছে, ২০ মে থেকে ৩১ পর্যন্ত একই হারে তা বৃদ্ধি পাবে। ১০ মে থেকে ২০ মে পর্যন্ত দেশে মোট শনাক্ত ব্যক্তির সংখ্যা ১২ হাজার ৯৬৮, সরকারি হিসেবে মৃত্যু হয়েছে ১৭২ জনের।
অন্যদিকে এ পর্যন্ত মোট শনাক্তের সংখ্যা ২৬ হাজার ৭৩৮। মৃত্যু হয়েছে ৩৮৬ জনের। যদি একই হারে ২১ মে থেকে ৩১ মে পর্যন্ত সংক্রমণ বৃদ্ধি পায়, তাহলে মে মাস শেষে আক্রান্তের সংখ্যা গিয়ে দাঁড়াবে ৩৮ থেকে ৪০ হাজারে। মৃত্যু হতে পারে ৫শ’র বেশি।
এর আগে দেশের আট জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ পূর্বাভাস দিয়েছিলেন, মে মাসের শেষ নাগাদ দেশে শনাক্তের সংখ্যা আনুমানিক ৪৮ থেকে ৫০ হাজারে গিয়ে দাঁড়াবে। সব মিলিয়ে মৃত্যু হতে পারে ৮০০ থেকে ১০০০ জনের।
ওই পূর্বাভাস সম্পর্কে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ বাংলানিউজকে বলেন, এ পূর্বাভাস যে একেবারে ভুল ছিল তা বলা যাবে না। আমাদের শনাক্ত রোগীর বাইরেও করোনা আক্রান্ত রয়েছেন। সেই হিসাব ধরলে মোট আক্রান্তের সংখ্যা বাড়বে।
‘আমরা আগেই বলছিলাম, মে মাস সবচেয়ে ক্রিটিক্যাল। এ মাসে ‘পিক টাইম’ আসার আশঙ্কা ছিল। কিন্তু আমরা পেলাম না। এটা আরও প্রলম্বিত হবে। আমাদের দেশে প্রথম লকডাউন শুরু হয় ২৬ মার্চ থেকে। করোনার সংক্রমণ রোধ করার জন্য এটা ধীরে ধীরে বাড়ানো হয় ৩১ মে পর্যন্ত। ২৬ মে লকডাউনের দুই মাস পূর্ণ হবে। এতে কাজের কাজ কিছুই হয়নি। আমরা লকডাউন মানতে পারিনি। প্রথমেই পোশাক কারখানা চালু করে দিলাম। দ্বিতীয়ত শপিং মল, মার্কেট খুলে দিলাম। বাজারে, রাস্তাঘাটে মানুষ নেমে পড়ল। শারীরিক দূরত্ব কেউ মানলো না। এখন সবাই বাড়ি যাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। এত সংক্রমণ বৃদ্ধির পথ খুলে গেল। ’
এ প্রসঙ্গে বে-নজির আহমেদ আরও বলেন, আমাদের এখানো প্রথম দিকে নমুনা পরীক্ষা কম হতো। শনাক্তও কম হয়েছে। শনাক্তের বাইরে অনেকেই আছেন। এ বাদেও দেড় থেকে দুই শতাংশ উপসর্গবিহীন রোগী রয়েছেন। তারা হাটে-বাজারে বিভিন্ন জায়গায় ঘোরাঘুরি করছেন। তাদের সংস্পর্শে গেছেন এমন অনেকেই আছেন, যাদের ট্রেস করা যাচ্ছে না।
‘এদিকে ঈদ ঘিরে এখন যারা বাড়ি যাচ্ছেন, তারা যদি সঠিক নিয়মে ১৪ দিন হোম কোয়ারেন্টিন পালন না করেন তাহলে বিপদ আরও বাড়বে। কারণ এবারের ঈদের জামাত মসজিদে মসজিদে হবে। আমাদের দেশে ১ লাখের ওপরে মসজিদ আছে। ঢাকা থেকে দেশের বিভিন্ন এলাকায় যাওয়া এসব মানুষ যখন মসজিদে ঈদের জামাতে নামাজ আদায় করবেন, আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে বেড়াবেন, তখন এক জনের সংস্পর্শে গড়ে আরও দুই জনের মধ্যে সংক্রমণ ছড়াবে। এতে অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই শনাক্ত রোগীর সংখ্যা লাখের ওপরে চলে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ’
করোনায় বাংলাদেশ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে আছে উল্লেখ করে বে-নজির আহমেদ বলেন, এক মাস আগেও বাংলাদেশ সংক্রমণের দিক থেকে বিশ্বে ১৭০ নম্বরে ছিল। এক মাসের ব্যবধানে ৩০ নম্বরে চলে এসেছে। ঈদের কয়েক দিন পরই এটা ২০ নম্বরে নেমে আসবে। এভাবে চললে বিশ্বের সর্বোচ্চ আক্রান্তের সংখ্যা ও মৃত্যুর তালিকায় যে কয়টি দেশ আছে তাদের পাশে যেতে বেশি দিন লাগবে না।
পিক টাইম প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মিডিয়া সেলের প্রধান ও অতিরিক্ত সচিব হাবিবুর রহমান খান বলেন, করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিদিন যে হারে বাড়ছে, এ হার আগামী ১৫ থেকে ১৬ দিন অব্যাহত থাকতে পারে। আমরা ‘পিক টাইমের’ কাছাকাছি চলে এসেছি। হয়তো ঈদের পর সেখানে পৌঁছে যাবো।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক উপাচার্য ভাইরোলজি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, এখন জটিল সময় পার করছে বাংলাদেশ। দেশে যখন সংক্রমণ উর্ধ্বমুখী, তখন বৃদ্ধ ও শিশুরা ঘরে থাকলেও তরুণ-যুবকরা ঘরের বাইরে বাজারে, রাস্তাঘাটে অবস্থান করছে। আমাদের এখানে আক্রান্তের সংখ্যায় মধ্যবয়সী যুবক, তরুণরাই বেশি। অথচ করোনা প্রতিরোধে তাদের এগিয়ে আসা উচিত। আমদের মুক্তিযুদ্ধে কিন্তু এই বয়সীদের সংখ্যাই বেশি ছিল। করোনা পরিস্থিতির ভয়াবহতা তাদের বোঝালে তারা তা প্রতিরোধে ঘরে থাকবে বলে আমার বিশ্বাস।
দেশে করোনার পিক টাইম প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ঈদুল ফিতরের ছুটি শেষ হলে প্রথম ১৪ দিন সংক্রমণ বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা অনেক বেশি। কারণ যারা এখন বাড়ি যাওয়ার জন্য ছুটছেন এবং আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে এসেছেন, তাদের লক্ষণ প্রকাশের সময় তখন। এর মধ্যে আমাদের ল্যাবের সংখ্যাও বাড়বে। নমুনা পরীক্ষার সংখ্যাও বাড়বে। ফলে শনাক্তের সংখ্যাও বাড়বে।
সংক্রমণ প্রতিরোধে করণীয় জানতে চাইলে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মুশতাক হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, দেশের সাধারণ মানুষ সচেতন না হওয়ায় করোনা মোকাবিলা কঠিন হয়ে পড়ছে। তবে এর মাঝে করোনা নিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অনেক অভিজ্ঞতা হয়েছে। সংক্রমণ রোধে সেটাকে কাজে লাগাতে পারলে অনেক অগ্রগতি হবে বলে আশা করা যায়।
বাংলাদেশ সময়: ১১৩৫ ঘণ্টা, মে ২১, ২০২০
পিএস/এইচজে