ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

স্বাস্থ্য

করোনার নানাবিধ প্রভাব শিশুদের ওপর

হোসাইন মোহাম্মদ সাগর, ফিচার রিপোর্টার | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯২৭ ঘণ্টা, জুন ২৩, ২০২০
করোনার নানাবিধ প্রভাব শিশুদের ওপর ছবি: সংগৃহীত

ঢাকা: বিশ্বে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের ক্ষেত্রে সর্বাধিক ঝুঁকিতে এতদিন বয়স্কদের ওপরের তালিকায় রাখা হলেও একাধিক গবেষণা বলছে এখন শিশুরাও এই ক্ষেত্রে নিরাপদ নয়। তাদের মতে, সুপ্ত অবস্থায় করোনার বাহক হতে পারে শিশুরাও।

একাধিক গবেষক বলছেন, শিশুরা করোনা ভাইরাসে অপেক্ষাকৃত অনেক কম আক্রান্ত হলেও তারা করোনা ভাইরাসের নীরব শিকার। করোনা ভাইরাস শিশুদের ফুসফুসে কম আক্রমণ করে।

কিন্তু, এই ভাইরাস দ্রুত সংক্রমিত করতে সক্ষম। তাই সুপ্ত অবস্থায় শিশুরা এই ভাইরাসের বাহকও হতে পারে বলেও জানান দিচ্ছেন তারা। তাই শিশুদের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার ওপর জোর দিতে বলছেন গবেষকেরা।

এদিকে আরও একাধিক গবেষণায় দেখা গেছে, প্রাথমিকভাবে উপসর্গ না থাকায় আক্রান্ত শিশুদের চিকিৎসা করাও রীতিমতো চ্যালেঞ্জর মুখে পড়ছে।

জার্নাল অব পাবলিক হেলথ ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড প্র্যাকটিসে প্রকাশিত একটি গবেষণায় বলা হয়েছে, শিশুদের দেহে করোনা প্রতিরোধে তাদের ওপর পরিজনদের আরও বিশেষ যত্ন ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার বিশেষ প্রয়োজন রয়েছে।

এদিকে করোনা ভাইরাসের ভয়াবহ সংক্রমণের কারণে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে মারাত্মক ব্যাঘাত ঘটায় বেকারত্ব, দারিদ্র, ক্ষুধাও যেন কোভিড-১৯ এর উপসর্গ হয়ে উঠেছে।

এ বিষয়ে ঢাকা শিশু হাসপাতালের ডেভেলপমেন্টাল পিডিয়াট্রিশিয়ান ডা. রিয়াজ মোবারক জানান, এমন হতে পারে যে, পরিবারে খাদ্য সংকট কারণে শিশুরা অপুষ্টিতে ভুগবে। এ সময় অনেকেরই বেতন বন্ধ হয়ে গেছে বা কমে গেছে, চাকরি চলে গেছে। এসব ঘরে তো খাবার ঠিকমতো আসছে না। ফলে শিশুর যে সুসম পুষ্টি সেটা কিন্তু হচ্ছে না। সে কারণে শিশুর লম্বায় বড় হওয়া, ওজন বৃদ্ধি কমে যেতে পারে।

এখন বিশ্বব্যাপী প্রায় দুই হাজারেরও বেশি শিশু করোনায় আক্রান্ত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ফ্লোরিডা বিশ্ববিদ্যালয় এবং চীনের রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ বিভাগের একাধিক গবেষণায় দেখা গেছে।

বিশ্বব্যাপী শিশুদের ওপরে করোনার সংক্রমণ ক্রমেই বাড়ছে। বিশেষ করে কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত না হলেও ঘরে বসে থেকে শিশু একাকীত্বে ভুগছে। শিশুর বুদ্ধির বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চতর মানবিক ও সামাজিক বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্রের রিসার্স ফেলো হাসান নিটোল বলেন, করোনা ভাইরাসে সৃষ্ট লকডাউন পরিস্থিতির কারণে দীর্ঘদিনের আবদ্ধ অবস্থা শিশুর সব ধরনের বিকাশ বাধাগ্রস্ত করছে। একটা শিশু যখন হাঁটতে শেখে, কথা বলতে, দৌড়াতে শেখে, ছবি আঁকে, নাচে এইসব জিনিস শিশুর বিকাশের একটা অংশ। শিশুর সব ধরনের বিকাশ, বুদ্ধির বিকাশ এই পরিস্থিতিতে মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। একইসঙ্গে শিশুর পুষ্টির অভাব হলে তার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাবে। অসুখ-বিসুখ লেগেই থাকবে। ফলে এর একটা বড় প্রভাব পড়বে শিশুদের ওপর।

সামাজিক উন্নয়ন সংস্থা রিথিংকের পরিচালক লুলু আল মারজান বলেন, শ্রেণিকক্ষে পাঠদান বন্ধের প্রভাব শিশুদের ওপর থাকবে অনেকদিন। একইসঙ্গে শিশুর আচরণগত পরিবর্তন, বিষণ্ণতা, মানসিক ট্রমাও সৃষ্টি হতে পারে। স্কুল নেই, বন্ধুদের সঙ্গে দেখা নেই, খেলা নেই, ঘরের চার দেওয়াল ছাড়া কোথাও বেড়াতে যাওয়ার উপায় নেই। ফলে চারিদিকে শুধু শঙ্কার আবহ শিশুর মনোজগতের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলবে।

ইউনিসেফের মতে, করোনা ভাইরাসের ‘সেকেন্ডারি ইফেক্ট’ পড়তে পারে শিশুদের ওপর। ক্ষুধা, অপুষ্টি ও একাকীত্ব ছাড়াও শিশুরা ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে আরও নানাভাবে।

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা বলছে, ২০০০ সাল থেকে বিশ্বব্যাপী শিশুশ্রমের হার কমেছিল ৯৪ শতাংশ। কিন্তু করোনা মহামারির কারণে এর প্রবণতা উল্টো পথে যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। লাখ লাখ শিশু আবারো শিশুশ্রমে যুক্ত হতে বাধ্য হবে বলে সংস্থাটি আশংকা প্রকাশ করছে।

এতকিছুর ভীড়ে এখন অভিভাবকদের সচেতন থাকাটাই সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

এ বিষয়ে উন্নয়নকর্মী এবং উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর কর্মকর্তা শারীফুল ইসলাম বলেন, এই পরিস্থিতিতে কিশোর বয়সীরা হয়তো অনেক বেশি সময় ঘরে দরজা আটকে থাকছে, অনলাইনে অনেক বেশি সময় কাটাচ্ছে। তাদের মধ্যে বিষণ্ণতা দেখা দিতে পারে।

তিনি বলেন, বাবা-মায়ের মানসিক চাপের কারণে শিশুদের ওপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের পরিমাণ বেড়ে যেতে পারে। যার ব্যাখ্যা হয়তো বুঝতে পারবে না শিশুর সরল মন। এতে বাবা-মায়ের ওপরে তার ক্ষোভ তৈরি হতে পারে, তাদের সঙ্গে সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। শিশুদের ওপর যৌন নির্যাতনও বেড়ে যেতে পারে। আর দরিদ্র পরিবারের শিশুরা নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সংস্পর্শে আসতে পারে। সবমিলিয়ে ক্ষুধা, অপুষ্টি, শিশু শ্রমের সঙ্গে সঙ্গে শিশুদের মনে নিশ্চিতভাবেই দীর্ঘমেয়াদি একটা ট্রমা রেখে যাবে করোনা ভাইরাস সৃষ্ট মহামারি। তাই সবদিক থেকেই আমাদের অভিভাবক সচেতন থাকাটাই সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

বাংলাদেশ সময়: ০৮৫৯ ঘণ্টা, জুন ২৩, ২০২০
এইচএমএস/এএটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।