ঢাকা, বুধবার, ১৯ আষাঢ় ১৪৩১, ০৩ জুলাই ২০২৪, ২৫ জিলহজ ১৪৪৫

আন্তর্জাতিক

গরিলারূপে ছোট্টবালক, তপ্ততম বছর দেখবে বিশ্ব

আবহাওয়া ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮৫২ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৫, ২০১৫
গরিলারূপে ছোট্টবালক, তপ্ততম বছর দেখবে বিশ্ব ছবি: সংগৃহীত

ছোট্ট বালকটি হয়ে আর থাকলো না এলনিনো। এবার তা তকমা পেলো ‘গরিলা’।

অতিকায় জন্তু গরিলার মতই ভয়ঙ্কর হয়ে দেখা দিচ্ছে এবারের এলনিনো। আর বলা হচ্ছে, ইতিহাসের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে বিশ্বকে ভুগিয়ে তবেই ছাড়বে এই ‘গরিলা এলনিনো’। অনেকেই এখনো ঠিক বুঝতেই পারছেন না, কি হতে যাচ্ছে এর ভয়াবহতা। জাতিসংঘের আবহাওয়া বিষয়ক সংস্থার মতে, এলনিনো এসে গেছে। আর সে কারণে গোটা বিশ্ব এবারও একাধারে বন্যায় ভাসবে আর ভীষণ খরায় পুড়বে।

বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা (ডব্লিউএমও) জানিয়েছে এরই মধ্যে বেশ বাড়ন্ত আর শক্তিশালী হয়ে উঠেছে এলনিনো। আর বছরের শেষ নাগাদ তা দৈত্যাকার হয়ে উঠবে।

গড় তাপমাত্রার হিসাবে ২০১৫ সাল পৃথিবীর ইতিহাসে উষ্ণতম বছর হতে চলেছে বলে জানিয়েছে ডব্লিউএমও।

এ বছরের অক্টোবর পর্যন্ত যে তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে, তা অতীতের যেকোনো বছরের ১২ মাসের তুলনায় বেশি। এছাড়া ২০১১ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছর সময়ও অন্যান্য সময়ের চেয়ে উষ্ণ বলে জানিয়েছেন বিজ্ঞানীরা।

শক্তিশালী এলনিনো ও মানব সৃষ্ট কারণই এ বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণ বলে মন্তব্য করেছেন বিজ্ঞানীরা।

১৯৬১ সাল থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত সময়ের গড় তাপমাত্রার তুলনায় চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত রেকর্ডকৃত গড় তাপমাত্রা শূন্য দশমিক ৭৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি বলে জানিয়েছে ডব্লিউএমও। এছাড়া ১৮৮০ থেকে ১৮৯৯ সাল পর্যন্ত সময়ের তুলনায় এ তাপমাত্রা এক ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি।

এদিকে, ১৯৬১ সাল থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত যেকোনো পাঁচ বছরের গড় তাপমাত্রার তুলনায় ২০১১ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত সময়ের গড় তাপমাত্রা শূন্য দশমিক ৫৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি।

ডব্লিউএমও বলছে, গ্রিনহাউজ গ্যাসের নিঃসরণ এখন নতুন মাত্রায় পৌঁছেছে। উত্তর গোলার্ধে চলতি বছর বসন্তে যেকোনো তিন মাস সময়ের কার্বন ডাই অক্সাইড নিঃসরণের রেকর্ড ভেঙে গেছে।

প্রশান্ত মহাসাগরে সমুদ্রপৃষ্ঠ তপ্ত থেকে তপ্ততর হয়ে উঠছে। এটাই এলনিনোর লক্ষণ। এতে ধরিত্রীর কোনো ভাগে তীব্র খরা আর কোনো ভাগে তীব্র বৃষ্টিপাত হয়। জাতিসংঘ ধারণা করছে, এবছর স্বাভাবিকের তুলনায় প্রশান্ত মহাসাগরের তাপমাত্রা অন্তত ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি হবে। আর বিবিসির একটি খবর জানিয়েছে, এরই মধ্যে তা স্বাভাবিকের চেয়ে ১ ডিগ্রি বেড়ে গেছে। ১৯৫০ সালের পর চারটি বড় এলনিনোর মধ্যে এবারেরটিই হতে যাচ্ছে সবচেয়ে শক্তিশালী। আগের তিনটি এসেছিলো ১৯৭২-৭৩, ১৯৮২-৮৩ ও ১৯৯৭-৯৮ সালে।

অক্টোবর থেকে জানুয়ারি এই সময়টিতেই এলনিনো সবচেয়ে শক্তিশালী রূপ নেয়। আর কখনো কখনো তা নতুন বছরের প্রথম কোয়ার্টারের পুরোটা জুড়েই বিরাজ করে।

চেহারাটাই এমন, একদিকে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো, ইন্দোনেশিয়া, অস্ট্রেলিয়াকে এই এলনিনো খরায় পোড়ায় আর তাতে দাবদাহ, তাপপ্রবাহ যেমন সৃষ্টি হয় তেমনি পুড়ে যায় ফসলের ক্ষেত, শুকিয়ে যায় নদীনালা। ইন্দোনেশিয়ায় এরই মধ্যে দাবদাহে পুড়তে শুরু করেছে দেশটির বিস্তির্ণ বনাঞ্চল।

আর অপরপিঠে পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগরীয় দক্ষিণ আমেরিকান দেশগুলোতে দেখা দেয় তীব্র বৃষ্টিপাত, বন্যার। যাতে ব্যাপক ভূমিধসের সৃষ্টি হয়। ডব্লিউএমও বলছে, এবারের এলনিনোতে ভূখণ্ডের ওপাশে পুরো মৌসুম জুড়েই চলবে ঘূর্ণিঝড়। মেক্সিকোতে এরই মধ্যে রেকর্ড ভঙ্গকারী হারিকেন প্যাট্রিসিয়ার আঘাতে বিপর্যস্ত।

সুদান, ইরিত্রিয়া, ইথিওপিয়া, জিবুতির মতো দেশগুলোতে খরা ও অন্যান্য দুর্যোগ দেখা দেবে। অাবার কেনিয়া, সোমালিয়া ও উগান্ডা ভাসবে বন্যায়।

তবে আশার কথা হচ্ছে এবারের প্রস্তুতি অতীতের যে কোনো এলনিনো বছরের চেয়ে ভালো। আন্তর্জাতিক, জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে যেসব উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে তা প্রশংসার যোগ্য। একটাই লক্ষ্য ‘জীবন বাঁচাও, অর্থনৈতিক ক্ষতির ভাগটা কমিয়ে আনো’।

তবে সবাই তাকিয়ে আছেন আসছে জলবায়ূ সম্মেলনের দিকে। কারণ এই এলনিনো জলবায়ু পরিবর্তনেরই ফল। ভূ-পৃষ্ঠের উষ্ণতা বেড়ে যাওয়ার যোগসাজসেই এলনিনো এমন শক্তিশালী রূপ নিচ্ছে। সমুদ্রপৃষ্ঠ হয়ে উঠছে আরও তপ্ত।
     
প্যারিস সম্মেলন শুরু হতে আর বাকি মোটে দুই সপ্তাহ। বিশ্বনেতারা প্যারিসে বসবেন এই জলবায়ু সম্মেলনে। ধারণা করা হচ্ছে, এবারের প্যারিস সামিট সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যেমন জয়ের ঘোষণা হবে, তেমনি জলবায়ু ইস্যুতেও এক বিশাল বিজয়। কারণ ওই সম্মেলনের সিদ্ধান্তের ওপর ঝুলে রয়েছে মানবতার ভবিষ্যত।

প্রশ্ন তো থেকেই যায়, আমরা কি পারবো গ্রিন হাউস গ্যাসের নিঃসরন কমানোর চুক্তিতে উপনীত হতে? নাকি বিশ্ব যে আর মানব বসবাসের যোগ্য থাকবে না সে কথাটুকুও ভুলে যাবো? সেসব প্রশ্নেরই উত্তর মিলবে ৩০ নভেম্বর থেকে ১১ ডিসেম্বরের মধ্যে।

আমরা কিন্তু ২০০৯ সালে কোপেনহ্যাগেনের সেই হতাশা জাগানিয়া হট্টগোলের কথা ভুলে যাইনি। তবে তখনের থেকে এখন অনেক পরিবর্তিত সময়। অনেক কিছুই পাল্টে গেছে। কম কার্বন নিঃসরণকারী প্রযু্ক্তি এসেছে, আর তা পাওয়াও যাচ্ছে সস্তায়। আর নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার নিশ্চিত করতে রাজনৈতিক, বাণিজ্যিক ও সাধারণ মানুষের তরফে চাপও বেড়েছে গোটা বিশ্বজুড়ে।

একই সঙ্গে কিছু একটা না করার সুযোগটাও কিন্তু কিছুটা সংকির্ণ হয়ে এসেছে।

সে শিক্ষা আসছে প্রকৃতি থেকেই। মাত্রই গেলো সপ্তায় ব্রিটেনের আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, প্রশান্ত মহাসাগরের উপরিভাগ এরই মধ্যে স্বাভাবিকের চেয়ে ১ সেন্টিগ্রেড বেশি তপ্ত হয়ে উঠেছে। জাতিসংঘ যে দুই ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করেছে তারই পথে হাটছে পরিস্থিতি।

ডব্লিউএমও’র মতে, বিশ্বে গ্রিনহাউস গ্যাসের নিঃসরন মাত্রা রেকর্ড গড়ে ২০১৪ সালে। জলবায়ু সংশ্লিষ্টতায় পরিবর্তনগুলোকে নাটকীয় বলে উল্লেখ করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট ও নোবেলজয়ী জলবায়ু অ্যাক্টিভিস্ট আল গোর।

তিনি বলেন, অনেক বড় বড় নগরীতে সড়কগুলো এখন জোয়ারের পানিতে তলিয়ে যেতে দেখছি। সিরিয়ায় ভয়াবহ খরা তাদের জলবায়ু উদ্বাস্তুতে পরিণত করছে। অতি দ্রুত জলবায়ু পরিবর্তন প্রতিরোধে গোটা বিশ্বের সমঝোতায় পৌঁছানোর ওপর গুরুত্বারোপ করে আসছেন আল গোর।

প্রয়োজনীয়তা সকলের কাছেই স্পষ্ট, বক্তৃতা-বিবৃতিতেও শোনা যায় কিন্তু রাজনৈতিক বিভাজন তো রয়েই গেছে। কোপেনহ্যাগেন-এ ১৯৫ জাতির যে জলবায়ু ফোরাম তৈরি হয়, তা কিন্তু এখনো আশান্বিত হওয়ার মতো কোনো পর্যায়ে পৌঁছাতে পারেনি।

কোপেনহ্যাগেন ফোরামই কেন? আসলে এই যুদ্ধতো চলে আসছে প্রায় দুই দশক জুড়ে। এখনো কিন্তু একমত হওয়া সম্ভব হয়নি কে দায়িত্ব নেবে, কার্বন নিঃসরণ কমিয়ে আনতে কে কতটুকু ভূমিকা রাখবে, আর কেইবা দেবে অর্থ।

উন্নয়নশীল দেশগুলো কার্বন নিঃসরণে দুষছে ধনী দেশগুলোকেই। ঐতিহাসিকভাবেই তারা এর জন্য দায়ী। ফসিল ফুয়েল নিঃসরণ করে তারাই পরিবেশকে দুষিত করে আসছে।

আর যুক্তরাষ্ট্রের মোড়লিপনা মেনে উন্নত দেশগুলো আঙ্গুল তুলছে চীন আর ভারতের দিকে। চীন বিশ্বের এক আর ভারত চতুর্থ বৃহত্তম কার্বন নিঃসরণকারী দেশ। আর তাদের অংশের দায়িত্ব তাদেরকেই নিতে হবে।

আরেকটি জোর বিতর্ক অর্থায়ন নিয়ে। গরীব দেশগুলো নবায়নযোগ্য জ্বালানির পথে হাঁটতে যে অর্থ প্রয়োজন, তা মিটাতে সহায়তা চাইছে। কেবল তাই নয়, জলবায়ু পরিবর্তনে এরই মধ্যে খরা, ঝড়-ঝঞ্ঝা, বন্যার কবলে পড়ে যে ক্ষতি হচ্ছে, তার জন্যও অর্থ সহায়তা চায় এসব দেশ।

যে কথাই হোক, এবারের প্যারিস চুক্তি হতে চলেছে এই পথে টার্নিং পয়েন্ট। সবচেয়ে বড় কথা, ১৯৯৭ সালে গৃহীত কিয়োটো প্রোটোকল বদলে এবার নতুন করে চুক্তি গৃহীত হতে হবে। ২০২০ সালে এই প্রোটোকলের মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা। এই প্রোটোকলের দুর্বলতম দিকটি হচ্ছে, এতে অনুস্বাক্ষর করেনি খোদ যুক্তরাষ্ট্র। অথচ এই দেশটিই বিশ্বের সবচেয়ে বেশি কার্বন নিঃসরণকারী দেশ।

প্যারিস কনফারেন্স অব পার্টিজ (কপ-২১) থেকে যে নতুন চুক্তি হতে যাচ্ছে, তাতে বিশ্বের ছোটবড় কোনও দেশেরই আর মুখ ঘুরিয়ে থাকার সুযোগ থাকবে না। এই চুক্তি হয়ে গেলে তার বাস্তবায়ন শুরু হবে ২০২০ সাল থেকে।

চুক্তি হলেও এবারের এলনিনো থেকে হয়তো বিশ্ব রক্ষা পাবে না। তবে পরের এলনিনোটি নিশ্চয়ই দুর্বলতর করে দেওয়া যাবে। কারণ সব কিছুর মূলেই এই বিশ্ব উষ্ণায়ন। আর সে তো জলবায়ু পরিবর্তনেরই কারণেই।

বাংলাদেশ সময়: ১৮৫৩ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৫, ২০১৫
আরএইচ/এমএমকে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।