বাগেরহাট: নির্মাণ শেষ হওয়ার আগেই বাগেরহাট সদর উপজেলার ভাতছালা-মুনিগঞ্জ বেড়িবাঁধে ফাটল দেখা দিয়েছে। কয়েকটি জায়গায় বাঁধের অংশ ধ্বসেও গেছে।
প্রায় কোটি টাকা ব্যয়ে এ বাঁধের নির্মাণ কাজ চলছে। কাজ শেষের আগে ফাটল দেখা দেওয়ায় এর স্থায়িত্ব নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। বাঁধ নির্মাণে মালিকানাধীন জমি থেকে জোর করে মাটি নেওয়ার অভিযোগও করেছেন স্থানীয়রা।
বাগেরহাট পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) থেকে জানা গেছে, ভৈরবের পানি থেকে মুনিগঞ্জ-ভাতছালাবাসীকে রক্ষার জন্য ষাটের দশকে নাজিরপুর উপ-প্রকল্পের অধীনে বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা হয়। ঝড়-জলোচ্ছ্বাস ও বৃষ্টিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে বাঁধটি বেশ নিচু হয়ে গেছে। ফলে গত কয়েক বছরে বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও বর্ষা মৌসুমে অমাবস্যা-পূর্ণিমা তিথিতে নদীর পানি উপচে মুনিগঞ্জ, ভাতছালা, ভদ্রপাড়া ও চরগ্রাম প্লাবিত হতো।
স্থানীয়দের দুর্ভোগ লাঘবে ২০২২ সালের নভেম্বরে ভাতছালা থেকে মুনিগঞ্জ পর্যন্ত তিন কিলোমিটার এলাকাজুড়ে বাঁধটি সংস্কার শুরু করে পাউবো। ৯০ লাখ টাকা ব্যয়ে আগের চেয়ে তিন/চার ফুট উঁচু করা হবে বাঁধটি। জরুরি ভিত্তিতে ডিপিএম (সরাসরি ক্রয়) পদ্ধতিতে ঠিকাদার শেখ শহিদুল ইসলাম এ কাজ বাস্তবায়ন করছেন। চলতি মাসে কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও মাত্র ৫০ ভাগ শেষ হয়েছে। বাঁধের পুরো কাজ শেষ করতে তাই প্রকল্পের সময় কিছুটা বাড়ানো হবে বলে জানিয়েছেন পাউবোর এক কর্মকর্তা।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, বাঁধের বিভিন্ন স্থানে বালু ব্যবহার করা হয়েছে। এতে আবুল বাশার নামে চরগ্রামের এক বাসিন্দার বাড়ি ধ্বসে গেছে। ফাটল ধরেছে গ্রামের কয়েক জায়গায়। এছাড়া বিভিন্ন স্থানে বাঁধের একদম গোঁড়া থেকে (বাঁধ লাগোয়া) ১৫ থেকে ২০ ফুট গভীর করে মাটি খুঁড়ে নেওয়া হয়েছে। বৃষ্টি ও জলোচ্ছ্বাসে বাঁধ ধ্বসে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে।
বাঁধের দুই পাশে স্থানীয়দের বাড়ির উঠান বাগান ও ধানি জমি থেকে জোর করে মাটি তুলে নেওয়ার অভিযোগ আছে। সরেজমিনে এর প্রমাণ পাওয়া গেছে। গভীর খোদাই করে করে মাটি তুলে নেওয়ায় ফাতেমা জান্নাত নামে স্থানীয় এক বাসিন্দার ভবনের সামনে ফাটল ধরেছে। দেবে গেছে বিভিন্ন জায়গার গাছ ও জমি। বাঁধ সংস্কার ও পুনর্নির্মাণ কাজের কোনো তথ্য স্থানীয়দের জানানো হয়নি বলেও অভিযোগ আছে।
ভাতছালা-মুনিগঞ্জ এলাকার বাসিন্দারা বলছেন, বেমরতা ইউনিয়ন পরিষদের ৪ নম্বর ওয়ার্ড সদস্য আসাদুজ্জামান মোহন, তার চাচাতো ভাই সুমন, চরগা গ্রামের ছোটসহ কয়েকজন জোর করে মাটি তুলে নেন। না দিলে বাধ্য করেন তারা। এতে স্থানীয়দের মধ্যে ক্ষোভ জমছে।
চরগ্রাম গ্রামের শাহ জাহান শেখ বলেন, বাঁধের একদম গোঁড়া থেকে মাটি কাটিছে। এই বাঁধ টেকবে কি করে? নদীর পাড়, চর কাইটে নিয়ে আসতিসে। সেই মাটি-বালি দিয়ে বাঁধ করলে, কোনো দিন থাকবে নানে। কয়েক জাগায় পুরো বালি, কাঁদা মাটি দিয়ে বাঁইধে গেছে। নদীর পাশের বাঁধের গোড়ারদে মাটি নেছে। পানির চাপ দিলি তো একবারে ধইসে নদীতে চলে যাবেনে। এগুলো দেখাও কেউ নেই।
চরগ্রাম গ্রামের আবুল কালাম গাজী জানান, বালি দেওয়ায় দুই তিন জায়গায় ডেবে গেছে। বড় বড় গর্ত করে মাটি তোলায় অনেক জায়গায় ফাটল ধরছে। একটু বৃষ্টি হলে বাঁধও ধ্বসে যাবে।
স্থানীয় ফাতেমা জান্নাত বলেন, নিষেধ করার পরও বাড়ির সামনে থেকে জোরপূর্বক মাটি কেটে নিয়েছে। অতিরিক্ত গভীর করায় মাটি ধ্বসে কয়েকটি গাছ পড়ে গেছে। এছাড়া আমার ভবনের সামনের উঠানে ফাটল ধরেছে। ফাটল ধরা জায়গা থেকে মাটি ধ্বসে গেলে আমার ভবনও ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
নজরুল ইসলাম নামের এক ব্যক্তি বলেন, সরকারি কাজের ক্ষেত্রে সাইনবোর্ড রাখার নিয়ম আছে। কাজের সব তথ্য এলাকাবাসীকে জানানো হবে। কিন্তু এই বাঁধ নির্মাণ কাজের কোনো তথ্য আমাদের জানানো হয়নি। এমনকি শিডিউল সম্পর্কে এলাকার মানুষকে জানানো হয়নি। এলাকার অনেকেই পানি উন্নয়ন বোর্ডের অফিসে গেছে, কাউকে শিডিউল দেখানো হয়নি।
স্থানীয় ইউপি সদস্যের পক্ষ থেকে বাঁধ নির্মাণের দায়িত্ব পাওয়া মো. মারুফ হোসেন ফকির ওরফে ছোট বলেন, রাস্তাটা আমাদের খুব দরকার। স্থানীয় মোহন মেম্বর বলায় আমি মাটি কাটার সময় সাথে ছিলাম। সবাই সেচ্ছায় এই কাজের জন্য মাটি দিচ্ছে। কাউকে চাপ দেওয়া হয়নি। মেম্বর বলেছেন চার ফুট উঁচু রাস্তা হবে। তবে কাজ যেভাবে হচ্ছে- রাস্তার পাশ দিয়ে মাটি কাটা হয়েছে, তাতে অনেক জাগয়া দিয়েই ভেঙে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে।
বাঁধ নির্মাণের ঠিকাদার শেখ শহিদুল ইসলাম বলেন, ২২ বছর পর এই বাঁধের সংস্কার হচ্ছে। এটা অতি জরুরি কাজ। এখানে মাটি কিনে নেওয়ার কোনো বরাদ্দ শিডিউলে নেই। গ্রামবাসীর সহযোগিতায় আমরা কাজটা করছি।
পাউবো বাগেরহাট কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মাসুম বিল্লাহ বলেন, দরপত্র অনুযায়ী এই বাঁধটা ৩ দশমিক ৫ লেভেলে হবে। যাতে কোথাও দুই ফুট, কোথাও চার ফুট উঁচু হবে। জরুরি ফান্ড থেকে এই কাজটি করা হচ্ছে। দরপত্রে বলা আছে, মাটি ও লোকাল ম্যাটেরিয়াল দিয়ে দিয়ে কাজটি করতে হবে। বাঁধে বালুর ব্যবহার করা যাবে। তবে মাটির পরিমাণই বেশি থাকবে। বালুটা আমরা মাঝেই দেই। তবে চেষ্টা করি যত কম দেওয়া যায়। জমির মালিকদের ক্ষতিপূরণের কোনো সংস্থান আমাদের নেই।
বাংলাদেশ সময়: ১২৪৭ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১০, ২০২২
এমজে