কক্সবাজার হয়ে নৌপথে মালয়েশিয়ায় মানবপাচার উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে। পাচারকারীরা সাধারণ লোকজনকে অপহরণ করে জোরপূর্বক মালয়েশিয়াগামী ট্রলারে তুলে দিচ্ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এভাবে পাচার করার উদ্দেশ্য হলো অপহৃতদের মালয়েশিয়ায় নিয়ে জিম্মি করে স্বজনদের কাছ থেকে অর্থ আদায়।
ভুক্তভোগী ও স্বজনরা এমন তথ্য দিয়েছে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী অভিযান চালিয়ে বেশ কয়েকবার অপহৃতদের উদ্ধার ও পাচারকারীদের আটকের পরও এই তৎপরতা থামছে না। নৌপথে মানবপাচারের ক্ষেত্রে দুর্ঘটনা বা সামুদ্রিক ঝড়ে প্রাণহানিরও আশঙ্কা রয়েছে।
সম্প্রতি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী মানবপাচারকারী চক্রের এ ধরনের কয়েকটি প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়েছে।
প্রতিবছর শীত মৌসুমে কক্সবাজারের উখিয়া, টেকনাফ ও রোহিঙ্গা ক্যাম্পে মানবপাচারকারীদের তৎপরতা বেড়ে যায়। এ বছর শীত শুরুর আগেই উপকূলে সক্রিয় হয়েছে মানবপাচারকারী দালালরা। নারী-শিশুসহ স্থানীয় লোকজনকে পাচারের জন্য তুলে নিয়ে জড়ো করা হচ্ছে টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়নের বিভিন্ন পাহাড়ে, পাচারকারীদের গোপন আস্তানায়। সেখান থেকে সুযোগ বুঝে তুলে দেওয়া হচ্ছে ট্রলারে।
গত দুই সপ্তাহে বিজিবি, র্যাব ও কোস্ট গার্ড বাহারছড়ার পাহাড়ে পাচারকারীদের আস্তানায় চারটি পৃথক অভিযান চালিয়ে ১৮৭ জনকে উদ্ধার করে। এসব ঘটনায় ১৬ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
২০০৮ সালে নৌপথে মালয়েশিয়ার উদ্দেশে মানবপাচার শুরু। পরবর্তী সময়ে কক্সবাজারের সীমান্তবর্তী উপজেলাগুলোতে এর বিস্তৃতি ঘটে।
জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনারের (ইউএনএইচসিআর) তথ্য মতে, ২০১২ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত এক লাখ ২০ হাজার মানুষ নৌপথে মানবপাচারের শিকার হয়।
এ সময় অনাহার, পানিশূন্যতা ও পাচারকারীদের নির্যাতনে তিন শতাধিক মানুষের মৃত্যু ঘটে।
মানবপাচারকারী চক্রের হাতে পড়ে সব কিছু হারিয়ে পথে বসেছে অনেক পরিবার। থাইল্যান্ড ও ইন্দোনেশিয়ায় পৌঁছে দালালদের চাহিদামতো টাকা দিতে না পেরে নির্যাতনে মৃত্যুর ঘটনাও ঘটছে।
মানুষকে পণ্য বানিয়ে বিক্রি : শাহপরীর দ্বীপ উত্তরপাড়ার বাসিন্দা আব্দুল হামিদ গত বছর মানবপাচারকারী দালালদের হাত ধরে নৌপথে মালয়েশিয়া পাড়ি দেন। মুঠোফোনে তিনি জানিয়েছেন, মানবপাচারের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা।
আব্দুল হামিদ বলেন, ‘আমার এক বন্ধুর অটোরিকশা নিয়ে শাহপরীর দ্বীপ থেকে টেকনাফ আসছিলাম। তার একটি জরুরি প্রয়োজনে মেরিন ড্রাইভ যেতে হচ্ছে বলে আমাকেও সঙ্গে করে নিয়ে যায়। পরে মেরিন ড্রাইভে এসে এক ব্যক্তির কাছে তার অটোরিকশাটি দিয়ে আমাকে বলে, ‘চল, মালয়েশিয়া যাই। ’
হামিদের ভাষ্য, বন্ধুটি জানায়, মালয়েশিয়া যেতে কোনো টাকা লাগবে না। তাঁদের সেখান থেকে টেকনাফের মহেশখালীয়াপাড়া মেরিন ড্রাইভসংলগ্ন এলাকায় একটি বাড়িতে নিয়ে আসেন এক ব্যক্তি। বাড়িতে তিন দিন রাখার পর তাঁর ওই বন্ধু তাঁকে রেখে পালিয়ে যান। পরে হামিদও পালিয়ে যেতে চাইলে একজন বলে, ‘তোমার বেচাবিক্রি হয়ে গেছে, পালানোর সুযোগ নাই। ’
হামিদ বলেন, ‘তখন আমি বুঝতে পারি, আমার বন্ধু আমাকে মালয়েশিয়া নেওয়ার কথা বলে কৌশলে পাচারকারীদের কাছে বিক্রি করে দিয়েছে। তিন দিন পর এক রাতে আমাদের প্রায় ৬০ জনের একটি দলকে ছোট ছোট নৌকায় করে মাঝ সাগরে নোঙর করা বড় ট্রলারে তোলা হয়। ’ তিনি জানান, সেখান থেকে মালয়েশিয়া পৌঁছানোর আগে মারধর করে তাঁর পরিবারের কাছ থেকে তিন লাখ ৮০ হাজার টাকা আদায় করে দালালরা।
আব্দুল হামিদের মা খাদিজা আকতার বলেন, ‘ছেলেকে আট-দশ দিন খুঁজে না পেয়ে ভেবেছিলাম অপহৃত হয়েছে। দুই সপ্তাহ পরে আমার এক নিকট প্রতিবেশী আমাকে জানান, ছেলে ট্রলারে করে মালয়েশিয়া গেছে, সঙ্গে তাদের এক ছেলেও আছে। দালালদের হাতে জিম্মি থাকার পর আমাদের বলা হলো তিন লাখ ৮০ হাজার টাকা জোগাড় করতে। আমাদের ঘরে অভাব, এত টাকা কোথায় পাই? স্বজনদের কাছে ধার করে এবং আমার বিবাহিত দুই মেয়ের গয়না বিক্রি করে কোনো মতে ছেলেকে মুক্ত করেছি। ’
আট ধাপে হাত বদলে মালয়েশিয়া : ভুক্তভোগীদের তথ্য অনুযায়ী, নৌপথে পাচারের উদ্দেশ্যে ধরে আনা লোকজনকে মালয়েশিয়া পৌঁছাতে আট ধাপে হাত বদল হয়। এর পাঁচ ধাপ বাংলাদেশে ও তিন ধাপ থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ায়। ট্রলারে ওঠা পর্যন্ত ধাপগুলো যথাক্রমে তথ্য দাতা, রোড মাস্টার, জমাদার, নৌট্রিপ ও ট্রলার পার্টি নামে পরিচিত। তথ্য দিয়ে দালাল রোড মাস্টারের কাছে তুলে দেয় পাঁচ হাজার টাকায়। রোড মাস্টার তাকে ১০ হাজার টাকায় পৌঁছে দেয় পাহাড়ি জমাদারদের কাছে। সেখান থেকে জমাদাররা নৌ ট্রিপে ট্রলারে তুলে দেয় ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকায়। ট্রলারগুলো থাইল্যান্ড ও ইন্দোনেশিয়ার সীমানায় পৌঁছে সেখানকার দালালদের কাছে মাথাপিছু এক থেকে দেড় লাখ টাকা দিয়ে বিক্রি করে দেয়।
বাংলাদেশ থেকে সাগরের নৌপথ পাড়ি দিয়ে থাইল্যান্ড বা ইন্দোনেশিয়া সীমানায় পৌঁছানোর পর সেখানে শুরু হয় টাকা আদায়ের কৌশল। মানবপাচারের শিকার এক ব্যক্তিকে অন্তত সাড়ে তিন লাখ টাকা দিতে হয়। এরপর ঝোপ-জঙ্গল দিয়ে তাদের ঠেলে দেওয়া হয় মালয়েশিয়ায়। অনেক সময় মাস্টার দালাল থাইল্যান্ডেই আদায় করে নেয় দাবি করা টাকা। টাকা আদায় করতে না পারলে ভুক্তভোগীর ওপর নেমে আসে নির্মম নির্যাতন। এসব নির্যাতনের দৃশ্য হোয়াটসঅ্যাপে ভিডিও কলের মাধ্যমে পরিবারের সদস্যদের দেখানো হয়। বাধ্য হয়ে স্বজনরা পাচারকারীদের চাহিদামতো টাকা পরিশোধ করে।
পাচারকারীদের লক্ষ্যবস্তু যারা : টেকনাফ ও উখিয়ায় শুরুর দিকে পাচারকারীদের লক্ষ্য ছিল শুধু স্থানীয় বাসিন্দারা। বর্তমানে তাদের বড় লক্ষ্যবস্তু উখিয়া ও টেকনাফে আশ্রিত রোহিঙ্গারা। মালয়েশিয়ায় উন্নত জীবনযাপনের লোভ দেখিয়ে মানবপাচারকারী দালালরা রোহিঙ্গাদের উদ্বুদ্ধ করছে।
উখিয়া ও টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে অন্তত ৫০টির বেশি দালালচক্র সক্রিয় রয়েছে। এরা ক্যাম্পে সাধারণ রোহিঙ্গাদের মতো চলাফেরা করে। সুযোগ বুঝে বিভিন্নজনকে মিথ্যা প্রলোভন দেখিয়ে ক্যাম্পের বাইরে এনে পাচারচক্রের হোতাদের কাছে তুলে দেয়।
টেকনাফের হ্নীলা মৌলভীবাজার এলাকার বাসিন্দা নুরুল আমিন বলেন, যে অবস্থা শুরু হয়েছে, একা কোথাও বের হতেও ভয় করে। ছেলেদের ঘর থেকে বের করাটা ঝুঁকিপূর্ণ। স্বেচ্ছায় যারা যাচ্ছে তাদের নিয়ে যাক, কিন্তু জোরপূর্বক অপহরণ করে মালয়েশিয়ার ট্রলারে তুলে দেওয়ার মতো জঘন্য অপরাধ কর্মকাণ্ডের চক্রগুলো দিন দিন অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠছে।
ঝুঁকির পথ বেছে নিচ্ছে অনেকে : রোহিঙ্গাদের মধ্যে অনেকে মালয়েশিয়া যেতে আগ্রহী। তাদের ক্ষেত্রে জাতীয় পরিচয়পত্র ও পাসপোর্ট তৈরি করে বৈধভাবে বিদেশে যাওয়া বেশ কঠিন। তাই তারা নৌপথে মালয়েশিয়া যাওয়ার ক্ষেত্রে উৎসাহী।
উখিয়ার বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দা আব্দুস সালাম বলেন, রোহিঙ্গাদের একটি বড় অংশ মালয়েশিয়া অবস্থান করছে। তারা বিভিন্ন সময়ে নৌপথে ট্রলারে করে সেখানে গেছে। এখন তারা তাদের স্বজনদের সেখানে নিতে চায়। ক্যাম্পে বাস করা তাদের উন্নত জীবনের আশায় দালালদের মাধ্যমে ট্রলারে করে মালয়েশিয়া যাওয়ার চেষ্টা করে। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তাদেরও একই দুর্ভোগ ও নির্যাতনের শিকার হতে হয়।
স্বামীর কাছে যাচ্ছেন রোহিঙ্গা নারীরা : রোহিঙ্গা যারা মালয়েশিয়া অবস্থান করছেন, তাঁদের বেশির ভাগের স্ত্রী-সন্তান বাংলাদেশের ক্যাম্পে রয়েছে। প্রবাসী রোহিঙ্গারা তাঁদের স্ত্রী-সন্তানদের মালয়েশিয়া নিয়ে যেতে দালালদের শরণাপন্ন হন। দালালরা টাকার বিনিময়ে ঝুঁকিপূর্ণ নৌপথে এসব স্ত্রী-সন্তানকে মালয়েশিয়ায় নেওয়ার ব্যবস্থা করে এবং প্রায়ই নৌ দুর্ঘটনায় মৃত্যুর ঘটনা ঘটে।
মালয়েশিয়ার পথে নৌ দুর্ঘটনা : ২০২২ সালের ৪ অক্টোবর টেকনাফের বাহারছড়া সাগর এলাকায় রোহিঙ্গাদের নিয়ে মালয়েশিয়াগামী একটি ট্রলার ডুবে যায়। এতে ৩৪ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হলেও চারজনের মৃত্যু ঘটে।
২০২০ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি সেন্ট মার্টিনের পশ্চিমে বঙ্গোপসাগরে মালয়েশিয়াগামী একটি ট্রলারডুবির ঘটনায় চার শিশুসহ ১৯ জন রোহিঙ্গার মৃত্যু ঘটে। এ ঘটনায় আরো ৭২ জনকে জীবিত উদ্ধার করে কোস্ট গার্ড।
স্থানীয়রা যা বলছে : টেকনাফ সরকারি কলেজের অধ্যাপক শফিকুল ইসলাম বলেন, নৌপথে মানবপাচারে দেশ ও দেশের বাইরে বেশ কয়েকটি দালালচক্র সক্রিয়। তাদের কঠোরভাবে দমন করা না গেলে নৌপথে মানবপাচার আরো বেড়ে যাবে।
টেকনাফের সাবরাং ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান হামিদুর রহমান বলেন, কতটা ঝুঁকি নিয়ে মানুষকে সাগরে নৌপথে মালয়েশিয়া পাঠানো হয় তা বলার ভাষা নেই। এসব কর্মকাণ্ডে জড়িত অপরাধীদের ধরতে এখনই কঠোর উদ্যোগ না নিলে আসন্ন শীত মৌসুমে আমাদের আরো ভয়ংকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে।
প্রশাসনের ভাষ্য : টেকনাফের ২ বিজিবি অধিনায়ক লে. কর্নেল মো. আশিকুর রহমান বলেন, ‘মানবপাচারের বিরুদ্ধে আমরা জিরো টলারেন্স নীতি অনুসরণ করছি। গত এক সপ্তাহে শাহপরীর দ্বীপ, কচ্ছপিয়া পাহাড়ে অভিযান চালিয়ে নৌপথে মালয়েশিয়া পাচারের একাধিক চেষ্টা ব্যর্থ করতে সক্ষম হয়েছে বিজিবি। ’
টেকনাফ মডেল থানার ওসি আবু জায়েদ মো. নাজমুন নুর বলেন, মানবপাচারকারীরা নিজেদের যতই শক্তিশালী ভাবুক, মানবপাচারচক্রের মুলোৎপাটনে পুলিশ বদ্ধপরিকর। মানবপাচারচক্রে জড়িত ব্যক্তিরা কোনোভাবে রেহাই পাবে না।
সূত্র: কালের কণ্ঠ