ঢাকা, শনিবার, ২৭ আশ্বিন ১৪৩১, ১২ অক্টোবর ২০২৪, ০৮ রবিউস সানি ১৪৪৬

জাতীয়

লাউয়াছড়ার গহীনে কি আছে

সেরাজুল ইসলাম সিরাজ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৫৪৯ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৪, ২০১৬
লাউয়াছড়ার গহীনে কি আছে ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

২৯৩ নম্বর পিলার। এদিকটায় পর্যটকদের পদচারণা খুব একটা নেই। এর কারণ, দূরত্ব। এখানে যেতে তিন কিলোমিটার হাঁটতে হয়। অর্থাৎ যাওয়া-আসা মিলে ছয়-সাত কিলোমিটারের ধাক্কা।...

লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান থেকে: ২৯৩ নম্বর পিলার। এদিকটায় পর্যটকদের পদচারণা খুব একটা নেই।

এর কারণ, দূরত্ব। এখানে যেতে তিন কিলোমিটার হাঁটতে হয়। অর্থাৎ যাওয়া-আসা মিলে ছয়-সাত কিলোমিটারের ধাক্কা।

লাউয়াছড়ার গহীনে এই স্থানটি দেখতে গিয়ে বেশ অবাকই হতে হলো। গহীন হওয়ায় অনেকটা ঘন অরণ্যে ঢাকা থাকার কথা। কিন্তু যা দেখলাম তাতে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতেও কষ্ট হচ্ছিলো।

চাপালিশ, কাঁঠাল, সেগুনসহ নানা প্রজাতির গাছ-গাছালি দেখতে অবিকল সুপারির গাছের মতো। ডগায় কিছু ডালপালা ছাড়া কাণ্ডে কোনো ডালপালা নেই। প্রায় কয়েক কিলোমিটার জুড়ে গাছের ডালপালা কেটে সাবাড় করা হয়েছে।  ছেঁটে ফেলা হয়েছে কিছু গাছের ডগা ও নিচের ঘাসগুলোও। কেটে রাখা ডালগুলো শুকিয়ে বাদামী হয়ে গেছে।  

ডালগুলো কাটা হয়েছে পান চাষের ক্ষেত্র তৈরির জন্য। ডালপালা আচ্ছাদিত গাছে পানের ফলন ভালো হয় না। আবার মাঝে মাঝে ডগা ছেঁটে দেওয়ার কারণ হচ্ছে, একটু করে রোদ প্রবেশ না করতে পারলে সেখানেও পানের ফলন পাওয়া যায় না।  

এক কিলোমিটার দূরে আগে থেকেই খাসিয়াদের পান চাষ রয়েছে। কিন্তু এ জায়গাটিতে আগে পান চাষ ছিল না।

কর্মরত শ্রমিক রুবেল তংপেয়ার জানান, গাছগুলো লাউয়াছড়া পুঞ্জির মন্ত্রী শ্রমিকদের দিয়ে ছেঁটে দিয়েছেন। তিনিও মন্ত্রীর কাজেই এখানে এসেছেন।

পাশেই রয়েছে একটি লেবু বাগান। লেবু গাছের আশপাশে আগাছা জন্মাতে দেওয়া হয়নি। নিয়ম করে আগাছা ছেঁটে দেওয়ায় লেবু বাগানের সুদূরপ্রসারী ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে লাউয়াছড়ায়।

বাগানে দেওয়া হয় কীটনাশক। এতে মারা পড়ছে নানা জাতের কীট-পতঙ্গ। আর সেসব মৃত পতঙ্গ খেয়ে মারা পড়ছে পাখি। বিষে আক্রান্ত পাখি খেয়ে মারা পড়ছে সরিসৃপসহ অন্য প্রাণীরাও।

পান ও লেবু চাষের এ রমরমা অবস্থা লাউড়াছড়ার মাগুরছড়া পুঞ্জি (খাসিয়া পল্লী) এলাকায়ও। অল্প কিছু এলাকা রয়েছে পান চাষমুক্ত। সেসব এলাকায় দিনের বেলায় গেলেও গা ছমছম করবে। গাছগুলোর শেকড় থেকে শীর্ষ পর্যন্ত কোথাও কাণ্ডের দেখা পাওয়া যাবে না। ডাল ও কাণ্ড নানা ধরনের পরগাছায় আচ্ছাদিত। আবার নিচেও ঘন জঙ্গলে পরিপূর্ণ।

কিন্তু ভিন্ন চিত্র খাসিয়া পুঞ্জির চারপাশে। কয়েক কিলোমিটার জুড়ে গাছগুলোতে ডগা ছাড়া ডালপালা কিছুই নেই। ডালপালাহীন বন এলাকার নিচেও কোনো ঝোপ-ঝাড় নেই। ডগা ছেঁটে দেওয়া অনেক গাছ মরে শুকিয়ে গেছে।

কাগজে-কলমে লাউড়াছড়া জাতীয় উদ্যানের আয়তন ১ হাজার ২শ’ ৫০ হেক্টর হলেও প্রকৃত বন বড়জোর ৩শ’ হেক্টর হবে। আর বাকিটা অ্যাগ্রো ফরেস্টে পরিণত হয়েছে।  

১৯৮৩ সালে ৬৩টি খাসিয়া পরিবারকে ভিলেজার হিসেবে ১৫৭ একর জমি লিজ দেওয়া হয়। এরপর কয়েক বছর লিজ নবায়ন করা হয়েছে। কিন্তু সংরক্ষিত বনাঞ্চল ঘোষণার প্রস্তুতিকালে ১৯৯০ সাল থেকে আর নবায়ন করা হয়নি।  

কিন্তু বহাল তবিয়তে চলছে পান চাষ। দিন দিন বাড়ছে এর কলেবর। জীবিকার জন্য সীমিত আকারে পান চাষের কথা থাকলেও খাসিয়ারা এখন নেমেছেন পান রফতানিতেও। সে আয়ে হাকাচ্ছেন বিলাশবহুল পাজেরো জিপ। আর গাড়ির জন্য বন কেটে নির্মাণ করা হয়েছে গ্যারেজ।

১২০ বছর বয়সী লাউয়াছড়া বন্যপ্রাণী আর গাছ-লতার জীবন্ত সংগ্রহশালা। সারা বিশ্ব থেকে লোক ছুটে আসছেন দর্শন ও গবেষণার জন্য। কিন্তু দিন দিন উজাড় হয়ে যাচ্ছে সেই সংগ্রহশালাও।

মৌলভীবাজার বণ্যপ্রাণী রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক তবিবুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, ২০১২ সালের ‘ওয়াইল্ড লাইফ প্রটেকশন’ আইনে এসব কর্মকাণ্ড কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। গাছের ডাল দূরের কথা, একটি ঘাসও ছেঁড়ার কোনো সুযোগ নেই। এমনকি কোনো গাছ মারা গেলেও সেটি সরিয়ে নেওয়া যাবে না। পচে সেখানে কীটের জন্ম হবে। সেই কীটকে উপজীব্য করে বেঁচে থাকবে অন্য প্রজাতির প্রাণী।

সিলেট বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মিহির কুমার দো বাংলানিউজকে জানান, ‘গাছের ডাল কাটার বিষয়টি আমার নজরেও এসেছে। আমরা তদন্ত করে আইনানুগ ব্যবস্থা নেবো’।

কতো জায়গায় খাসিয়াদের পান চাষ রয়েছে- প্রশ্নের জবাবে মিহির কুমার দো বলেন, ‘সম্প্রতি কোনো সার্ভে করা হয়নি। তবে তারা অনেক বেশি জায়গায় পান চাষ করছেন, এ কথা বলতে পারি’।

বাংলাদেশ সময়: ১১৪৪ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৪, ২০১৬
এসআই/এএসআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।