ঢাকার অদূরে সাভারের ধামরাই বাজারের কেন্দ্রেই ‘ধামরাই মেটাল ক্রাফটস’ নামে একটি মালিকানাধীন কাঁসা-পিতলের কারখানা। এখানে কাঁসা-পিতলের বিভিন্ন মূর্তিসহ প্রয়োজনীয় দৈনন্দিন ব্যবহার্য তৈজসপত্রসহ ঘর সাজানোর সরঞ্জামাদি বানানো হয় গত প্রায় ২০০ বছর ধরে।
৭৫০ খ্রিস্টাব্দে গৌড়ের সম্রাট পদে গোপালের নির্বাচনের সঙ্গে সঙ্গে পাল সাম্রাজ্যের পতন ঘটে। অধুনা বাংলা ও বিহার ভূখণ্ড ছিল পাল সাম্রাজ্যের প্রধান কেন্দ্র। পাল সম্রাটরা ছিলেন প্রাজ্ঞ কূটনীতিবিদ ও যুদ্ধজয়ী। তাদের সেনাবাহিনীর বৈশিষ্ট্য ছিল একটি বৃহৎ যুদ্ধহস্তী বাহিনী। তাদের নৌবাহিনী বঙ্গোপসাগরে বাণিজ্যিক ও প্রতিরক্ষামূলক ভূমিকা পালন করতো। তারা ছিলেন ধ্রুপদী ভারতীয় দর্শন, সাহিত্য, চিত্রকলা ও ভাস্কর্য শিল্পের বিশিষ্ট পৃষ্ঠপোষক। এ কারণে তাদের হাত ধরেই তৎকালীন এ বাংলা ভূখণ্ডেই অনেক শিল্পকলার নিদর্শন রয়ে গেছে।
বাংলার সেই ঐতিহ্যগত নিদর্শনগুলোকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে চেনাতে স্ব-উদ্যোগে কাজ করে যাচ্ছে ধামরাই মেটাল ক্রাফটস। শুধুমাত্র ছবি দেখে পাল রাজাদের বানানো কাঁসা-পিতলের মূর্তি বানাচ্ছে এ প্রতিষ্ঠানটি। তাছাড়া এ কারখানা বা ওই প্রাচীন ডিজাইনের বাড়িটিতেই হবে কাঁসা-পিতলের তৈরি জিনিসপত্রের একটি জাদুঘর। আর প্রতিষ্ঠানটির মালিকের মূল ঐতিহ্যগত এ কাঁসা-পিতলের পণ্যগুলোকে টিকিয়ে রেখে বাঙালি প্রাচীন সংস্কৃতিকে আরও শক্তিশালী করা।
বর্তমান সময়ে কাঁসা-পিতলের তৈরি জিনিসপত্রের ব্যবহার দেশে একেবারে নেই বললেই চলে। শুধুমাত্র উপমহাদেশের সনাতন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে ও কিছু কিছু অঞ্চলের মানুষদের কাছেই বেঁচে আছে পণ্যগুলো। যে কারণে ভারত এ ঐতিহ্যকে ধরে রেখে সুনাম কুড়ালেও পিছিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ। কেননা ঐতিহ্যগত জিনিসপত্র যেকোনো দেশের সুনাম বাড়ায় বলে মত প্রকাশ করেন সংশ্লিষ্টরা।
ধামরাইয়ের মেটাল ক্রাফটসে কাঁসা-পিতলের পণ্যগুলো কীভাবে বানানো হয় সে বিষয়ে কারখানার কারিগররা বাংলানিউজকে বলেন, আমরা লস্ট ওয়াক্স পদ্ধতিতে এগুলো বানাই। এ পদ্ধতিটি প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগের। কিন্তু স্বয়ংক্রিয় মেশিন ছাড়া এ পদ্ধতিতেই অত্যন্ত সূক্ষ্ম কাজ করা যায়। যদিও সময় অনেক বেশি লাগে। কিন্তু ক্ষুদ্র ডিজাইনের চমক দেখাতে এ পদ্ধতিটিই সেরা। এ পদ্ধতিতে প্রথমে মোমের তৈরি ছাঁচ বানাতে হয়। সেখানে গলিত কাঁসা-পিতল ঢেলে সেটা ঠাণ্ডা হলে আবার সূক্ষ্ম কাজ করতে হয়। অনেক সময় ছাঁচ বা ডাইস বানাতে ভুল হলে আবার প্রথম থেকে কাজটা শুরু করতে হয়।
সামগ্রিক বিষয়ে ধামরাই মেটাল ক্রাফটসের মালিক সুকান্ত বণিক বাংলানিউজকে বলেন, বাংলাদেশ থেকে কাঁসা-পিতল দিয়ে তৈরি পণ্যের ঐতিহ্য হারিয়ে গেছে, শুধুমাত্র সেটা ফিরিয়ে আনার কাজ করছি আমি। সে ধরনের জিনিসপত্র নিয়ে একটি জাদুঘর বানাবো। কাঁসা-পিতলের জিনিসপত্র তৈরি করতে যে ঐতিহ্যবাহী পদ্ধতিগুলো ছিল যেমন- লস্ট ওয়াক্স, স্যান্ড কাস্টিং, পটারি কাস্টিং, হ্যামারিং ইত্যাদি পদ্ধতিগুলোর বর্ণনাও এখানে থাকবে। আমার লক্ষ্য শুধুমাত্র এ পণ্যগুলোর প্রদর্শন নয়, এগুলো কীভাবে বানানো হয় সে সম্পর্কেও দেশের মানুষজন অবগত থাকবে, বিশেষ করে তরুণ সমাজ। তিনি আরও বলেন, তাছাড়া দেশে আসা কিংবা পিতল দিয়ে তৈরি সবচেয়ে ভালো কাজ হয়েছে পাল রাজাদের আমলে। সেগুলো আবার আমি ফিরিয়ে আনার জন্য কাজ করছি। পাল রাজাদের মূর্তিগুলোর এক একটি সিরিজ করে আমি বানাবো। আমি হুবুহু সেসময়ের কাজগুলোর অবলম্বনে মূর্তিগুলো তৈরি করছি এবং একটি প্রদর্শনী করবো। এ প্রদর্শনী দেশ ও দেশের বাইরে করার ইচ্ছা আছে। এতে আমাদের এ ঐতিহ্য ব্যাপকভাবে সমাদৃত হবে। পাল রাজাদের আমলে যে কাজগুলো হয়েছে সেগুলো অনেক সূক্ষ্ম ও বিরল। এগুলোকে ফিরিয়ে আনতে পারলেই আমরা জাতিগতভাবে ব্যাপক ধনী হবো। মূর্তিগুলো বানানোর কাজ চলছে। এক বছরের মতো সময় লাগবে। এ এক বছরে আমরা ৪০ থেকে ৫০টি মূর্তির একটি সিরিজ বানাতে পারবো।
দেশের কাঁসা-পিতল শিল্পের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে সুকান্ত বণিক বলেন, কাঁসা-পিতল শিল্প বাংলাদেশে একটি রুগ্ন শিল্প না, এটি একটি মৃতশিল্প। বাংলাদেশের যেখানে যারা এ কাজগুলো করছেন, তারা সাধারণত অন্য কোনো কাজ পারছেন না বলেই এ ধরনের কাজ করছেন। আবার তরুণরাও এ কাজে আগ্রহী হচ্ছে না। কারণ বাংলাদেশের একজন রিকশাওয়ালা দিনে যে পরিমাণ টাকা উপার্জন করেন, কাঁসা-পিতলের পণ্য বানিয়ে বাজারে বিক্রি করে দিনে তার অর্ধেক পরিমাণ টাকাও উপার্জন করা সম্ভব নয়। সেখানে কারিগররা তো আরও কম টাকা পান। আমাদের এখানে ২২ জন কারিগর ছিল। তার থেকে কমতে কমতে এখন মাত্র পাঁচজন রয়েছেন। এ যে পাঁচজন কাজ করছেন, তাদের অবস্থাও খুব খারাপ। কেননা আমাদের প্রতিদিন কাজ থাকে না। মাঝে মধ্যে অল্প কাজের অর্ডার থাকে।
এক্ষেত্রে কমপক্ষে আমাদের একটি উদ্যোগ দরকার, যে উদ্যোগের মাধ্যমে এ ঐতিহ্যবাহী শিল্প সম্পর্কে দেশের মানুষজন জানতে পারবে এবং আগামী প্রজন্মকে জানানো সম্ভব হবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
বাংলাদেশ সময়: ০৯২৯ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৬, ২০১৯
এমএএম/আরবি/