১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সহযোদ্ধার মৃত্যু আজও তাড়া করে বেড়ায় কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার সদরপুর গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা আফসার আলীকে। অনেক স্মৃতি ভুলে গেলেও সহযোদ্ধার শহীদ হওয়ার এই দৃশ্যটি আজও চোখ বন্ধু করলেই না-কি দেখতে পান তিনি।
বাংলানিউজের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে মুক্তিযোদ্ধা আফসার আলী বলেন, আমি তখন দশম শ্রেণির ছাত্র। মারফত ভাই ছিল কুষ্টিয়া সরকারি কলেজ ছাত্রলীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক। তার হাত ধরেই ছাত্রলীগ করতাম। ছাত্রলীগের ডাকে বিভিন্ন সময় সংগ্রাম, আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। মিছিল-মিটিংয়ে যেতাম মারফত ভাইয়ের সঙ্গে। ৭০ এর নির্বাচনের পর পাকিস্তান সরকার ক্ষমতা না ছাড়ার কারণে আমরা তাদের বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠেছিলাম।
তিনি বলেন, ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ যখন বঙ্গবন্ধু ভাষণ দিয়েছিলেন, তখন মারফত ভাইয়ের কথা মতো আমরা প্রায় মরিয়া হয়ে গিয়েছিলাম যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেওয়ার জন্য। তখন আমরা ভারতে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। আমি চার ভাইয়ের মধ্যে সবার ছোট। বাড়িতে তখন মাকে বলেছিলাম ভারতে যাব। দেশের মানুষের জন্য যুদ্ধে যাওয়া ছাড়া কোন উপায় নেই। তারপর পরিবারের লোকজনও আমাকে উৎসাহ দিলে আমি ভারতে যাই।
‘এরমধ্যে রাজাকার ও পাকসেনারা আমি যুদ্ধে গেছি, তা জানতে পেরে যায়। আমার আব্বাকে তারা তাদের ক্যাম্পে ধরে নিয়ে যায়। অনেক অত্যাচার করে। আমার আব্বাকে অনেক টর্চার করেও যখন আমার খোঁজ পায়নি, তখন আমার আব্বাকে ছেড়ে দেয়। ’
আফসার আলী বলেন, আমি ভারতে চলে গেছি। প্রথমে অভ্যর্থনা ক্যাম্পে গিয়ে যুদ্ধের প্রাথমিক প্রশিক্ষণ নিলাম। তারপর সেখানে প্রশিক্ষণ শেষে উচ্চ প্রশিক্ষণের জন্য বিহারে চলে যাই। বিহারের চাকুলিয়া থেকে বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র চালানো এবং গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিয়েছি। আমি ৩৬ গ্রেনেড, ৭৬ গ্রেনেড, এসএলআর, এসএমজি, এসএমসি, থ্রি নাট থ্রি, থ্রি নাট ফোর চালানোর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করি। এরপর আমরা ১৪ থেকে ১৫ জনের একটা গ্রুপ করে দেশে চলে আসি। তখন আমার কাছে ছিল একটা এসএমসি।
এরপর মারফত ভাইয়ের নেতৃত্বে আমরা বিভিন্নস্থানে গেরিলা যুদ্ধে অংশ নিই। আমার কাছে সবচেয়ে বড় যুদ্ধ ছিল কাকিলাদহের যুদ্ধ। সেখানেই আমার সহযোদ্ধা, বন্ধু জহুরুলকে হারিয়েছিলাম। জোর করেও আটকাতে পারিনি তাকে। পরে তার কথা মতো তার লাশটা যুদ্ধ শেষে বাড়িতে পৌঁছে দিয়েছিলাম। আমরা একটা সূত্রে বিশ্বাসী ছিলাম ‘হিট অ্যান্ড রান (মারতে হবে এবং চলে আসতে হবে)’। হিট করব, মরব কী বাঁচব তার কোন ঠিক নেই। কাকিলাদহ ভয়াবহ যুদ্ধে আমাদের গ্রুপের কমান্ডার ছিল নওদা আজমপুরের আ.স.ম মুসা। তবে এই যুদ্ধের নায়ক ছিল মারফত ভাই।
যুদ্ধের স্মৃতি তুলে ধরে তিনি বলেন, একসঙ্গে বেশ কয়েকজন থাকতাম। কোথায় থাকতাম, কার বাড়ি থাকতাম, তার কোনো ঠিক থাকতো না। একবার আমাদের শরীরে চর্মরোগ দেখা দেয়। সে সময় খুব ভুগেছিলাম। রোগটা আমার বেশি হয়েছিল। পরে মুসা ভাই আমাদের জন্য জীবন বাজি রেখে মলম এনে দিয়েছিল।
তিনি বলেন, কাকিলাদহ সম্মুখ যুদ্ধ ছাড়াও মিরপুর উপজেলার নওদাপাড়া ব্রিজের কাছ থেকে বেশ কয়েটি রাজাকারকে ধরে নিয়ে এসেছিলাম। আমরা চারদিক থেকে ঘেরাও করি। তখন তারা আমাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে।
‘একদিন খুব ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিলাম আমি। অনেক দূর পর্যন্ত দৌড়েছিলাম। হাঁটার শক্তি ছিল না প্রায়। দৌলতপুর উপজেলার লক্ষ্মীপুরের আবু বক্কর সিদ্দিক মাস্টার আমাকে মাঠের ভেতর থেকে উদ্ধার করে নিয়ে আসেন। তিনি কোলে করে নিয়ে আসেন আমাকে। তিনি না সাহায্য করলে আমি মাঠ থেকে আসতে পারতাম না। ’
সদরপুর গ্রামের শেখ ছিলাত আলীর ছোট ছেলে গেরিলা এই মুক্তিযোদ্ধার দিন কাটে এখন ছোট্ট নাতি আরিয়ানের সঙ্গে। স্বপ্ন দেখেন নাতিটি বড় হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বুকে নিয়ে। টিনের ছোট্ট ঘরে মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে ইতিহাস জানানোর জন্য একটা কক্ষ রেখেছেন তিনি। সেখানে প্রতিনিয়তই স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী, প্রতিবেশী, সুধীজন আসেন তার গৌরবময় ইতিহাস জানতে।
আরও পড়ুন>> বলেছিলাম- যুদ্ধে মরলে লাশটা মায়ের কাছে পৌঁছে দিও’
বাংলাদেশ সময়: ১৬৪৬ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৬, ২০১৯
টিএ