ঢাকা, মঙ্গলবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

৬ ডিসেম্বর বিজয়ের আনন্দে মেতে উঠেছিল লালমনিরহাটবাসী

খোরশেদ আলম সাগর, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২২১০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৬, ২০১৯
৬ ডিসেম্বর বিজয়ের আনন্দে মেতে উঠেছিল লালমনিরহাটবাসী

লালমনিরহাট: ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে বিতাড়িত করে বিজয় আনন্দে মেতে উঠে উত্তরের সীমান্তবর্তী জেলা লালমনিরহাটের মানুষ। 

প্রবীণ ও মুক্তিযোদ্ধাদের বর্ণনায় জানা গেছে, ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষন ও স্বাধীনতা যুদ্ধের ঘোষণায় বাঙালিরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে দেশমাতৃকাকে হানাদার মুক্ত করতে উজ্জীবিত হয়ে উঠে। ২৫ মার্চ কালোরাতে পাকিস্তানি সরকারের নির্দেশে পাকিস্তানি সেনারা নিরস্ত্র বাঙালি জাতির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ।

বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমানকে গ্রেফতারের পর বাঙালিরা আরও বেশি ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। দেশকে শত্রুমুক্ত করে চূড়ান্ত বিজয়ের লক্ষে জীবনবাজি রেখে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে সর্বস্তরের মানুষ। সারাদেশের মতোই উত্তাল হয়ে ওঠে বিহারি অধ্যুষিত রেলওয়ের বিভাগীয় শহর লালমনিরহাটের পাড়া-মহল্লা।  

২৬ মার্চ আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতা ঘোষণার পর ২৭ মার্চ দুপুরে লালমনিরহাটের মুক্তিকামী মানুষ মিছিল নিয়ে রেলওয়ের আপইয়ার্ড কলোনি পার হওয়ার সময় পাকিস্তানিদের সঙ্গে গোলাগুলি শুরু হয়। পাকিস্তানি ইপিআর জিয়াউল হকের গুলিতে মারা যান শহীদ শাহজাহান। প্রথম শহীদ শাহজাহানকে তার বাড়ির পাশে দাফন করা হয়। মুক্তিযুদ্ধে লালমনিরহাটে ২৯ জন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার নাম পাওয়া গেলেও স্বাধীনতার ৪৯ বছরেও অসংখ্য শহীদের মরদেহের সন্ধান মিলেনি।  

পাকিস্তানি বাহিনীকে সহায়তা করতে গঠিত হয় রাজাকার আল বদর, আল সামস। তারাও পাকসেনাদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে নিরস্ত্র বাঙালির উপর নির্মম অত্যাচার ও নির্যাতন চালায়। মা বোনদের সম্ভ্রমহানী করে প্রতিটি বাড়িতে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে পাকিস্তানি বাহিনী ও তার দোসর আল বদর, আল সামস তথা রাজাকাররা।  

রেলওয়ের শহর লালমনিরহাটের নিরস্ত্র বাঙালিদের ধরে এনে নির্মম নির্যাতন ও হত্যা করে তৎকালীন ডিআরএম ভবনের পেছনের ডোবায় মরদেহ ফেলে রাখে পাকিস্তানি বাহিনী ও তার দোসররা। পরবর্তিতে ডিআরএম ভবনের পেছনটা গণকবর হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। সংরক্ষণ করা হয় ৭১ এর সেই গণকবর। বিভিন্ন জাতীয় দিবসে শ্রদ্ধাঞ্জলীসহ মোমবাতি প্রজ্জ্বলন করে জাতি আজও স্মরণ করে বীর শহীদদের।  

মুক্তিযুদ্ধকালীন দেশে মোট ১১টি সেক্টরের মধ্যে লালমনিরহাট অঞ্চল ছিল ৬ নম্বর সেক্টরের অধীনে। দেশের অভ্যন্তরে থাকা একমাত্র ৬ নম্বর সেক্টরটি ছিল পাটগ্রাম উপজেলার বুড়িমারী হাসর উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ে। এ সেক্টরের কমান্ডর ছিলেন এম, খাদেমুল বাশার। তার দক্ষ নেতৃত্বে ও সাহসী পদক্ষেপে দুর্বার প্রতিরোধ গড়ে তুলেন মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী। ১৯৭১ সালের অক্টোবর মাসে এ সেক্টর পরিদর্শনে আসেন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজ উদ্দিন আহমেদ। প্রধানমন্ত্রীর পদচারণায় আরো সাহসী হয়ে উঠে ৬ নং সেক্টরের  সম্মিলিত বাহিনী।

২৮ ও ২৯ নভেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর প্রবল আক্রমণ চালালে ৩০ নভেম্বর  জেলার হাতীবান্ধা উপজেলা মুক্তিবাহিনীর দখলে চলে আসে। ৪ ডিসেম্বর কালীগঞ্জ, আদিতমারী ও সদর উপজেলার বড়বাড়ি আইরখামারে পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর মারাত্মক আক্রমণ চালায় মুক্তিবাহিনী। প্রবল আক্রমণের মুখে দিশেহারা পাকিস্তানি বাহিনী বিতাড়িত হলেও পরদিন পুনরায় বড়বাড়ি আইরখামারে আক্রমণ চালায়। জ্বালিয়ে দেয় বেশ কিছু ঘর-বাড়ি। ৫ ডিসেম্বর বৃষ্টিকে উপেক্ষা করে রাতভর প্রতিরোধ গড়ে তোলা মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী। অবশেষে ৬ ডিসেম্বর ভোরে বিকট শব্দে তিস্তা রেল সেতু উড়িয়ে দিয়ে শেষ বারের মত লালমনিরহাট ত্যাগ করে রংপুর ও সৈয়দপুর সেনানিবাসে পালিয়ে যায় পাকসেনারা। আর তাদের দোসর রাজাকাররা মুক্তিবাহিনীর কাছে অস্ত্র জমা দিয়ে  আত্মসমর্পণ করে।  

মুক্তির আনন্দে বিজয় উল্লাসে মেতে উঠে জেলার আমজনতা। জয় বাংলা স্লোগানে বিজয়ে মিছিলে মুখরিত হয়ে উঠে পুরো লালমনিরহাট জেলা। দেশের আকাশে পতপত করে উড়তে থাকে জাতীয় পতাকা। মুক্তিযুদ্ধে বীরত্ব প্রদর্শনের জন্য এ জেলার কৃতিসন্তান শহীদ ক্যাপ্টেন তমিজ উদ্দিন বীর বিক্রম ও ক্যাপ্টেন (অব.) আজিজুল হক বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত হন।  

৬ নং সেক্টরের বড়বাড়ি আইরখামার এলাকায় শেষ সম্মুখ যুদ্ধের বর্ণনা দিতে গিয়ে আদিতমারীর হাজিগঞ্জ এলাকার মুক্তিযোদ্ধা নুরল হক বাংলানিউজকে জানান, ৪ ডিসেম্বর রাতভর যুদ্ধ করে বড়বাড়ি থেকে পাকিস্তান সেনাদের বিতাড়িত করা হয়। কিন্তু পরদিন পুনরায় তারা রাজাকারদের আহ্বানে বাঙালির উপর আক্রমণ করলে ৫ ডিসেম্বর রাতে আবারো তুমুল বেগে আক্রমণ চালায় মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী। বৃষ্টিকে উপেক্ষা করে রাতভর আক্রমণে পরদিন ভোরে পাকিস্তানি সেনারা পালিয়ে যায়। ওই দিন বেশ কিছু সহযোদ্ধা শহীদ হন। যুদ্ধে পিপাসার্ত হয়ে মানুষের মলযুক্ত মাঠের পানি পান করে পিপাসা নিবারণ করেন এই মুক্তিযোদ্ধা।  

লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক আবু জাফর বাংলানিউজকে জানান, যথাযোগ্য মর্যাদায় ব্যাপক কর্মসূচির মধ্যদিয়ে মুক্তদিবস পালন করেছে জেলা প্রশাসন। আনন্দ র‍্যালি, আলোচনা সভাসহ নানান কর্মসূচির মধ্য দিয়ে জেলাবাসী দিবসটি উদযাপন করেছে।  

বাংলাদেশ সময়: ১৭০৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৫, ২০১৯
এসএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।