১৯৭১ সালের ৭ এপ্রিল চাঁদপুর শহরে পাক হানাদার বাহিনী দু’টি বিমান থেকে সেলিংয়ের মাধ্যমে প্রথম আক্রমণের সূচনা করে। প্রথম দিনেই হামলায় চাঁদপুর শহরের পুরান বাজারের এক নারী পথচারী নিহত হন।
মূলশহর থেকে তিন কিলোমিটার আগে চাঁদপুর সরকারি টেকনিক্যাল উচ্চ বিদ্যালয়টি অস্থায়ী ক্যাম্প তৈরি করে পাক হানাদার বাহিনী।
এ স্কুলের মাঠ থেকে প্রতিদিনের মতো লতুফা বেগম নামে এক বৃদ্ধার গরু-ছাগল বাড়ি নিয়ে যাওয়ার সময় পাক বাহিনীর সদস্যরা রাতের খাবার জোগাড় করার জন্যে প্রথম অপারেশন হিসেবে ওই বৃদ্ধাকে গুলি করে হত্যা করে এবং বৃদ্ধার একটি গরু ও একটি ছাগল নিয়ে যায়। আর পাক সেনাদের অফিসারদের জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ডের রেস্ট হাউজটি নির্ধারণ করা হয়েছিল।
নিহত লতুফা বেগমের নাতি সিরাজ মৃধা (৪৮) বাংলানিউজকে বলেন, তার দাদিকে প্রকাশ্যে হত্যা করে হানাদার বাহিনী গরু-ছাগল নিয়ে যায়। সে দূর থেকে দেখলেও কিছুই করতে পারেনি। ওই ক্ষোভ এখনো তার মনে রয়েছে।
কারিগরি উচ্চ বিদ্যালয় মাঠের বর্বরতম হত্যার প্রত্যক্ষদর্শী তরপুরুচন্ডী গ্রামের বাসিন্দা মো. নান্নু মিয়াজী বাংলানিউজকে বলেন, তিনি এবং তার বড় ভাইকে সন্ধ্যার দিকে এনে কবর খুঁড়ার জন্য নির্দেশ দেয়। তখন তারা বাড়িতে যাবে বলে জানালে তাদের পিটিয়ে আহত করে। পরে জোর করে তাদের দিয়ে তিনটি কবর খুঁড়ে। ওই কবরই মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে নিহত তিনজন পাক সেনা সদস্যকে কবর দেওয়া হয়।
৮ এপ্রিল রাতেই চাঁদপুরে অবস্থানরত ২ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা বিচ্ছিন্নভাবে হানাদার বাহিনীর ক্যাম্পে হামলা চালান। হামলা দেখে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীরা এলোপাথাড়ি গুলি ছুঁড়তে শুরু করে। তখন কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা মারাত্মক আহত হন। ৯ এপ্রিল ভোরে পাকিস্তানি মিলিটারি শহরে ঢুকে চাঁদপুর বাসস্ট্যান্ড এলাকায় ইসমাইল হোসেন ভলন্টিয়ার (৫৫) নামে এক ব্যক্তিকে গুলি করে হত্যা করে। একইসঙ্গে তারা শহরের হাসান আলী হাই স্কুলের মোড়ে আপাক ও মাখন নামে দুই যুবককে সাইকেলে চালাতে দেখে গুলি করে হত্যা করে।
এরপরেই তারা শুরু করে তাদের মূল অপারেশন কার্যক্রম। এজন্য চাঁদপুর বড় স্টেশন মোলহেড এলাকায় হানাদার বাহিনীর একটি টর্চার সেল গঠন করে। এখানে চাঁদপুর রেলপথ, সড়কপথ এবং নৌপথে যেসব যাত্রীদের সন্দেহ হয়েছে, সেসব নারী-পুরুষকে ধরে এনে অমানবিক নির্যাতন, হত্যা, ধর্ষণ করেছে। পরে ওই মরদেহগুলো মেঘনা এবং পদ্মায় ফেলে দেয়। যার সাক্ষী আজও পদ্মা-মেঘনা নদী বহন করছে।
মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি রক্ষার্থে চাঁদপুর পৌরসভা ও জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে ২০১৩ সালে বড় স্টেশনে ‘রক্তধারা’ নামে বদ্ধভূমি নির্মাণ করা হয়। এর আগে চাঁদপুরের প্রথম শহীদ মুক্তিযোদ্ধা সুশীল, সংকর ও খালেকের নামে ট্রাক রোডে নির্মাণ করা হয় ‘মুক্তিসৌধ’ এবং চাঁদপুর শহরের প্রাণকেন্দ্রে লেকের ওপর দৃশ্যত ভাসমান মুক্তিস্মৃতি সৌধ ‘অঙ্গীকার’ নির্মাণ করা হয়।
চাঁদপুর জেলা প্রশাসকের কার্যালয় সম্মুখে এ জেলায় স্বাধীনতাযুদ্ধে যারা শহীদ হয়েছেন তাদের নামের তালিকা সম্বলিত একটি স্মৃতিফলক নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়াও চাঁদপুর পৌরসভার পাঁচ রাস্তার মোড়ে পৌরসভার অর্থায়নে নির্মাণ করা হয় ‘শপথ চত্বর’।
এপ্রিল থেকে হানাদার বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের চলে দফায় দফায় গোলাগুলি। পরে গঠন করা হয় শান্তিবাহিনী। তারপর নতুন কায়দায় শান্তিবাহিনী ও পাকবাহিনী বিভিন্ন জায়গায় চালাতে থাকে বর্বর অত্যাচার ও হত্যাযজ্ঞ। ৩৬ ঘণ্টা যুদ্ধের পর পালিয়ে যায় তারা।
এভাবে ৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত পাকিস্তানের দোসররা কত লোককে হত্যা করেছে তার কোনো ইয়ত্তা নেই। চাঁদপুর জেলায় (তৎকালীন মহকুমা) সর্বশেষ যুদ্ধ সংগঠিত হয়েছিল ৭ ডিসেম্বর লাকসাম ও মুদাফ্ফরগঞ্জ মুক্ত হওয়ার পর। যৌথ বাহিনী হাজীগঞ্জ দিয়ে ৬ ডিসেম্বর চাঁদপুর আসতে থাকলে মুক্তিসেনারা হানাদার বাহিনী প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়।
চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জ উপজেলার তৎকালীন বিএলএফ কমান্ডার মুক্তিযোদ্ধা হানিফ পাটওয়ারী বাংলানিউজকে বলেন, ৭ ডিসেম্বর আমরা ফরিদগঞ্জ মুক্ত করি। আমার বাড়ি যেহেতু চাঁদপুর সেজন্য চাঁদপুর মুক্ত করার জন্য আমার বাহিনী নিয়ে ৭ ডিসেম্বর রাতে ডাকাতিয়া নদীর পূর্ব পাড়ে দেওয়ান বাড়িতে অবস্থান নেই। রাজাকারদের খোঁজখবর নিয়ে রাতে অপেক্ষা করে পরদিন ৮ ডিসেম্বর ভোরে চাঁদপুর শহরের বালুরমাঠ এলাকায় অবস্থান নেই। সেখান থেকে সিএসডি গোডাউনের পাশে এসে রাজাকারদের সঙ্গে গোলাগুলি হয়। সেখানে আমরা বেশ কয়েকজন রাজাকার হত্যা করে শহরে প্রবেশ করে থানা ও সরকারি অফিসে দখলে নিয়ে আসি। ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত এসব স্থাপনা আমাদের দখলে ছিল।
ভারতীয় গার্ডস রেজিমেন্টের নেতৃত্বে ৩১১ তম মাউন্টেন ব্রিগেড ও ইস্টার্ন সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের যৌথ আক্রমণ চালায়। দিশে না পেয়ে পাকিস্তান ৩৯ অস্থায়ী ডিভিশনের কমান্ডিং কর্মকর্তা মেজর জেনারেল রহিম খানের নেতৃত্বে দু’টি জাহাজে করে নৌপথে ঢাকার উদ্দেশ্যে চাঁদপুর থেকে পালিয়ে যাওয়ার সময় মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর ট্যাংক ও বিমান আক্রমণে চির কবর রচনা হয় নাদীতে।
১৯৯২ সাল থেকে সার্বজনীনভাবে চাঁদপুরে অঙ্গীকারের পাদদেশে মাসব্যাপী মুক্তিযুদ্ধের বিজয়মেলা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। এবছরও ৬ ডিসেম্বর থেকে বিজয়মেলা-২০১৯ হাসান আলী উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে উদ্বোধন হয়েছে। মেলার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি ও মুক্তিযোদ্ধা মনির আহমদ।
বাংলাদেশ সময়: ১২৩৪ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৮, ২০১৯
এএটি