লক্ষ্মীপুর: লক্ষ্মীপুরের কমলনগর উপজেলার চর কালকিনি ইউনিয়নের তালতলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে মেঘনা নদীর দূরত্ব কয়েক হাতের ব্যবধান। প্রতি মুহূর্তে ভাঙতে ভাঙতে নদী বিদ্যালয়ের খুব কাছে চলে এসেছে।
৫৪ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়টি বিগত ১০ বছরে পাঁচবার ভাঙনের কবলে পড়েছে। সর্বশেষ গত পাঁচ বছরে সেটি তিনবার সরিয়ে নিতে হয়। তবে প্রতিবারই স্থানান্তরিত হওয়ার পর ঝরে পড়ে সে এলাকার শিক্ষার্থীরা।
স্থানীয়রা বলছে, উপকূলীয় জেলে এবং কৃষক পরিবারের শিশুদের বিদ্যালয়মুখী মনোভাব এমনিতেই কম। নতুন কোনো স্থানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি স্থানান্তর হলেও আগের শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়ে যাওয়ার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। এছাড়া নদী ভাঙনের কারণে পরিবারের সঙ্গে বাস্তুচ্যুত শিশুদের বসতিও স্থানান্তরিত হচ্ছে। এভাবেই উপকূলীয় এলাকার শিক্ষার্থীরা শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
শুক্রবার (২০ মে) বিকেলে কমলনগরের চর কালকিনি ইউনিয়নের পাঁচ নম্বর ওয়ার্ডের একটি এলাকায় গিয়ে দেখা যায় মেঘনার ভাঙনের দৃশ্য। নদীর পাড়ে থাকা তালতলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের যে অবকাঠামো রয়েছে, সেগুলো খুলে ফেলা হচ্ছে। কোথাও জমি নির্ধারণ হলে সেখানে বিদ্যালয়টি স্থাপন করা হবে। সেখানে থাকা আরেকটি কওমি মাদরাসাও নদীর খুব তীরবর্তী অবস্থানে দেখা গেছে।
বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মো. নুরুল আলম বাংলানিউজকে বলেন, প্রায় ১০ দিন ধরে এখানে পাঠদান বন্ধ রয়েছে। বিদ্যালয়ের অবকাঠামোগুলো খুলে অন্যত্র নিয়ে রাখা হচ্ছে। আর পার্শ্ববর্তী একটি বিদ্যালয়ের দুটি শ্রেণীকক্ষ ব্যবহার করে এ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পড়ানো হচ্ছে।
তিনি বলেন, বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৬৫ জন। কিন্তু স্থানান্তরিত করার পর প্রতিদিন গড়ে ২০ জনের মতো শিক্ষার্থী বিদ্যালয়ে উপস্থিত হয়। বাকিরা মাদরাসা বা অন্য কোনো পেশার দিকে চলে যাচ্ছে।
তিনি জানান, নদীর খুব কাছে থাকা বিদ্যালয়ের পরিত্যক্ত একটি ঘর ভেঙে ফেলার জন্য টেন্ডার দেওয়া হয়েছে। সহসাই সেটি সরিয়ে ফেলা হবে। আর নতুন নির্মিত শ্রেণীকক্ষের অবকাঠামো আমরা সরিয়ে নিচ্ছি। যেখানে জায়গার ব্যবস্থা হবে, সেখানে বিদ্যালয়ের ঘর তোলা হবে।
নদীর তীরে দেখা হয় বিদ্যালয়ে ৪র্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী দিদার হোসেন, দুর্জয় চন্দ্র ভক্ত ও ২য় শ্রেণির শিক্ষার্থী তামিমের সঙ্গে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি ভাঙনের কবলে পড়ায় মন খারাপ কোমল এ শিক্ষার্থীদের।
তারা বলে, বাড়ির কাছেই স্কুল ছিল। আসা-যাওয়াতে কোনো সমস্যা হয়নি। এখন দূরের একটি স্কুলে যেতে হয়। আমাদের সঙ্গের অনেকেই স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। আর আমাদের বাড়িও নদীতে ভেঙে যাবে, আমরা কোথায় গিয়ে আশ্রয় নেব- তা জানি না। তখন লেখাপড়া করার সুযোগ পাবো কিনা- সেটাও বলতে পারছি না।
তালতলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশে রয়েছে নাছিরগঞ্জ দারুল আরকাম কাওমি মাদরাসা ও এতিমখানা৷ প্রতিষ্ঠানটির খুব কাছেই এখন মেঘনা নদীর অবস্থান। যেকোনো মুহূর্তে মাদরাসার জমিটি গিলে খাবে রাক্ষুসে মেঘনা। তাই এ প্রতিষ্ঠানটির অবকাঠামোও সরিয়ে নিতে হবে।
চর কালকিনি ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ড ইউপি সদস্য মো. শাহজাহান বাংলানিউজকে বলেন, এ এলাকায় একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়, একটি মাদরাসা ও একটি মসজিদ আছে। এগুলোর জমি যেকোনো মুহূর্তে নদীতে বিলীন হয়ে যাবে। বিদ্যালয়টি সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে, মাদরাসা সরিয়ে নেওয়ার বিষয়ে এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি। বসতবাড়ির পাশাপাশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানও হারাতে হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, উপকূলীয় শিশুরা এমনিতেই বিদ্যালয়ে যেতে চায় না। একটু বড় হলেই তারা বড়দের সঙ্গে নদীতে মাছ ধরা কিংবা কৃষিকাজে জড়িয়ে পড়ে। এছাড়া অভাব-অনটন এবং ঘন ঘন বসতি হারানোর ফলে পরিবারের সঙ্গে শিশুরাও বাস্তুচ্যুত হচ্ছে। ফলে অনিশ্চিত বাসস্থানের কারণে শিক্ষা জীবন থেকেও ঝরে পড়ছে শিশুরা।
বাংলাদেশ সময়: ১৫৪০ ঘণ্টা, মে ২১, ২০২২
আরএ