ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

ভাষার অর্থনীতি

সৈয়দ মিজানুর রহমান রাজু, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪০৮ ঘণ্টা, নভেম্বর ১২, ২০১২
ভাষার অর্থনীতি

মানুষ যে ভাষায় কথা বলে, শিক্ষা-দীক্ষা-সংস্কৃতি, ব্যবসায়-বাণিজ্য, আনন্দ-বিনোদন ইত্যকার প্রতিটি বিষয়ই আবর্তিত হয় সেই ভাষাকে বাহন করেই।

একটু ভেবে দেখুন, ইংরেজি ভাষায় লেখা একটা বইয়ের  বিক্রি কতো! ভাষার মত বিস্তৃত।

শুধু বই বিক্রির পয়সা নয় এর সাথে সংশ্লিষ্ট ছাপাখানা থেকে শুরু করে, বিক্রয় ব্যবস্থা, কুরিয়ার ইত্যাদি সব কিছুর মাঝে অর্থনীতির জোয়ার বয়ে যায়। লেখকের তথা বস্তুনিষ্ঠ লেখার অর্থনৈতিক মূল্যের কথা তো বলার অপেক্ষাই রাখে না।

ঠিক একইভাবে সে ভাষায় নির্মিত চলচ্চিত্র থেকে শুরু করে,  সঙ্গীত, কার্টুন, ভিডিও গেমস্-- সব ক্ষেত্রেই প্রসারমান অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি। সর্বোপরি চাকরি বাজারে, ইন্টারভিউ বোর্ডে চূড়ান্ত সাফল্য ও ব্যর্থতার শেষ আশ্রয়স্থলও হতে পারে ইংরেজি জানা বা না জানা। তবে ইংরেজির বিরুদ্ধাচারণের জন্যে আজকের এ লেখা নয়; ভাষায় অর্থনীতির প্রেক্ষাপট বিশ্লেষনের ক্ষুদ্র চেষ্টা মাত্র।

এবার আসি ভাষা সংকোচনের সাথে অর্থনৈতিক যোগসূত্রের কথায়: ৫২’র ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে ভাষার যে মর্যাদা বাঙালি তুলে ধরেছে তা থেকেই মনে হয় ভাষার অর্থনীতির সুগন্ধটা পেয়েছে বিশ্ববাসী। কিন্তু দুর্ভাগ্য হলেও সত্য যে আমরা আচার অনুষ্ঠানে বেশি বেশি ব্যস্ত থেকে, স্মৃতিচারণে যতটা সময় দিয়েছি তার ধারের কাছে সময় দেইনি ভাষার ভবিষ্যতে রচনার জন্য। যার ফলে বাংলা কি-বোর্ড নিয়ে আজো আমরা দ্বিধা বিভক্ত। বানানের রীতিনীতির কথা না হয় বাদই দিলাম।

হুমায়ূন আর সুনীল গঙ্গোপধ্যায় চলে যাবার পর বিষয়টি আমার কাছে আরও তীব্রভাবে অনুভূত হয়। আমার রবীন্দ্রভারতীকালীন জীবনে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস স্যারের কলকাতার শেষ দিকের জীবন যাপন, বিষ্ণু বসু, অরুণ সেনসহ প্রিয় শিক্ষকদের আড্ডায় মাঝে মাঝে গুণমুগ্ধ ছাত্র হিসেবে উপস্থিত থাকার সৌভাগ্য হয়েছে। আড্ডাকে সজীব রাখতে তাদের জন্য খোসার সবুজ অক্ষুন্ন রেখে শশা কেটে দেয়ার সুযোগ আমার হয়েছিল। উল্লেখ্য,  পেয়ারা, শশা জাতীয় ফল ইলিয়াস স্যার খুব পছন্দ করতেন।

প্রয়াত বিষ্ণু স্যারের কাছে আমার মত অর্থনীতির ছাত্রের নাটক অধ্যায়নটা ছিল অবিশ্বাস্য, তবে একইসঙ্গে আনন্দের ও সাধুবাদযোগ্য! ক্লাশের প্রথম দিনই তিনি আমার কাছ থেকে শুনে নিয়েছিলেন কেন আমি জাহাঙ্গীরনগরে অর্থনীতি পড়লাম নাটক না পড়ে এবং কেনইবা পরবর্তীতে অর্থনীতি ছেড়ে সীমান্ত পেরিয়ে বিদেশে এলাম নাটক পড়তে।
আমি বলেছিলাম, অর্থনীতি বা দেশ কোনোটাই আমি ছাড়ি নাই স্যার। তবে অর্থনীতি আর নাটকের (ভাষার) মাঝে যোগসূত্র স্থাপনের চেষ্টা করে যাচ্ছি নিরন্তর।

যথারীতি আড্ডায় আসতেন প্রিয় সুনীল দা। দায়িত্ব পড়তো অতিরিক্ত শশা কাটার। তাড়াতারি করতে গিয়ে শশার বদলে হাত কাটতে ভুল হয়নি আমার। ভুল হয়নি বিষ্ণু স্যারেরও, আঙুল থেকে ঝড়তে থাকা রক্তের দিকে ইঙ্গিত করে বললেন, তোর অর্থনীতি থেকে নাটক পড়ার ইতিহাসটা বল আর শশা কাট। হাত ও সময় দুটোই আনন্দে থাকবে।

এখন শশা আর আঙ্গুল রক্ষায় তাঁর পরামর্শকে শিরোধার্য করে যদি বলি, অর্থিনৈতিক চিন্তাটা মাথায় রেখেই আমাদের ভাষার ভষ্যিত ইতিহাস রচনার গল্প শুনিয়ে যেতে হবে বিশ্ববাসীকে-- এতে ভাষাটাও মজবুত হবে আর অর্থনীতিটাও মহীরূহ হবে। দু’টোর যোগফলে জাতি হবে আরও উন্নত।

হুমায়ূন আহমেদ স্যারের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে খুবই কম। সক্রেটিসের জবানবন্দী নাটকের নির্দেশনা দেয়ার সময় স্যারের ধানমন্ডির বাড়িতে জায়গা করে দেন সানন্দে। যাওয়া আসার পথে দেখা হতো, কথাও হতো মাঝে মধ্যে। ঐসময় বাংলা একডেমীর বই মেলা মানেই জাতীয় আয়ে প্রকাশনা খাতের আয় বাড়ানোর বড় ভূমিকা রাখতো তার লিখা বই যা, আজো অম্লান। কিন্তু আমার কাছে দেশের আয় রোজগারের চেয়েও বড় ব্যাপার হলো ভাষা সংস্কৃতি ও বাঙালি অনুভূতির প্রসারণ। বই পড়তে প্রায় ভুলে যাবার আগে বাংলা ভাষায় লেখা বই পড়ায় বাঙালি তরুণ-তরুণীদের রাতারাতি ফিরিয়ে আনলেন হুমায়ূন আহমেদ।

কোনো তুলনা নয়, অর্থনৈতিক ব্যাখ্যার স্বার্থে বলি। বাংলা হরফে চোখ বুলিয়ে মনের গহীনে অনুভূতির সাথে খেলা করার নতুন সংস্কৃতি তৈরি করেছেন হুমায়ূন আহমেদ, যার ফলে বাংলা ভাষায় লেখা মানসম্পন্ন বইগুলোর বাজার হুহু করে বেড়ে গেছে।

লেখা ও বই প্রকাশ যে মানুষের একান্ত পেশা হতে পারে তার ঈর্ষণীয় উদাহরণ হতে পারেন হুমায়ূন আহমেদ। এসব বিষয় ভাবতে গিয়ে বাজার অর্থনীতির মন ভোলানো সব কিছুকে পিছু ফেলে মনে করিয়ে দিল ভাষার অর্থনীতিকে। হুমায়ূন স্যারের পর সুনীল দা চলে যাওয়ার পর, আমার ক্ষুদ্র অনুভবের সঞ্চয়কে সম্বল করে বলছি, ভাষার অর্থনীতির বিষয়টি আপনাদের জানানোর প্রয়োজন বেড়ে গেল বহু মাত্রায়। তাই এ লেখা।

জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে বাঙালির ভাষার অর্থনীতিকে বেগবান করে গেছেন হুমায়ূন। তাঁর লেখা বা বই ওপার বাংলাসহ দুনিয়ার অন্যান্য দেশেও জনপ্রিয়, অন্যভাষায় অনুবাদ তো আছেই। একইকাজে সুনীলও ছিলেন তার যোগ্য সহগামী। এখন দরকার তাদের মত আরও লেখক আর সচেতন জাতি-পাঠক।



অর্থনীতির সাথে যেমন ভাষার যোগসূত্র রয়েছে তেমনি রয়েছে, ভাষার সাথে অর্থনীতির। একটু খেয়াল করলে দেখবেন, জীবিকার তাগিদে মানুষ কত নতুন নতুন ভাষা শিখছে। উন্নত অর্থনীতির দেশ ও তাদের ভাষা শেখার ব্যাকুলতা আমাদের চিরন্তন। অন্যদিকে ভাষা প্রসারণের মধ্য দিয়ে যে জনগোষ্ঠী যত সংখ্যায় ঐ ভাষায় কথা বলে তাদের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক শক্তি ততো বেশি হবেই। যার প্রমাণ আমরা রেখেছি ৫২তে রাজনৈতিকভাবে।

এবার সময় এসেছে ভাষাকে অর্থনৈতিকভাবে দেখার। কেননা, বাংলাদেশে শতকরা ৮৫% ভাগ মানুষ যখন ভিন্ন ভাষায় টেলিভিশন দেখায় ব্যস্ত, শিশুরা যখন ডরেমন আবেগে নেশাগ্রস্ত তখন ভাষার অর্থনীতির হাতুড়ি পেটানো ছাড়া নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারবো না আর। একটা কবিতা দিয়ে শেষ করবো ভাষার অর্থনীতির আর জীবন যাপনের অর্থপূর্ণ ভাবনার কথাগুরো (এই জাতি অন্য ভাষায় ভেসে গিয়ে শুধু প্রজন্ম হারাতে যাচ্ছে তাই নয়-- বরং প্রতি মাসে মোটা অংকের টাকাও চলে যাচ্ছে ঐসব ভাষাভাষী মানুষের কোষাগারে যা ডিশ আর ইন্টারনেটের বিল হিসেবে দিয়ে থাকি মহানন্দে)।

মানুষ ভরা দেশে ভাষা শূন্যতা এলে
নির্বাক হবে কোটি জনতা, উচ্ছন্নে যাবে ন্যায্যতা-প্রাপ্যতা
মানুষ ভরা দেশে ভাব শূন্যতা এলে
সবাক মিছিলে অবাক চোখে, পাপ মুক্তির পথ হারাবে হৃদ্যতা।

সীমান্তে ঢুকে দেশ কেরে নিলে
ফিরে পাবে তুমি শক্তি খাটালে
কেড়ে নিলে শিশুমন...    
প্রজন্ম হারাবে জন্মান্তরে।

হাতের রিমোটে বাবার আদর
মায়ের মমতা বন্দী করার আগে......
একবার ভাবি ভাষার জন্য রক্ত স্রোতের কথা
একবার ভাবি মেধাহীন প্রযোজনার কথা
একবার ভাবি ভাষার অর্থনীতির কথা
একবার ভাবি বাংলায় লিখা বই অবিক্রীত থেকে যাবার কথা
একবার ভাবি নজরুল রবীন্দ্রনাথের কথা
একবার ভাবি জীবনানন্দ রুদ্রের কথা
একবার ভাবি পাঠক বিহীন লাইব্রেরির কথা
একবার ভাবি বইয়ের পাতায় উঁই পোকার উল্লাসের কথা
একবার ভাবি জনশূন্য বাংলা একাডেমীর কথা    ।

দারিদ্র ঘুচাতে হতদরিদ্র হবার আগে...
এসো ভাবি আরেকবার,
বিশ্বজয়ের নামে গৃহবন্দী জীবনের কথা
এসো ভাবি চোখ ছোট হয়ে আসা
দরেমন আবেগে নেশাগ্রস্থ নিষ্পাপ শিশুটির কথা ।

এসো ভাবি কাজ শেষে বাড়ি ফেরা অসহায় বাবার কথা
উচ্ছ্বাস হীন , দেখে না দেখার ভান করা সন্তানের কথা
রিমোট হারানোর ভয়ে বাবাকে তাড়ানোর উল্লাসের কথা।

যার গায়ে বাবার ঘামের প্রলেপ নেই জড়াজড়ি আদরে
যার বুকে মায়ের ভাষার আবেগ নেই, বুকের গহীনে!
তাঁর কাছে একদিন নিশ্চিহ্ন হবেই মা-মাটি-দেশ
নিশ্চিহ্ন হবো স্বপরিবারে......।

হাহাকার তুলে শিশুকে ধমক দেবার আগে
মেতে উঠি এসো আপন সৃষ্টির উল্লাসে    
যার জন্য বসে আছে কোটি জনতা
বুক ফাটানো মানবিক চাপে।

রিমোট চেপে কান্না থামানোর আগে
এসো উড়িয়ে দেই আমাদের নীরবতা।

ইতি সৈয়দ মিজানুর রহমান রাজু, পরিচালক (স্টুডেন্ট অ্যাফেয়ার্স), ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]

বাংলাদেশ সময়: ১৩৩৪ ঘণ্টা, ১২ নভেম্বর, ২০১২
সম্পাদনা: একে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।