ঢাকা, রবিবার, ২০ আশ্বিন ১৪৩১, ০৬ অক্টোবর ২০২৪, ০২ রবিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

তার কয়েকটি জন্মদিন

শাকুর মজিদ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০০৫০ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৩, ২০১২
তার কয়েকটি জন্মদিন

হুমায়ূন আহমেদের প্যাকেজ যুগের প্রথম দিকের নাটকগুলোর পরিচালক বা পরবর্তীতে প্রধান সহকারী হিসেবে এক সময় কাজ করা মনির হোসেন জীবন আমাকে বলেছেন যে, ঘরের বাইরে হুমায়ূন আহমেদ তার প্রথম জন্মদিন পালন করেছিলেন ১৯৯৫ সালে।

সেটা ছিলো তার ৪৭তম জন্মদিন।

১৯৪৭ সালে জন্ম বলেই কিনা, এই ৪৭তম জন্মদিন পালনের জন্য তিনি মনির হোসেন জীবনকে হোটেল শেরাটনে রাতের খাবার খাওয়ার আয়োজন করতে বলেন। এই আয়োজনে সস্ত্রীক হুমায়ূন আহমেদ, তার তিন মেয়ে, ছেলে এবং স্ত্রী গুলতেকিন আহমেদের এক ভাই ও তার স্ত্রী- এ ক’জনই উপস্থিত ছিলেন। নিতান্ত ঘরোয়া পারিবারিক ছিলো এ আয়োজন।
 
হুমায়ূন আহমেদের বইয়ের প্রকাশকেরা তার জন্মদিন অনুষ্ঠানকে ঘরের ভেতর থেকে বের করে আনেন ১৯৯৮ সালে, তার ৫০তম জন্মবার্ষিকীতে। ‘ভোরের কাগজ’এ তার জন্মদিনের এ সংবাদটি দেখে আমিও ছুটে গিয়েছিলাম। অনেক দিন হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে দেখা হয় না। ভাবলাম, যদি এ উপলক্ষে তার সঙ্গে দেখা হয়। অঙ্গনা ছেড়ে দেওয়ার পর আমার যোগাযোগ রাখার সুযোগ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।

কিন্তু, লেখকের জন্মদিনে কী উপহার নিয়ে যেতে পারি! হাতের কাছে একটা মূল্যবান ছবি আছে। ভাবলাম-এটা যদি উপহার হিসেবে নিয়ে যাই, কেমন হয়?

১৯৮৬ সালে বইমেলার সংবাদ সংগ্রহের জন্য তার একটি ছবি তুলেছিলাম ইয়াশিকা এমএফটু অটোফোকাস ক্যামেরায় নিউমার্কেট থেকে সস্তায় কেনা সাদা-কালো রিফিল ফিল্মে। সেই ছবিতে এপ্রোন পরা কয়েকজন মেডিকেল ছাত্রী তার অটোগ্রাফ নিতে বই হাতে দাঁড়িয়ে আছে এমন একটা ছবি ছিলো। সেই অটোগ্রাফ প্রার্থীনিদের একজন আজ নানা কারণে আলোচনায়। তিনি এখন তসলিমা নাসরিন।

এই তসলিমা কয়েকজন বান্ধবীর সাতে বই উচিয়ে রেখেছেন লেখকের সই নেওয়ার জন্য, এমন একটা দৃশ্য যে আমার কাছে আছে, তা তার জানা নেই। এ ছবিটা সে সময় যদিও কাগজে ছাপা হয়েছিল, এটা কী তার চোখে পড়েছিল? জানি না। এ ছবিটা অনেক আগেই আমি ফুলপেজ এ প্রিন্ট করে রেখেছিলাম, সে অন্য কারণে। কারণটা ঘটেছিল আরেক অনুষ্ঠানে ৭জন গুণি লোককে সংবর্ধনা দিয়েছিলেন শহীদুল হক খান। এ ৭ গুণিজনের মধ্যে কবি শামসুর রহমান ও তসলিমা নাসরিনও ছিলেন। জাতীয় যাদুঘরের ছোট হল (সুফিয়া কামাল মিলনায়তন) এ।

এ অনুষ্ঠানে সামনের সারিতে শামসুর রাহমানের পাশে তসলিমা নাসরিন বসে আছেন। কবি শামসুর রাহমানের সামনে কেউ নেই, এক যুবক তার নোটবুক মেলে ধরেছে তসলিমার সামনে।

১৯৮৬ থেকে ১৯৯৬, দশ বছরে একজন মানুষের কেমন পরিবর্তন হতে পারে এটা বোঝানোর জন্য ভেবেছিলাম-এ রকম ২০ থেকে ২৫টা জোড়া ছবির একটা প্রদর্শনী করবো, নানা বিষয়ের। যে উদ্দেশ্যে ছবিগুলো প্রিন্ট করিয়ে রাখা, সে উদ্দেশ আমার সফল হয়নি। ছবিটা রয়ে গেছে।

বাঁধাই করার সময় নেই এখন, আমি শুক্রাবাদের এক দোকান থেকে ছবিটা লেমিনেশন করে রওয়ানা দেই ইস্কাটনের লেডিস ক্লাবের দিকে।

লেডিস ক্লাবের মূল হলটির পেছনে সামিয়ানা টাঙিয়ে বানানো হয়েছে প্যান্ডেল। মঞ্চ তৈরি করা হয়েছে। এক পাশে তার বইয়ের স্টল। পঞ্চাশ বছর পূর্তি উপলক্ষে ‘হুমায়ূন ৫০’ নামে একটা বেশ মোটাসোটা বই ছেপেছে সময় প্রকাশন।

অনেকেই বক্তৃতা করছেন। আমি বক্তৃতা মঞ্চের কাছে যাই না। বাইরে দেখা হয় শাহীন ভাই (কাটুনিস্ট আহসান হাবিব)-এর সঙ্গে। তার কাছে আমার উপহারটি দিয়ে দেই। বলি-এটা স্যারের কাছে পৌঁছাবেন। শাহীন ভাই ছবিটা দেখে বলেন, খুবই ইন্টারেস্টিং ছবি, সে (হুমায়ূন আহমেদ) খুব মজা পাবে এটা দেখে।

বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করি তার বক্তৃতা শোনার জন্য। এক সময় তিনি এলেন এবং মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে, অত্যন্ত নার্ভাস ভঙ্গিমায় কিছু বললেন। আজ ১৪ বছর পর তার সবটুকু আর মনে নাই। যেটুকু মনে আছে, তা হচ্ছে- তিনি বলেন- প্রকাশকেরা যখন এখানে আমার জন্মদিনের অন্ষ্ঠুান করার প্রস্তাব দেয় তখন আমি কিঞ্চিত দ্বিধার মধ্যে পড়ে যাই। ঘরের বাইরে আমার জন্মদিনের অনুষ্ঠান হবে- এটা ভাবতে আমার বেশ সংকোচ বোধই হচ্ছিলো। মনের একটা অংশও আবার বলছিলো- হোক না, দেখি কী হয়! তিনি বলেন, আমি কখনোই আশা করিনি যে আমার জন্য এরকম একটা অনুষ্ঠান হবে আর এতো লোক এখানে উপস্থিত থাকবে। আমি আপনাদের ভালোবাসায় ধন্য....এসব কথা।

এ আসরে আমার আর বেশিক্ষণ থাকা হয়নি। তবে আমি চলে আসার পর একটি ঘটনা উপস্থিত লোকজনকে বেশ কৌতুহলের জন্ম দেয়। হুমায়ূন আহমেদের ইদানিংকার প্রায় সব নাটকে কেন্দ্রিয় চরিত্রে অভিনয়কারী এক কিশোরী অভিনেত্রী (শাওন) একটা নীল রঙের গাড়ি থেকে ৫০টি গোলাপ দিয়ে সাজানো একাটি ডালি নিয়ে যখন নামলেন, তখন হুমায়ূন আহমেদের স্ত্রী গুলতেকিন আহমেদ সাংবাদিকদের উদ্দেশ করে বলেন, “এই সেই মেয়ে, ওকে জিজ্ঞাসা করুন ও এখানে কেনো এসেছে? এসব। ” এ কাহিনী আমি শুনেছি এক সাংবাদিকের কাছে।

হুমায়ূন আহমেদের পরবর্তী ১০ বছরের জন্মদিনের ইতিহাস আমার আর জানা হয়নি।

২০০৮ সালে হুমায়ূন আহমেদ ষাটে পড়বেন। এ ষাটতম জন্মদিন পালনের জন্য নানা রকম জল্পনা কল্পনা শুরু হলো দখিন হাওয়ার আড্ডায়। হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে সারাজীবন কাজ করার বাসনা নিয়ে এক তরুণ চলচ্চিত্রকার সুইডেন ছেড়ে এসেছেন। তার নাম মাসুদ আখন্দ। তিনি প্রতি সন্ধ্যায় নতুন নতুন আইডিয়া নিয়ে আসছেন। আমি শুনি। আমার কানের এপাশ দিয়ে ঢুকে- আর্মি স্টেডিয়াম, এসএমএস, ফোন কোম্পানি, কয়েকহাজার হিমু, সারা দেশ, চ্যানেল আই লাইভ, এসব শব্দ। খুব সযতনে আমার অপর কান দিয়ে এগুলো বেরিয়ে যায়, সব মনে থাকে না কারণ, কোনো কিছুই কার্যকরী হয় না। যা হলো সেটা হচ্ছে, হুমায়ূন আহমেদের প্রকাশকেরা মিলে পাবলিক লাইব্রেরিতে আনুষ্ঠানিক ভাবে তার জন্মদিন পালন করবেন।

২০০৮ সাল থেকে নতুন করে তার জন্মদিনের আনুষ্ঠানিক উদযাপন শুরু করে হুমায়ূন আহমেদের বইয়ের প্রকাশকেরা। তাদের উদ্যোগেই মূলত হুমায়ূন আহমেদের বইয়ের প্রকাশকদের নামে ২০০৮ সাল থেকে পাবলিক লাইব্রেরি চত্বরে সপ্তাহব্যাপী বইমেলা দিয়ে শুরু হয় জন্মদিন উৎসবের।

১৩ নভেম্বর সকাল ১১টার দিকে বই মেলার উদ্বোধন হয়, উদ্বোধন করেন লেখক জননী আয়শা ফয়েজ, তার সঙ্গে থাকেন হুমায়ূন পতœী মেহের আফরোজ শাওন, ছেলে নিষাদ।
২০০৮ সাল থেকে আমি আছি আসরের সবগুলো আয়োজনে। কিন্তু, আমার এই অংশগ্রহনের প্রথম বছরই মাজহারের সঙ্গে আমার গ-গোল লেগে গেলো। মাজহার চেয়েছিল- হুমায়ূন আহমেদের ষাটতম জন্মদিনের অনুষ্ঠান দিয়েই শুরু হবে তাকে নিয়ে আমার বানানো প্রামাণ্যচিত্রের কাজ। আমি বলে দিলাম ক্যামেরাম্যান সহ আমি ক্যামেরা পাঠিয়ে দেবো, অনুষ্ঠান শেষে তোমার কাছে ক্যাসেটগুলো চলে যাবে, আমি ডকুমেন্টারি করছি না।

- এতো ইমোশনাল হতে নাই, একদিন পস্তাবা। ওটা ভুলে যাও, তুমিই করবা ডকুমেন্টারি, একজন মানুষকে নিয়ে অনেকেই তো বানাতে পারে, তুমি তোমার মতো বানাবা।
- আমি বানাবো না। এটাই আমার সিদ্ধান্ত।

মাজহার এ ক’দিনে জেনে গেছে, আমার একটা রগ সামান্য ত্যাড়া। আমাকে বেশি খোচায় না।

হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে আমার অন্তরঙ্গ পর্বের সূচনার কিছুদিন পরই (মে-জুন ২০০৮) আমার গাড়ির বুটে ক্যামেরা ট্রাইপয়েড নিয়েই গিয়েছিলাম নুহাশ পল্লীতে। রাতে আড্ডা চলছে। কাল দিনের বেলাও আমাদের থাকা আছে, বিকেলে ঢাকা ফেরা। আড্ডার এক ফাকে বললাম, স্যার আমি ক্যামেরা নিয়ে এসেছি, আপনি যদি অনুমতি দেন, কাল সকাল বেলা আপনাকে নিয়ে নুহাশ পল্লীতে হাঁটবো, গল্প করবো এবং এটা ক্যামেরায় রেকর্ড করবো। আমি শাহ আবদুল করিমকে নিয়ে ভাটির পুরষ বানিয়েছি, আপনাকে নিয়েও একটা বানাবো।

হুমায়ূন আহমেদ কিছু বলতে যাবেন, এমন সময় শাওন বলে, ‘হবে না, ওকে নিয়ে আমি ডকুমেন্টারি বানাবো, অন্য কাউকে বানাতে দেব না। ’

ঠুস করে বেলুন ফুটার মতো আমিও ফুটে গেলাম। মেনে নিলাম শাওনের সিদ্ধান্ত। স্যারও নির্বাক। আমরা আড্ডা মারি, খাই এবং ঘুমাই। পরদিন বেলা করে ঘুম থেকে উঠি, নুহাশ পল্লীতে হাঁটাহাঁটি করি, ফুলের নাম, গাছের নাম শুনি। বিকেল বেলা দুপুরে ভাত খেয়ে ঢাকার পথে আমরা রওয়ানা দেই। মাজহারও দেখলো আমার ভিডিও ক্যামেরা আর গাড়ির বুট থেকে বের করা হয় না। আমিও সিদ্ধান্ত নিলাম, থাক- চাইলে কত মানুষকে নিয়েই তো ডকুমেন্টারি বানাতে পারি, হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে আমার তথ্যচিত্র বানানো নাহয় না-ই হলো।
 
তার ষাটতম জন্মদিনের এই অনুষ্ঠান বসেছিল পাবলিক লাইব্রেরি অডিটোরিয়ামে। পুরো মঞ্চে লম্বা একটা টেবিল, পুরো টেবিলটি তাজা গোলাপ দিয়ে মোড়ানো। টেবিলের পেছনে একটি মাত্র চেয়ার। সেখানে বসে আছেন বার্থডে ম্যান - হুমায়ূন আহমেদ। মঞ্চে আর কোনো অতিথি নাই। তার জন্মদিনে ৪টি নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করা হলো, ৩টি ছিলো অন্যপ্রকাশ থেকে ছাপা, আপরটি অনন্যা-র।  

এ ধরনের অনুষ্ঠানে কোনো বিশিষ্টজনেরা প্রধান অতিথি হিসেবে থাকেন। এখানে তার নিজের পরিবারের বাইরে কোনো অতিথি নেই।

বইগুলোর মোড়ক উন্মোচন করেন লেখক জননী আয়শা ফয়েজ, লেখক পতœী মেহের আফরোজ শাওন, লেখক ছেলে নুহাশ হুমায়ূন ও লেখক ইমদাদুল হক মিলন।

ইমদাদুল হক মিলনের উপস্থাপনায় অনুষ্ঠানটিতে হুমায়ূন আহমেদের জীবন ও কর্ম নিয়ে কথা বলেন নানা জন, জন্মদিনের শুভেচ্ছা দেন এবং প্রথমবারের মতোই হলভর্তি দর্শকের সামনে কথা বলতে আসেন মেহের আফরোজ শাওন। পিন পতন স্তব্ধতার ভেতর দর্শকেরা তার কথা শোনেন। কথা শেষ হলে হলের মধ্যে বেশ জোরে তালিও পড়ে।

অনুষ্ঠানের পর হুমায়ূন আহমেদ তার ঘনিষ্টজনদের নিয়ে রাতের খাবার-দাবারের জন্য যাবেন গুলশানের ক্যাডেট কলেজ ক্লাবে এ। মাজহার আমাকে দিয়ে দোতলার পুরো রেস্টুরেন্ট ফ্লোর বুক করিয়ে রেখেছে। সন্ধ্যা প্রায় সাড়ে ৮টার দিকে ২০ থেকে ২৫ জনের দল নিয়ে হুমায়ূন আহমেদ যখন এসে বসলেন, তখন একটা থমথমে ভাব দেখি পুরো চত্বরেই। প্রিয় লেখকের জন্মদিনের অনুষ্ঠান, সেখানে হৈ-হুল্লোড়, আনন্দ-ফূর্তি থাকার কথা, সেটা নাই।

একটা টেবিলের এক পাশে হুমায়ূন আহমেদও নুহাশ, অপর পাশের একটা চেয়ারে শাওন বসে আছে। করো মুখে কোনো কথা নাই। শাওনের দিকে তাাকিয়ে মনে হলো, সে বোধ হয় কাঁদছে। তার মুখ নীচু, ভালো করে দেখা যাচ্ছে না।
কিছুক্ষণ পর কোনো খাবার না খেয়েই নুহাশ চলে গেলো। নুহাশের বক্তৃতার একটা কথা নিয়ে এ পরিস্থিতি।   হুমায়ূন আহমেদ নিজে এ ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন এ রকম-

সে বলল, আমার বাবা যখন খুব অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ছিলেন তখন তার পাশে আমি উপস্থিত থাকতে পারি নি। তিনি যখন চার-পাঁচটা বিয়ে করেন তখনো আমি ছিলাম অনুপস্থিত। আজ এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে পেরে ভালো লাগছে।

আমার মাথার ভেতর সব কেমন যেন তালগোল পাকিয়ে গেল। ছেলে এইসব কী বলছে? আমি দ্বিতীয় বিয়ে করেছি। চার-পাঁচটা করি নি। আজকের অনুষ্ঠানে দ্বিতীয় বিয়ে টেনে আনাও অশোভন। সে সেখানে চার-পাঁচটা বিয়ে কোথায় পেল?

অনুষ্ঠান চলছে। গানবাজনা হচ্ছে। আমি ছেলের পাশে চুপচাপ বসে আমি। একবার ভাবলাম জিজ্ঞেস করি- ‘বাবা! চার-পাঁচটা বিয়ের ব্যাপারটা কী?’ তারপরই মনে হলো- কী হবে জিজ্ঞেস করে।
(বল পয়েন্ট/ হুমায়ূন আহমেদ)

ষাট বছরপূর্তি মহাজন্মোৎসবের পর জীবিত হুমায়ূন আর মাত্র দু’টি জন্মদিনের অনুষ্ঠান পেয়েছিলেন দেশে ২০০৯ ও ২০১০ সালে। ২০১১’র জন্মদিনে তিনি চিকিৎসার জন্য আমেরিকার নিউইয়র্কে ছিলেন। এ তিনটে জন্মদিনেই ২০০৮ সালের জন্মদিন উৎসবের ধারাবাহিকতা বজায় থাকে। পাবলিক লাইব্রেরির চত্বরে হুমায়ূন আহমেদের বইয়ের প্রকাশকেরা সপ্তাহ-দশ দিনের জন্য বইমেলার আয়োজন করে। মেলা উদ্বোধন করেন লেখক নিজে তার পরিবারের সদস্যদের নিয়ে। বিকেল বেলা স্টলের সামনের খোলা জায়গাটিতে বসে আলোচনা অনুষ্ঠান। কালের কণ্ঠের সম্পাদকের দায়িত্ব নেওয়ার আগে সবগুলো অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করেছেন ইমদাদুল হক মিলন। পেছন থেকে অনুষ্ঠান ব্যবস্থাপনায় থাকতেন অন্যদিন-অন্যপ্রকাশ-এর লোকজন।

২০১১ সালে অনুষ্ঠান উপস্থাপনায় আসেন অন্যদিনের নির্বাহী সম্পাদক নাসের আবদুল্লাহ।

হুমায়ূন আহমেদের আনুষ্ঠানিক জন্মদিনের বাইরে তার আরেকটি জন্মদিন উৎসব হতো তার নিজের ফ্লাট দখিন হাওয়ায়। আগে নিশ্চয়ই নুহাশ পল্লীতেও হয়েছে, আমি পাইনি, তবে ২০০৮ সালের পর ১২ নভেম্বরের রাতগুলো অন্যরকম ব্যাঞ্জনা নিয়ে আসতো তার দখিন হাওয়ার ফ্লাটে। এমনিতে যদিও নিজেকে বলতেন-

বাইরে যাবো মরতে?
থাকবো আমি গর্তে।

সে কারণে আমজনতার কাছাকাছি যাওয়া বা আমজনতা তার কাছে যাওয়ার সুযোগ থাকতো না। কিন্তু, এইদিন যে তার দরোজা সবার জন্যই খোলা থাকতো, সেটাও সবাই জানতোনা। যারা জানতো তারা ১২ নভেম্বর সন্ধ্যার পর থেকে আসতে শুরু করতো। হুমায়ূন আহমেদের ফ্লাটের দরোজা সব সময় খোলা থাকতো- সেটা জন্মদিন বলে কথা নাই। কী এক রহস্যময় কারণে তিনি দরজা ভেতর থেকে বন্ধ না করেই ঘুমাতেন, ভাগ্যিস এ খবরটা ও পাড়ার চোর ডাকাতদের জানা ছিলো না। নীচের তলায় অবশ্য এপার্টমেন্টের দারোয়ানরা সব সময়ই সক্রিয় থাকে অভ্যাগতদের পরিচয় জানার জন্য। ওদের কাছে অচেনা মনে হলেই গেট পাস করার আগে অনুমতি নিয়ে নিত।

কিন্তু, ১২ নভেম্বরের রাতে এটা থাকতো না। খুব বেশি না হলেও কুড়ি-পচিশ-তিরিশ জন ভক্ত অনুরাগীর প্রবেশ ঘটতো সে সময়। এমনও শুনেছি যে, তার দু’চারজন অনুরাগী ছিলেন তারা বছরের এই একটি সন্ধ্যাতে তার সঙ্গে দেখা করতে আসতেন। বেশিরভাগই ফুল নিয়ে আনতেন, কেউ কাপড় চোপড়। এগুলো খুলে দেখার পর কিছু এপাশে রাখতেন, কিছু ওপাশে। ওপাশেরগুলো কাউকে দিয়ে দেওয়ার জন্য। কাপড় চোপড় পড়তেন খুব সাদামাটা, নরম, সুতির। যারা দামী কাপড় নিয়ে আসতেন, তাদেরগুলো ওপাশে চলে যেতো।

১২ নভেম্বরের রাতের জন্য তার বন্ধুদের কখনো ডাকতেন না। কিন্তু, বন্ধুদের জন্য খাবারের পুরো আয়োজন করে রাখতেন। রাত ৮টার পর থেকে প্রিয় বন্ধুদের নিয়ে আড্ডায় বসে যেতেন। ২০০৮ থেকে ২০১০ পর্যন্ত এ তিনটি জন্মদিনে তার একান্ত আড্ডায় দেখেছি সালেহ চৌধুরী, সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম, আসুদুজ্জামান নূর, ইমদাদুল হক মিলন, জুয়েল আইচ, এসএম মনিরুজ্জামান, মনির আহমেদ, ইবনে হাসান খান প্রমুখদের।

এদের সঙ্গে প্রাত্যহিক আড্ডার লোকজন তো আছেনই। এবং প্রায় প্রতি সন্ধ্যাতেই তার নিজের পরিবারের মধ্যে তার মা, বোনেরা, ভাই আহসান হাবিব এবং নুহাশকে ও দেখেছি। তারা একটু দেরি করেই আসতেন।

আমাদের আড্ডা শেষ হয়ে যেতো ১২টা বাজার পাঁচ মিনিট আগে। তারপর কেক কাটার একটা বিষয় থাকতো। মাকে নিয়ে কেক কাটতেন হুমায়ূন আহমেদ, সঙ্গে স্ত্রী-পুত্র। সে রাতে গানের আসর হতো। এসআই টুটুল দেশে থাকলে তানিয়া ও ছেলেদের নিয়ে আসতো। ৪০ থেকে ৫০ জনের মহাফূর্তির আয়োজন। অবারিত খানাপিনা, আনন্দ  উৎসব।
২০১০ এর জন্মদিনের রাতে, কাকতালিয় ভাবে ভরা জোৎ¯œা ছিলো। আকাশে পূর্ণ চন্দ্র।

পরদিন বলেছিলেন, কাল রাতে আমি খুব চিন্তায় ছিলাম। আমার মনে হয়েছিল, আমার মৃত্যু হবে কোনো এক পূর্ণিমা রাতে। মৃত্যুর জন্য জন্ম দিনের তারিখটা বেশ ভালো। যেদিন জন্ম, সে তারিখে মৃত্যু। কাল রাতে মনে হয়েছিল, আমি বোধ হয় আজ মারা যাবো। যাক, রাতটা পার করে দিচ্ছি, কোনো মতে এ যাত্রা রক্ষা! মুলত এটাই ছিলো বাংলাদেশে হুমায়ূন আহমেদের শেষ জন্মদিন পালন।

২০১১ সালের ১৩ নভেম্বরটি ছিল জীবিত হুমায়ূনের শেষ জন্মদিন। কিন্তু, সেদিন তিনি দেশে ছিলেন না। তার চিকিৎসা চলছে আমেরিকায়। অথচ জন্মদিনের আয়োজনটি হঠাৎ করে আরো বেড়ে গেলো। সবকিছু আগের বছরের মতোই। সেই পাবলিক লাইব্রেরিতে বেলুন ওড়ানো, একক বই মেলা, তার সামনের স্টেজে আলোচনা অনুষ্ঠান। আলোচনা অনুষ্ঠানটি মূলত: ছিলো লেখকের রোগমুক্তির, দীর্ঘ জীবন কামনার । বক্তৃতা করতে এসে সালেহ চৌধুরী কান্নাভেজা কণ্ঠে একটি চন্দন কাঠের মালা দেখালেন। ভারতের ব্যাঙ্গালোর থেকে কোনো এক পীরের কাছ থেকে তার ছেলে এই মালা পাঠিয়েছেন বাবার কাছে। তিনি এটা দু’তিনদিনের মধ্যে আমেরিকায় পাঠাবেন। তার ধারণা, এই মালাটি হাতে পরে রাখলে তিনি দ্রুত আরোগ্য লাভ করবেন। বক্তৃতার সময় ওই মালাটি তিনি দেখালেন। তার আবেগের সংক্রমণ ঘটলো উপস্থিত দর্শক-শ্রোতাদের মধ্যে। এ রকম একটা আবেগময় পরিবেশের মধ্যে দিয়ে শেষ হলো অনুষ্ঠান।

সে রাতে তার একান্ত উপস্থিতি ছিলো দখিন হাওয়ায় কম্পিউটারে। দখিন হাওয়ার দু’তলার একপাশে হুমায়ূন আহমেদের বাসা, অপর পাশে মাজহারুল ইসলামের। তিনি সাপ্তাহ খানেক আগে মাত্র এসেছেন নিউইয়র্ক থেকে। সেখানে গিয়ে ইন্টারনেটে স্কাইপে দিয়ে কথা বলা ও ছবি দেখার বিষয়টি রপ্ত করে এসেছেন। হুমায়ূন আহমেদ বলে দিয়েছেন, জন্মদিনের প্রথম প্রহরেই তিনি তার মা, ভাইবোন ও সন্তানদের সঙ্গে কথা বলতে চান, তাদেরকে দেখতে চান, এ জন্যই স্কাইপের আয়োজন। মাজহারের ল্যাপটপে স্কাইপে ইনস্টল করে দেই দ্রুত এবং খুব সহজে সংযোগও ঘটে যায়। রাতে এ ফ্লাটে এসে উপস্থিত হয়েছেন মা আয়শা ফয়েজ, বোন শেফু এবং তার পুত্র-কন্যারা, এসেছে নুহাশও।

বাংলাদেশের রাত ১২টা মানে নিউইয়র্কের দুপুর ২টা। হুমায়ূন আহমেদ কম্পিউটারের সামনে এসে বসেন। ক্যামেরার দিকে তাকান। তার মাথায় টুপি। একবার টুপি খুলেন, মাথায় চুল প্রায় নাই। ছাটার পর একটু একটু গজালে যেমনটি দেখায় তেমনই।

মাজহার প্রথমে কথা বলে একে একে যারা উপস্থিত আছে সবার কথা জানিয়ে দেয়। নুহাশের সঙ্গে কথা বলতে চাইলেন প্রথমে। নুহাশ এসে সামনের চেয়ারে বসে। সে তার বাবার মাথায় চুলের দিকে তাকিয়েই দুই হাত দিয়ে মুখ ঢেকে উঠে যায়। বলে- না, আমি কথা বলবো না।

নুহাশ চলে যাওয়া পরপর কথা বলেন মায়ের সঙ্গে, বোনের সঙ্গে। সবাই একটু একটু হাই-হ্যালো করছেন। সবার একই কথা, আমরা দোয়া করছি, আপনি দ্রুতই সুস্থ হয়ে উঠবেন এমনই। তিন চার মিনিট পর আবার ডাক পড়লো নুহাশের। নুহাশ এসে বসলো। এবার সে বেশ স্বাভাবিক। এবার বাবা ছেলে কথা হয়। হুমায়ূন আহমেদ প্রশ্ন করেন, তোমার পড়াশুনা কেমন চলছে? ক্লাশ কবে শুরু হবে? এটুকুই।

এরপর নিজেই বলেন, আমি এখন যাই, সবাই ভালো থেকো তোমরা। হুমায়ূন আহমেদ চেয়ার ছেড়ে উঠে যান। ল্যাপটপের স্ক্রিনে একটা খালি চেয়ার পড়ে থাকে।

(লেখাটি লেখকের প্রকাশিতব্য স্মৃতিকথা হুমায়ূন আহমেদ: এক যে ছিল মুগ্ধকর গ্রন্থ থেকে সংকলিত)

বাংলাদেশ সময়: ০০৩৬ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৩, ২০১২
সম্পাদনা: এমএসএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।