দেশের আহূত সরকারি রাজস্বের প্রায় ৮৫ শতাংশই আসে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) অধীন কর, মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) ও কাস্টমস অফিসগুলোর অভ্যন্তরীণ সংগ্রহের মাধ্যমে। তবে সংগৃহীত রাজস্বের পরিমাণ অপ্রতুল।
বিলম্বে হলেও কর ও কাস্টমস অফিস এবং জনবল বৃদ্ধি করে পর্যায়ক্রমে করের আওতা বৃদ্ধির চেষ্টা চলছে। ভ্যাট সংগ্রহ বৃদ্ধির জন্য ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে ইএফডি মেশিন সরবরাহ করা হচ্ছে।
গত বছর আগস্টে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর বিভিন্ন সেক্টরে সংস্কার কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়। রাজস্ব সংস্কারের জন্য গঠিত কমিটি গত জানুয়ারিতে রিপোর্ট দাখিল করে।
সেই রিপোর্টের ভিত্তিতে গত ১২ মে একটি অধ্যাদেশ (২৪, ২০২৫) জারি করা হয়। এর মাধ্যমে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ (আইআরডি) ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) বিলুপ্ত করে রাজস্ব নীতি বিভাগ ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগ নামে দুটি পৃথক বিভাগ প্রতিষ্ঠা করা হয়। সেই অধ্যাদেশ জারির পর এনবিআরে কর্মরত কর ও কাস্টমস ক্যাডার কর্মকর্তারা তাঁদের চাকরিক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা ও ক্ষতির আশঙ্কা করছেন। তাঁদের মতে, এই অধ্যাদেশে সংস্কার কমিটির সুপারিশ পুরোপুরি প্রতিফলিত হয়নি।
নবসৃষ্ট উভয় বিভাগে অন্যান্য ক্যাডার কর্মকর্তাদের সঙ্গে কর ও কাস্টমস ক্যাডার কর্মকর্তারাও কাজ করবেন—এ বিষয়টি উল্লেখ থাকলেও বিভাগের শীর্ষ পদে এবং সিনিয়র পদগুলোতে প্রশাসনসহ অন্য ক্যাডার কর্মকর্তারা পদায়িত হতে পারেন মর্মে কর ও কাস্টমস ক্যাডার কর্মকর্তারা মনে করছেন। নিয়োগ ও পদোন্নতি আরো সীমিত বা প্রশস্ত হবে কি না, এসব বিষয় অধ্যাদেশে স্পষ্ট করা হয়নি। এনবিআর কর্মকর্তাদের ধারণা, সরকার রাজস্ব সংস্কার কমিটির দেওয়া সুপারিশমালা আমলে না নিয়ে একতরফা ও গোপনীয়ভাবে অধ্যাদেশটি প্রণয়ন করেছে। এসব কারণে এনবিআরের অধীন দুটি ক্যাডারের কর্মকর্তারা ‘এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ’-এর ব্যানারে আন্দোলন শুরু করেন। বেশ কিছুদিন কলম বিরতি পালন করা হয়।
বিগত ৫ আগস্টের পরিবর্তনের পর দেশের অর্থনীতি এখনো স্থবিরতা কাটিয়ে উঠতে পারেনি। ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্দাভাবের কারণে রাজস্ব আহরণেও দেখা যাচ্ছে বড় ঘাটতি। এর মধ্যে কর্মকর্তাদের কলম বিরতির প্রভাবে ঘাটতির পরিমাণ আরো বাড়ছে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) বিলুপ্ত করে দুটি পৃথক বিভাগ সৃষ্টির যৌক্তিক ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে প্রধান উপদেষ্টার অফিশিয়াল ফেসবুক পেজে বলা হয়েছে, একটি স্বচ্ছ এবং আরো যোগ্য করব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। ৫০ বছরেরও বেশি সময় আগে প্রতিষ্ঠিত এনবিআর তার রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ধারাবাহিকভাবে ব্যর্থ হয়েছে। ব্যাখ্যায় আরো বলা হয়েছে, নীতি নির্ধারণ ও প্রয়োগ—দুটি এক ছাদের নিচে থাকার ফলে করনীতির সঙ্গে আপস এবং ব্যাপক অনিয়মের সৃষ্টি হয়েছে। বর্তমান ব্যবস্থায় কর আদায়ের সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তারা কোনো জবাবদিহি কাঠামোর অধীন নন। তাঁরা প্রায়ই জনস্বার্থের বিপরীতে কর ফাঁকিবাজদের সঙ্গে আলোচনা করে থাকেন। এনবিআরের বর্তমান কাঠামো নীতি প্রণয়ন ও প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে রাজস্ব আদায়ে পর্যাপ্ত মনোযোগ দিতে পারছে না। ফলে করজাল সংকীর্ণ রয়ে গেছে এবং রাজস্ব আদায় সম্ভাবনার চেয়ে অনেক পিছিয়ে আছে। বর্তমান সংস্কারের মাধ্যমে দুটি বিভাগ সৃষ্টি করে দুই বিভাগের দায়িত্ব স্পষ্ট এবং আরো জবাবদিহিমূলক করা হয়েছে। এর ফলে স্বার্থের সংঘাত থাকবে না। করজাল সম্প্রসারিত হবে, পরোক্ষ কর আদায় বাড়বে।
অভিজ্ঞ মহলের কারো কারো মতে, প্রধান উপদেষ্টার অফিশিয়াল ফেসবুক পেজের কিছু মন্তব্যে এনবিআরের এযাবৎ অর্জনকে খাটো করে দেখা হয়েছে এবং কর্মকর্তাদের পেশাদারি ও জবাবদিহির অবমূল্যায়ন করা হয়েছে। বস্তুত এনবিআর সৃষ্টির প্রথম বছর ১৯৭২-৭৩ সালে আহূত ১৬৬ কোটি টাকার রাজস্ব ৫১ বছরের ব্যবধানে গত অর্থবছরে (২০২৩-২৪) তিন লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা অতিক্রম করেছে। আগে বস্তুনিষ্ঠ ও অর্জনযোগ্য রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হতো। বর্তমানে লক্ষ্যমাত্রা বিগত বছরের আহরণের চেয়ে ৩০ বা ৪০ শতাংশ বেশি থাকে বলে তা অর্জন করা সম্ভব হয় না। বেশ কয়েক বছর ধরে এনবিআরের প্রশাসনিক সংস্কার জনপ্রশাসন ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারণী মহলে আটকে থাকার কারণে রাজস্ব আহরণ ব্যবস্থা অর্থাৎ কর, ভ্যাট ও কাস্টমস অফিস দেশব্যাপী সম্প্রসারণ সম্ভব হয়নি। প্রশাসনিক সংস্কার ও কর আহরণ ব্যবস্থা অটোমেশনের আওতায় এলে করজাল সম্প্রসারণ ও রাজস্ব প্রবৃদ্ধি সম্ভব হবে। এর ফলে কর ফাঁকিও কমবে।
রাজস্ব আহরণ, ব্যবস্থাপনা ও নীতি প্রণয়ন সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। তবে সংস্কার হতে হবে স্বচ্ছ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে, অংশীজনের সঙ্গে ফলপ্রসূ আলোচনা এবং বিশেষজ্ঞদের মতামতের ভিত্তিতে। অভিজ্ঞমহলের অনেকেই বলেছেন, গোপনীয়ভাবে দ্রুততার সঙ্গে এনবিআর বিলুপ্ত করে নীতি ও আহরণ ব্যবস্থাপনা আলাদা করার প্রক্রিয়াটি সঠিক হয়নি।
আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার আলোকে বলতে পারি, এনবিআরের নীতি প্রণয়ন ও রাজস্ব আহরণ একই ছাদের নিচে একজন সচিব/চেয়ারম্যানের তত্ত্বাবধানে হলেও অভিজ্ঞ কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে গঠিত টিম ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা, অর্থমন্ত্রী ও সরকারপ্রধানের পরামর্শ গ্রহণ এবং রাজস্ব প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্য সামনে রেখে নীতি প্রণয়ন করে থাকে। এখানে স্বার্থের সংঘাতটি হচ্ছে ‘রাজস্ব বৃদ্ধির’ লক্ষ্য। রাজস্ব কম অর্জনের কোনো লক্ষ্য থাকে না। লক্ষ্যপূরণ নির্ভর করে দেশের সার্বিক অর্থনীতির গতি-প্রকৃতি, ব্যবসা-বাণিজ্য, দেশের মানুষের ভোগের সামর্থ্য ও চাহিদা, সরকারি ব্যয় ইত্যাদির ওপর। অর্থনীতির স্থবিরতা বা নিম্নগতি, বেকার সমস্যা, জনমানুষের খরচ করার সামর্থ্য হ্রাস ইত্যাদি রাজস্ব বৃদ্ধির অন্তরায়।
ব্যবসায়ী, অর্থনীতিবিদ ও সুধীসমাজ থেকে অনেকে এনবিআর পুনর্গঠনের এই উদ্যোগের প্রশংসা করেছেন। আবার কোনো কোনো অর্থনীতিবিদের মতে, যে প্রক্রিয়ায় এনবিআর বিভক্ত করা হয়েছে, তা ঠিক হয়নি। সরকারের দুটি গুরুত্বপূর্ণ সার্ভিস ক্যাডার, যারা রাজস্ব আদায়ের সঙ্গে সরাসরি জড়িত, তাদের যৌক্তিক মতামত আমলে নেওয়া অত্যন্ত জরুরি।
অর্থ মন্ত্রণালয় গত ২৫ মে সন্ধ্যায় একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জানায়—
১. যেহেতু অধ্যাদেশটি প্রয়োজনীয় সংশোধন করে বাস্তবায়ন করার কাজটি সময়সাপেক্ষ, এনবিআরের সব কার্যক্রম আগের মতো অব্যাহত থাকবে।
২. বিসিএস কর ও বিসিএস কাস্টমস ক্যাডারের স্বার্থ অক্ষুণ্ন রেখে পৃথক্করণের প্রশাসনিক কাঠামো কিভাবে প্রণীত হবে, তা এনবিআরসহ গুরুত্বপূর্ণ সব অংশীজনের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে অধ্যাদেশে প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনা হবে।
৩. বিদ্যমান পরিস্থিতিতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সব কার্যক্রম আগের মতো অব্যাহত থাকবে।
৪. উভয় ক্যাডারের সদস্যদের বর্তমান পদ-পদবি কমানোর পরিকল্পনা সরকারের নেই, বরং সংস্কারকাজ সম্পন্ন হলে তাঁদের পদসংখ্যা বৃদ্ধি পাবে এবং সঠিক পদে নিয়োগসহ পদোন্নতির সুযোগ আরো বৃদ্ধি পাবে।
৫. এনবিআর কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনাপূর্বক সার্বিক সুরাহার স্বার্থে আগামী ৩১ জুলাই পর্যন্ত অধ্যাদেশটির কার্যক্রম স্থগিত থাকবে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের উপরোক্ত আশ্বাসের পরিপ্রেক্ষিতে কর্মবিরতির কর্মসূচি প্রত্যাহার করা হয়। তা সত্ত্বেও ঐক্য পরিষদ ২৬ মে এক সংবাদ সম্মেলনে বর্তমান চেয়ারম্যানের অপসারণের জন্য ২৯ মে পর্যন্ত সময় বেঁধে দেয়। বিষয়টি সুরাহার জন্য অর্থ উপদেষ্টার আশু পদক্ষেপ গ্রহণ প্রয়োজন।
অর্থনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্দাভাব ও বিনিয়োগ স্থবিরতার কারণে চলতি অর্থবছরে বিগত ১০ মাসে প্রায় ৭১ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব ঘাটতি হয়েছে বলে খবরে প্রকাশ। এর সঙ্গে গত প্রায় দুই সপ্তাহ কলম বিরতি রাজস্ব সংগ্রহের কাজ অনেকটা পিছিয়ে দিয়েছে। সরকার ও এনবিআরের কর্মকর্তারা বিষয়টি অনুধাবন করে অর্থবছরের বাকি সময়ে রাজস্ব সংগ্রহ কার্যক্রম জোরদার করবেন—এটাই জনগণ প্রত্যাশা করে।
লেখক: সাবেক সিনিয়র সচিব ও এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান