ঢাকা, রবিবার, ২০ আশ্বিন ১৪৩১, ০৬ অক্টোবর ২০২৪, ০২ রবিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও আমাদের প্রজন্ম ভাবনা

মোহাম্মদ জাহেদ হাসান, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২০৭ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৯, ২০১২
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও আমাদের প্রজন্ম ভাবনা

আমরা যারা এ প্রজন্মের সন্তান তারা মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি কিন্তু শুনেছি শুধু  পাক হানাদার বাহিনী ও তাদের এ দেশের দোসর রাজাকার আলবদর, আল শামসদের লোমহর্ষক নির্যাতন-বিভীষিকার কথা। বহু রক্ত ও ত্যাগের বিনিময়ে মুক্তিযোদ্ধারা ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা এনে দিয়েছিলেন যা নিয়ে আজীবন আমরা গর্ব করতে পারি ।

কিন্তু দেশ স্বাধীন হবার পর মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী পরাজিত শক্তি, একটি চক্র ঠিকই  ষড়যন্ত্র শুরু করে দিয়েছিল এবং নতুন করে সংগঠিত হয়েছিল। মূলত রাষ্ট্রের প্রতিটি স্তরে তাদের অনুপ্রবেশ ঘটেছিল। এরই ধারাবাহিকতায় ঘাতকরা সপরিবারে হত্যা করেছিল বাঙালি জাতির জনক ও জাতীয় চার নেতাকে।

মূলত ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্টের পর ঘাতকরা এই দেশের ইতিহাসকে উল্টে দেওয়ার প্রয়াস চালায় এবং নতুন প্রজন্মকে ইতিহাসের ভুল সংস্করণ শেখানোর চেষ্টা করে। তারা নিজেদের ইচ্ছামত ভুল মানুষকে বীর হিসাবে ইতিহাসে সম্মানের আসনে বসিয়েছে। আর তাদের  এই বিষয়ে সবচেয়ে বড় সহযোগিতা করেছে  তাদেরই নিয়ন্ত্রিত প্রচার মাধ্যমগুলো। দেশ দীর্ঘ সেনাশাসনে থাকায় দেশের মানুষকে মানবাধিকার আর গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করতে হয়েছে, আর এই সময়টা ষড়যন্ত্রকারীরা নিজেদের প্রতিষ্ঠা করেছে , সেই সাথে প্রতিনিয়ত করেছে ইতিহাস বিকৃতি। আজকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে চারদিকে অনেক আলোচনা হচ্ছে । কিন্ত ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা দেখি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া কিন্ত অনেক আগেই শুরু হয়েছিল।

ষড়যন্ত্রকারীরা ইতিহাসের অন্যতম মিথ্যাচার করে বলে থাকেন,  বঙ্গবন্ধু নিজেই যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষমা করে দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ২৬শে এপ্রিল দিল্লির স্টেটসম্যান পত্রিকার সাংবাদিক কুলদীপ নায়ারের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘যারা গণহত্যা করেছে তাদের এর পরিণতি থেকে রেহাই দেয়া যায় না। এরা আমার ত্রিশ লাখ লোককে হত্যা করেছে। এদের ক্ষমা করলে ভবিষ্যৎ বংশধরগণ এবং বিশ্বসমাজ আমাদের ক্ষমা করবেন না। ’ (দৈনিক বাংলা, ৩০/৪/৭২) ।

ঐ সময়কার পত্রিকাগুলো দেখলে দেখা যাবে, বঙ্গবন্ধু দেশের বিভিন্ন জায়গায় সমাবেশ গুলোতে যুদ্ধাপরাধের বিচারের ব্যাপারে দৃঢ় অঙ্গিকার ব্যক্ত করেছেন।   যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য ১৯৭২ সালের ২৪ জানুয়ারী ‘দালাল আইন (বিশেষ ট্রাইব্যুনাল) আদেশ’ জারি করা হয় এবং এ আইনের আওতায় সারাদেশে ৩৭ হাজার ৪৭১ দালালকে গ্রেফতার করা হয়। । ৭৩টি বিশেষ ট্রাইব্যুনালে এদের বিচার কাজ চললেও ২২ মাসে মাত্র ২ হাজার ৮৪৮টি মামলার বিচার সম্পন্ন হয়। এ-রায়ের মাধ্যমে ৭৫২ জন  বিভিন্ন মেয়াদে দণ্ডিত হন। তবে ১৯৭৩ এর ৩০ নভেম্বর সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা হয়। এ-ঘোষণার মাধ্যমে ২৬ হাজার ব্যক্তি মুক্তি পান। বাকীদের বিচার অব্যাহত থাকে।

সাধারণ ক্ষমার প্রেস-নোটে স্পষ্ট ভাবে বলা হয়, ‘ধর্ষণ. খুন, খুনের চেষ্টা, ঘর-বাড়ী অথবা জাহাজে অগ্নি সংযোগের দায়ে দণ্ডিত ও অভিযুক্তদের ক্ষেত্রে ক্ষমা প্রদর্শন প্রযোজ্য হবে না। ’ এরপরও স্বাধীনতা বিরোধীচক্র ও তাদের সমর্থকরা বার-বার এ সাধারণ ক্ষমার কথা উদ্ধৃত করে এবং এর অপব্যাখ্যা দেয়। বলতে গেলে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্যে দিয়েই পাল্টে যায় বাংলাদেশের রাজনীতি। তার পর সামরিক শাসন জারির মাধ্যমে ক্ষমতায় আসেন জিয়াউর রহমান। তিনি ১৯৭৫ এর ৩১ ডিসেম্বর সামরিক অধ্যাদেশ জারী করে দালাল আইন বাতিল করেন। তখন থেমে যায় যুদ্ধাপরাধের বিচার কার্যক্রম। বঙ্গবন্ধু সরকারের জারী করা আইনগুলো একের পর এক অধ্যাদেশ জারীর মাধ্যমে রহিত করা হয়। দুর্ভাগ্য আমাদের ইতিহাসের এই সত্যটি কখনো উচ্চারিত হয় না। মূলত ৯০ এর  স্বৈরাচারবিরোধী গনআন্দোলনের বিজয়ের পর এই নতুন প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাসের সাথে পরিচিত হতে শুরু করে, যার নেতৃত্বে ছিলেন শহীদ জননী জাহানারা ইমাম। তিনি সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করলেন, হয়ে উঠলেন নতুন প্রজন্মের মা। আমাদের  সময়ে পড়া তার লিখা ‘একাত্তরের দিনগুলি’ হয়ে উঠেছিল মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম ইতিহাস। ‘একাত্তরের দিনগুলি’ পড়তে পড়তে আমাদের চোখ ভিজে যায়, বিস্মিত হই যখন ভাবি রুমির মতো অনেক মেধাবী তরুণ তাদের বর্তমানকে উৎসর্গ করেছিল ভবিষ্যৎ প্র্রজন্মের জন্য। জাহানারা ইমাম গণআদালতের মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধীদের প্রতীকী বিচার করে এই প্রজন্মকে দিক নির্দেশনা দিয়ে গিয়েছিলেন। তৎকালীন বিএনপি সরকার এই বিচার ব্যবস্থার বিরোধিতা করেছিল এবং শহীদজননীসহ গনআদালতের কার্যক্রমের সাথে সংশ্লিষ্ট  ২৪জন বিশিষ্ট ব্যক্তির নামে রাষ্ট্রদোহ মামলা দেওয়া হয়। পরবর্তী ১৯৯৪ সালের ২৬শে জুন ক্যান্সারের সাথে যুদ্ধ করে শহীদজননী মারা যান এবং এরই সাথে সাথে এই আন্দোলনেও স্থবিরতা নেমে আসে। ইতিমধ্যে যুদ্ধাপরাধের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা দেশের বিভিন্ন ব্যবসায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, রাষ্টীয় ক্ষমতায় ভাগ বসিয়েছে, তাদের গাড়িতে উঠেছে স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা ! অপমানিত হয়েছে ৩০ লক্ষ শহীদের আত্মা, নিদারুণ মানসিক কষ্টে দিন যাপন করেছে তাদের স্বজনরা। প্রায় ১৪ বছর পর ২০০৮ সালের জাতীয়  নির্বাচনের পূর্বে হঠাৎ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়টি নতুন করে উচ্চারিত হতে শুরু করে। বিশেষ করে নতুন প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নে একটি অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। কারণ মুক্তিযুদ্ধে শহীদ রুমির মত আরও অনেক তরুণের কাছে জাতি ঋণী, আজ এদের ঋণ শোধ করার সময় এসেছে।

এই তরুণ ভোটারদের বিপুল সমর্থনই আওয়ামীলীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটকে সরকার পরিচালনার সুযোগ করে দেয়। নতুন প্রজন্মের দাবী যুদ্ধাপরাধীর বিচার যা আওয়ামীলীগের অন্যতম নির্বাচনী অঙ্গীকার ছিল। এরই মধ্যে সরকার দুটি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে জামায়াত ইসলামীর সাবেক আমির গোলাম আজম সহ কয়েকজন চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীর বিচার কার্যক্রম শুরু করেছে।   বিচার প্রক্রিয়ায় শুরুটা অনেক দেরী হলেও নি:সন্দেহে এটি সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। আমরা এরই মধ্যে লক্ষ করেছি, বিচার প্রক্রিয়া শুরুর পর থেকেই এটি বন্ধের জন্য দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে। প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে দীর্ঘদিন ধরে  লুকিয়ে থাকা স্বাধীনতাবিরোধী এ-চক্রটি সক্রিয় হয়ে দেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে।   এরই মধ্যে বিজয়ের মাস ডিসেম্বরে তাদের তাণ্ডব দেশবাসী প্রত্যক্ষ করেছে। এছাড়া আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে-১ এর সাবেক চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হকের স্কাইপি কথোপোকথন হ্যাকড করার মাধ্যমে সহজে অনুমেয় যে স্বাধীনতাবিরোধী এই চক্রটি চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচাতে কতটা মরিয়া। দীর্ঘদিনের ইতিহাস বিকৃতির কারণে এ প্রজন্মের অনেকে এখনো মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানে না। যাদের জন্য এদেশ স্বাধীন হলো তাদের স্বীকৃতি না দিলে, মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস না জানলে এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচার না হলে ইতিহাস আমাদের কখনো ক্ষমা করবে না। তাই আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী প্রজন্মের, আমরাই পারি আবারও সকলকে ঐক্যবদ্ধ করতে। আর এজন্য সামাজিক নেটওয়ার্ক, ব্লগ ও বিভিন্ন মিডিয়াতে  এই ব্যাপারে ব্যাপক প্রচার চালাতে হবে এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্তিয়া যেন কোনো মতেই বাধাগ্রস্ত হতে না পারে সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে।

মোহাম্মদ জাহেদ হাসান, উন্নয়ন ও মানবাধিকার কর্মী

বাংলাদেশ সময়: ১১৫২ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৯, ২০১২
সম্পাদনা: জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।