ঢাকা, শনিবার, ১৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

জটিলতা, গ্রুপিং এবং গুরুত্ব

মফস্বল সাংবাদিকদের সাতকাহন

মাহাবুর আলম সোহাগ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯৩৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৪, ২০১২
মফস্বল সাংবাদিকদের সাতকাহন

মফস্বলে সাংবাদিকদের নিজেদের মধ্যে জটিলতা, গ্রুপিং এবং গুরুত্ব নিয়ে দ্বন্দ্বের শেষ নেই। নতুন কোনো সাংবাদিকের আগমন ঘটুক এটা হয়তো কোনোভাবেই মেনে নিতে পারেন না প্রবীণ সাংবাদিকরা।

এর বাস্তব প্রমাণ আমি নিজেই। সাংবাদিকতায় অনেক আগে থেকেই আগ্রহ আমার। টিভিতে কোনো নাটকে সাংবাদিক হিসেবে কোনো চরিত্র থাকলে খুব মনোযোগ দিয়ে নাটকটি দেখতাম।

এছাড়াও আমি যে এলাকায় থাকতাম ওই এলাকায় কোনো সাংবাদিক এলে আমি সেখানে হাজির হতাম তাকে দেখার জন্য। এতটাই আগ্রহ ছিল এবং আছে আমার সাংবাদিকতাকে ঘিরে। এজন্য শুরু থেকেই এ পেশার মানুষগুলোকে খুব সম্মান করতাম, এখনও করি।    

এরই ধারাবাহিকতায় ২০০২ সালের দিকে আমারও আগ্রহ জাগে সাংবাদিকতা পেশার প্রতি। তখন আমি কেবলমাত্র এসএসসি পাস করেছি। একদিন নিজ জেলা ঠাকুরগাঁও থেকে ঘুরতে গেছি দিনাজপুর শহরে। স্টেশন রোডে একটি দোকানে দেখি ‘দৈনিক রংপুরের কাগজ’ নামে একটি পত্রিকায় সংবাদদাতা চেয়ে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে পত্রিকাটি কিনে ছুটলাম পত্রিকা অফিসে।

অফিসে যাওয়ার পর কথা হয়, ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সাহেবের সঙ্গে। তখন পত্রিকাটির ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ছিলেন মোস্তাফিজুর রহমান কাজল। অনেক কথা হয় তার সঙ্গে। তিনি অফিসিয়াল বিভিন্ন নিয়মের বিষয় জানালেন। সেই সঙ্গে এই ফরম পূরণ করতে হবে, ওই ফরম পূরণ করতে হবে। আরও অনেক কিছু। এটা করতে এত টাকা লাগবে, কার্ড করতে হবে, সেটার জন্য আলাদা টাকা লাগবে। তার সব প্রস্তাবে রাজি হয়ে যাই। কারণ, আমাকে সাংবাদিক হতেই হবে। সঙ্গে যে কয়টা টাকা ছিল, সেগুলো দিয়ে দিলাম তাকে। এরপর তিনি একটা কার্ড ধরিয়ে দেন, সেই সঙ্গে সংবাদ পাঠানোর অনুমতিও।

এরপর এলাকায় এসে শুরু হলো আমার কাজ। যেখানেই কোনো ঘটনা, সেখানেই আমি। ঘটনা যতই ছোট বা বড় হোকনা কেন ছুটে যেতাম ঘটনাস্থলে। ঘটনাস্থল থেকে ফিরে বসতাম সংবাদ লিখতে।

কিন্তু সংবাদ কোন পদ্ধতিতে লিখতে হয়, তা জানতাম না। চিন্তা করলাম, স্থানীয় সাংবাদিকদের সহযোগিতা নেবো। গেলাম কয়েকজনের কাছে। কিন্তু কেউ আমাকে প্রথম অবস্থায় পাত্তা দিলেন না। প্রতিদিন সকালে বের হয়ে তাদের পেছনে পেছনে ঘুরতাম সংবাদ লেখার স্টাইল শেখার জন্য।

তখন অবশ্য আমাকে সংবাদ পাঠাতে হতো পোস্ট অফিস অথবা কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে। ঠাকুরগাঁওয়ে তখন ইন্টারনেট ও ফ্যাক্স ছিল।   কিন্তু অনেক টাকা লাগতো, ওই মাধ্যমে সংবাদ পাঠাতে।

এর মাঝে অনেকে বিভিন্ন কথা বলে আমাকে নিরুৎসাহিত করার চেষ্টাও করেছেন। অনেক সিনিয়র সাংবাদিক কটুক্তি করে অনেক কথা বলেছেন আমাকে। তারপরও সারাদিন ঘুরতাম তাদের পেছনে। যেদিন কেউ আমাকে কোনো কাজ দিতেন সেদিন আমি খুব খুশি হয়েছি। কারণ, এবার বুঝি তারা আমাকে মেনে নিতে শুরু করেছেন, এই ভেবে।

অন্যদিকে, পরিবার থেকেও কোনো সহযোগিতা পাইনি। সবাই শুধু বলেছে, সাংবাদিকতা করে কেউ সংসার চালাতে পারেনা। তুই পড়ালেখা বাদ দিয়ে খামাখা টাকা নষ্ট করছিস। আমাকে দেখে যখনই কেউ এরকম কথা বলতো আমি তাকে হাসির গল্প শুনিয়ে প্রসঙ্গটা ভুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতাম।
 
এমনি করে চলতে থাকে দিন। এরপরে সময়ের পরিক্রমায় আস্তে আস্তে স্থানীয় সাংবাদিকরা আমাকে মেনে নিতে শুরু করলো। সেই সঙ্গে সাহায্য করাও। তারা যে সংবাদ পাঠাতেন, তার কপিটা আমাকে দিতেন। আমি সেটা হাতে লিখে কুরিয়ার করতাম।
এভাবে কেটে যায় এক বছর। এরপর রংপুরের ‘দাবানল’ পত্রিকায় কাজ শুরু করলাম। ওই পত্রিকার সম্পাদক গোলাম মোস্তাফা বাটুল। সাংবাদিকতা নিয়ে তিনি আমাকে বিভিন্ন বাস্তব ধারণা দিলেন, যা এখনও আমার খুব কাজে লাগছে। তার পত্রিকায় দুই বছর কাজ করি। তখন থেকেই সাংবাদিকতা একটু-আধটু বুঝতে শুরু করলাম।

এরপর ঢাকার একটি জাতীয় দৈনিকে নিয়োগ পেলাম ঠাকুরগাঁও সংবাদদাতা হিসেবে। সেই সঙ্গে মূল্যায়নও বৃদ্ধি পেলো অন্যান্য সাংবাদিকদের কাছে আমার। খুব জোরেসোরে কাজে নামি তখন। যেখানেই কোনো ঘটনা, সেখানেই সবার আগে যাওয়ার চেষ্টা করেছি আমি। ঘটনাস্থল থেকে ফিরে দ্রুত সংবাদ তৈরি করে ফ্যাক্স করতাম। এরপর অফিসে মফস্বল সম্পাদককে ফোনে জানাতাম, ভাই একটা সংবাদ ফ্যাক্সে পাঠিয়েছি, দেখবেন পেয়েছেন কিনা? ওপার থেকে ফোন রিসিভ করে বলতেন, ঠিক আছে দেখবো। এই বলে ফোনের লাইনটা কেটে দিতেন।

সংবাদটি পেয়েছে কিনা নিশ্চিত হতে না পেরে কিছুক্ষণ পর আবারও ফোন করতাম- ভাই, সংবাদটা পেয়েছেন? ওপাশ থেকে মেজাজ খারাপ করে বলতো, বললাম তো দেখবো। এই বলে আবারও ফোনটা কেটে দিতো।

পরের দিন অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতাম আমার সংবাদটি হয়ত ছাপা হয়েছে। সারারাত ঘুমাতে পারতাম না সেদিন। রাত জেগে শুধু ভাবতাম, কোন পাতায় ছাপা হতে পারে সংবাদটি?

খুব সকালে ঘুম থেকে উঠেই চলে আসতাম পত্রিকা এজেন্টের দোকানে। এসে দেখতাম, দোকানই খোলা হয়নি।

এরপর পত্রিকা আসার সঙ্গে সঙ্গেই সংবাদটা খুঁজতে শুরু করতাম, এ পাতা, ওপাতা। সব পাতা খোঁজা শেষ, কিন্তু আমার লেখা সংবাদটা নেই। মনটা খুব খারাপ হয়ে যেতো। মাঝে-মধ্যে খুব রাগ হতো মফস্বল সম্পাদকের ওপর। কারণ, কোনো দিনও তার সঙ্গে ভালোভাবে কথা বলার সুযোগ দিতেন না। আমি কী বলতে চাই, তা তিনি না শুনেই ফোনের লাইন কেটে দিতেন।

এটা বাংলাদেশের বেশির ভাগ মিডিয়াতেই ঘটে। মফস্বল সম্পাদকের অহেতুক দাপটে জেলা বা উপজেলা পর্যায়ের সাংবাদিকরা ভীত থাকেন। সামান্য ভুলে মাঝে-মধ্যে তারা অফিস থেকে ফোন করে যা খুশি তাই বলেন। তবুও শত কষ্টের মাঝেও মফস্বল সাংবাদিকরা মুখ বুঝে সব সহ্য করেন।

অথচ পত্রিকা অফিস থেকে কোনো সাংবাদিক বা কর্মকর্তা মফস্বলের কোনো সাংবাদিকের এলাকায় গেলে তাকে যে সম্মান করেন তারা, সেটা ওই কর্মকতার জীবনের সবচেয়ে বড় পাওয়া বলে আমি মনে করি।

থাক ওই সব কথা। ফিরে আসি, নিজের কথায়। তবে তার আগে আমার জেলার স্থানীয় সাংবাদিকদের কৃতজ্ঞতা জানাতে চাই। যাদের কারণে আজ আমি আমার কর্মস্থলে। তারা আমাকে যে কত ভালোবাসতো তার প্রমাণ এখন পাচ্ছি। তাদের জন্য আমি একটিই কথা বলবো সেটি হলো, আমি আপনাদের কাছে চির কৃতজ্ঞ।

যাহোক, মফস্বলে সাংবাদিকতার পাট চুকিযে চলে আসি ঢাকায়। তবে এবার ‘মফস্বল সাংবাদিক’ হিসেবে নয়, ‘মফস্বল সম্পাদক’ হয়ে।

ঢাকায় কাজ শুরুর পর মফস্বল সাংবাদিকদের দুঃখ-বঞ্চনা, না-পাওয়ার বেদনা নিয়ে ভাবতে থাকি। কারণ, মফস্বল সাংবাদিকদের বঞ্চনার অন্ত নেই, তা আমি ভালো করেই জানতাম।

পরিশ্রমের বিনিময়ে অর্থ অপ্রাপ্তির বিষয়টি তো আছেই। কিন্তু, অনেক কষ্টে পাঠানো কোনো খবর যখন ছাপা হয় না অথবা চ্যানেলে সম্প্রচার হয় না, তখন তাদের দুঃখবোধের মাত্রার সীমা-পরিসীমা থাকে না। কিন্তু, তাদের কিছুই করার থাকে না!

মফস্বলের সাংবাদিকরা নিজেদের সুবিধার জন্য পরস্পরের সঙ্গে সংবাদ বিনিময় করেন। দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা এ এক সাধারণ রীতি। লক্ষ্য একটাই, খবর যাতে ‘মিস’ না হয়। এ নিয়ে সুবিধার জায়গায় অসুবিধার ঘটনা ঘটে। দেখা গেল, যিনি খবরটি সংগ্রহ করেছেন, তার নিজের পত্রিকাতেই নিউজটি ছাপা হলো না। অথচ যিনি তার কাছ থেকে খবরটি নিয়ে পাঠান, সেই সাংবাদিকের পত্রিকায় ছাপা হয়। তখন সংবাদ সংগ্রহকারী পড়েন বিড়ম্বনায়। এ ধরনের ঘটনার নেতিবাচক প্রভাবের প্রায়ই শিকার হন মফস্বলের সাংবাদিকরা।

নিউজ ‘মিস’ করলে বকা-ঝকা খেতে হয়। কিন্তু বেতন, মোবাইল ফোন ও ফ্যাক্স বিলের কথা বললেই কর্তৃপক্ষ নারাজ হন। বাদ দেওয়ার হুমকি দেন। নিউজে ভুল হলে খবর আছে। ভালো হলে কখনোই ধন্যবাদ জোটে না। এ এক উদ্ভট ব্যাপার!

এ পেশাতে এক ধরনের মোহ আছে। এ এক সর্বনাশা নেশা। বলা যায়, মফস্বল সাংবাদিকদের অনেকেই এই ‘সর্বনাশা নেশায়’ হাবুডুবু খান। আর তাই হয়তো ছাড়েন না। সরেন না। আসলে ছাড়তে পারেন না। ছাড়া যায় না।

ঢাকার সাংবাদিকদের মধ্যে হিংসা, রেষারেষি, সহযোগিতা সবই হয়। এসব হয় কৌশলে। গোপনে। ধূর্ততার সঙ্গে। অনেকেই জানতে পারেন না। মফস্বলেও এ ধরনের অবস্থা বিরাজমান। তবে সবই হয় প্রকাশ্যে। পক্ষ দু’টো। হয় শত্রু, নয় বন্ধু। মাঝামাঝি সম্পর্ক বলে কিছু নেই। গ্রুপিংয়ের মাত্রা ও অবস্থান অনেক বেশি শক্ত, কঠোর। প্রয়োজনে কঠোরতর।

ভালো-মন্দ এসব মিলিয়ে চলতে হয়, মফস্বল সাংবাদিকদের। তারা জড়িত স্থানীয় রাজনীতিতে, প্রশাসনে, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে। তারা এলাকার কোন কোন জায়গায় আছেন, তার খোঁজ নিতে গেলে কূলকিনারা পাওয়া কঠিন হবে।

আমার ক্ষুদ্র অভিজ্ঞতায় মনে হয়, কোনো সংবাদ লিখে সাধারণ মানুষের উপকার করার কিংবা স্থানীয় কোনো প্রভাবশালীকে ধরাশায়ী করার যে ক্ষমতা একজন জেলা সংবাদদাতার আছে, তার কাছাকাছি যাওয়ার ক্ষমতাও ঢাকার অনেক  ‘বিশেষ সংবাদদাতার’র নেই।

নিঃসন্দেহে এদিক থেকে ‘মফস্বল সাংবাদিকরা’ অনেক বেশি ক্ষমতাধর। সম্ভবত, এটিই মফস্বল সাংবাদিকদের সবচেয়ে ভালোলাগা ও তৃপ্তির বিষয়। এ ক্ষমতা তার অনেক অপ্রাপ্তির শূন্যতা পূরণ করে দেয়।

লেখক: নিউজরুম এডিটর, বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

বাংলাদেশ সময়: ১৯২৬ ঘণ্টা, ২৪ ডিসেম্বর, ২০১২
সম্পাদনা: একে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।