নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী মারিয়া কোরিনা মাচাদো তার পুরস্কারকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রতি উৎসর্গ করেছেন। এতে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প খুশিতে গদগদ হলেও তিনি নিজে নোবেল না পাওয়ার দুঃখ যন্ত্রণা ভোলেননি।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এবারের নোবেল পুরস্কারের জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা তদবির করেছেন। তিনি নিজেই বলেছেন, আমি ৮টি যুদ্ধ থামিয়েছি। আমিই শান্তিতে নোবেলের যোগ্য। অবশ্য, তিনি একথা বলেননি যে, ৮টি যুদ্ধের ৭টিই তিনি লাগিয়ে ছিলেন। সে যাই হোক, যদি কোথাও যুদ্ধ না করে, যুদ্ধ না লাগায় তাহলে তিনি কীসের মার্কিন প্রেসিডেন্ট! সেই ধারাবাহিকতায় প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যেসব যুদ্ধ লাগিয়েছেন তার মধ্যে সবচেয়ে বিপজ্জনক ও ধ্বংসাত্মক যুদ্ধ হলো—ইসরায়েল-ইরান যুদ্ধ এবং গাজা যুদ্ধ। গাজা যুদ্ধে ৬৭ হাজার নিরাপরাধ সাধারণ নাগরিকের জীবন গেছে। আহত ও পঙ্গু হয়েছে দেড় লক্ষাধিক। শুধু তাই নয়, গাজাবাসীর সব বাড়ি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। স্কুল-কলেজ, হাসাপাতাল, মসজিদ, গির্জা এমনকি রেডক্রসের ত্রাণশিবির কোনোটাই রক্ষা পায়নি। তার পরও হোয়াইট হাউস ট্রাম্পের জন্য তদবির করে। তদবির করে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ও সেনাপ্রধানসহ আরও কয়েকটি দেশের নেতানেত্রী, বিশিষ্ট ব্যক্তিরা।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ভাগ্যের শিকা না ছিঁড়লেও ছিঁড়েছে তার মতোই এক যুদ্ধ উন্মাদ কট্টোর ইসরায়েল সমর্থক মারিয়া কোরিনা মাচাদোর। লাতিন আমেরিকার দেশ ভেনেজুয়েলার কথিত গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নেত্রী এই মাচাদো ইসরায়েলের প্রতিটি সামরিক পদক্ষেপকে সমর্থন দিয়েছেন। এমনকি গাজায় ইসরায়েল যে বর্বরতা চালিয়েছে তার পক্ষেও তিনি তার নিজ অবস্থান ব্যক্ত করেছেন। শুধু তাই নয়, ভেনেজুয়েলার নিকোলাস মাদুরোর সরকারকে উৎখাত করতে তিনি ইসরায়েলকে সামরিক হামলা চালানোর আহ্বান জানিয়ে চিঠি লেখেন। নিজ দেশে বিদেশি বাহিনীর আক্রমণের আহ্বান যে নেতা বা নেত্রী করতে পারেন, সেই নেতানেত্রী যে জনবিচ্ছিন্ন, বিদেশি এজেন্ট, স্বাধীনতা ও স্বার্বভৌমত্বের শত্রু—এটা কানার ভাই অন্ধও জানে। শুধু ইসরায়েলকে নয়, ইতিপূর্বে ২০২৪-এর প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তার দলের প্রার্থীর ভরাডুবি হলে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকেও সামরিক হস্তক্ষেপের আহ্বান জানান। যার জন্য যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিন ধরে অপেক্ষা করছে। তারই পরিণতি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে ভেনেজুয়েলার উপকূলে প্রথমবারের মতো মাদক বহনকারী নৌকার অজুহাত তুলে ওই নৌকায় বিমান হামলা করে ১১ জনকে হত্যা করে। এরপর ১৫ অক্টোবর পর্যন্ত ৪ দফার হামলায় ২৭ জনকে হত্যা করেছে। এমনকি বিমান থেকে বোমাবর্ষণ করেছে। হুমকি দিয়েছে, স্থল অভিযানের। কার্যত যুদ্ধের হুমকি। আগ্রাসন চালানোর আগাম ঘোষণা।
দেশপ্রেম ও গণতন্ত্রের মূর্ত প্রতীক দাবিদার মাচাদো এখন আত্মগোপনে থেকে দেশবিরোধী চক্রান্ত্রে লিপ্ত। তাইতো প্রেসিডেন্ট মাদুরো তাকে ডাইনি বলে বর্ণনা করেছেন। আন্তর্জাতিক বিশ্বও তার ইসরায়েল প্রীতি ও গাজার মানুষের প্রতি বিদ্বেষে সমলোচনায় মুখর হয়েছে। ঠিক সেই সময় নরওয়েজিয়ান নোবেল কমিটি মাচাদোকে শান্তিতে নোবেল পুরস্কারের ঘোষণা দিয়েছে। ঘোষণায় বলা হয়েছে, ভেনেজুয়েলার মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ে নিরলসভাবে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন ‘নোবেল’ তারই স্বীকৃতি। এক্ষেত্রে বিস্ময়কর হলো— নোবেল পুরস্কারের কথা শুনে মাচাদো নিজেও অবাক হয়েছেন। তিন বলেছেন— আমার জীবনের বড় বিস্ময়গুলোর এটা একটি।
একই সঙ্গে তিনি বলেছেন, তার নোবেল জয় ও যুক্তরাষ্ট্রের চাপ ব্যবহার করে তিনি মাদুরো সরকারকে উৎখাত করতে সক্ষম হবেন। লক্ষণীয় বিষয় এই যে, তিনি কোনো গণআন্দোলনের কথা বলেননি, যা বলেছেন তা হলো— বহিঃশক্তির হস্তক্ষেপে তিনি মাদুরো সরকারকে উৎখাত করবেন। তারপরও এটা সত্য ও বাস্তবতা যে, তিনি ভেনেজুয়েলার মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের লড়াই করার জন্য শান্তিতে নোবেল পুরস্কার লাভ করেছেন। আর তাই তো নোবেল শান্তি পুরস্কার অতীতের মতো আবারও বিতর্কিত পুরস্কার হিসেবে চিহ্নিত হতে যাচ্ছে। খোদ হোয়াইট হাউজ বলেছে, এতে আমরা ‘রাজনীতি দেখছি’।
গাজায় চলমান সংকট ও মানবিক বিপর্যয়ের পরিপ্রেক্ষিতে অনেক মানবাধিকার সংগঠন ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক মাচাদোর অবস্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। অনেকে বলেছেন, শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে দেওয়া পুরস্কারের সাথে তার অবস্থান সাংঘর্ষিক।
অবশ্য, নোবেল কমিটির চেয়ারম্যান জানিয়েছেন, “মাচাদোর সাহসিকতা ও গণতন্ত্রের প্রতি অঙ্গীকারই তাদের সিদ্ধান্তের ভিত্তি। তার ইসরায়েল প্রীতি তার বৃহত্তর রাজনৈতিক অবস্থানের অংশ, যেখানে তিনি বিদেশি হস্থক্ষেপের মাধ্যমে ভেনেজুয়েলায় পরিবর্তন আনার পক্ষে ছিলেন। ”
নোবেল কমিটির বক্তব্যের মধ্যেই স্পষ্ট যে, মাচাদো সাম্রাজ্যবাদের পেশি শক্তির ওপর নির্ভরশীল ব্যক্তি। অর্থাৎ সাম্রাজ্যবাদের পুতুল। আর এই পুতুলরা সব সময় সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থ রক্ষায় নিবেদিত প্রাণ থাকে। আর তাই তো সকল বিতর্ককে পদদলিত করে মাচাদো আগামী ডিসেম্বরে আনুষ্ঠানিকভাবে নোবেল শান্তি পুরস্কার গ্রহণ করবেন। এতে ট্রাম্প সাহেবের আক্ষেপ হলেও সান্ত্বনা এই যে, তিনি নোবেল না পেলেও, নোবেল পেয়েছে তার রাবার স্ট্যাম্প।
মাহবুব আলম: লেখক ও সাংবাদিক।
এমজেএফ