ঢাকা, শনিবার, ১৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

যুদ্ধাপরাধ নিয়ে স্কাইপি-সংলাপ ও সরকারের ভূমিকা

ফারুক যোশী, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১৪৩ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২, ২০১৩
যুদ্ধাপরাধ নিয়ে স্কাইপি-সংলাপ ও সরকারের ভূমিকা

বাংলাদেশের এখন প্রধান আলোচনার একটি বিষয় যুদ্ধাপরাধী বিচারের ইস্যু। বাংলাদেশের দীর্ঘ একচল্লিশ বছরের ইতিহাসে এই ইস্যুটা এতটা গুরুত্ব পায় নি, যা পেয়েছে এ সরকারের আমলে।

নির্বাচনী ইশতেহার হোক কিংবা মানবিক-রাষ্ট্রিক দায়বোধ থেকেই হোক, রাষ্ট্রের জন্যে এ এক বিরাট চ্যালেঞ্জ। অন্যদিকে বিচারের রায় হওয়া সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করছে বিচার বিভাগ কিংবা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য গঠিত ট্রাইব্যুনালের উপর।

একদিকে এ নিয়ে আছে সারা দেশের মানুষের একটা আকাঙ্ক্ষা; অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী একটা দল হিসেবে খুবই স্বাভাবিকভাবে তার নেতাদের বাঁচাতে চালিয়ে যাচ্ছে শেষ চেষ্টা। স্বীকার করতেই হবে, দল হিসেবে একটা সংগঠিত দল জামায়াত কিংবা তার অঙ্গ সংগঠনগুলো। ইউরোপে আছে তাদের দলের একটা বড় ভিত। যদিও জামায়াত কিংবা শিবির নামে তাদের দলীয় কোনও অবস্থান নেই। কিন্তু বলতেই হয়, একটা শক্ত কার্যক্রম আছে তাদের বিভিন্ন নামে-বেনামের ব্যানারে। একথা সবাই-ই জানেন, ইউরোপে একটা শক্তিশালী অর্থনৈতিক ভিতও আছে তাদের।  

বাতাসে রাজনৈতিক একটা গুঞ্জন ছিলো, ডিসেম্বরেই যুদ্ধাপরাধী হিসেবে অভিযুক্ত দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিচারের রায় হয়ে যাবার। সত্যি কথা বলতে গেলে কি এটা আটকে গেছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের (আইসিটি-১) চেয়ারম্যান পদত্যাগকারী মাননীয় বিচারক নিজামুল হক`র স্কাইপি সংলাপ রায় প্রদানে যে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে, তা স্বীকার করতেই হবে। এ নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়েছে বিশ্বময়। বিশেষত বাঙালি যেখানে, সেখানেই এই আলোচনাটি এখনও মিলিয়ে যায় নি। অনেকেরই ধারণা ছিলো ষোলই ডিসেম্বরের আগেই সাঈদী ইস্যুর একটা ফয়সালা হবে। কিন্ত হয় নি। আশ্চর্যের বিষয়, এই ব্যাপারটা যখন অনেকটা শেষপর্যায়ে ছিলো বলেই রাজনৈতিক আকাশে গুঞ্জন ছিলো, তখনই স্কাইপি সংলাপটি বিশ্ব মিডিয়ায় স্থান করে নেয়। ব্রিটেনভিত্তিক দি ইকোনেমিস্ট এই স্কাইপি-কথোপকথনটি ফাঁস করে দেয়। এখানেই দেখার বিষয়, ব্রিটেন কিংবা ইউরোপের অসংখ্য সমস্যা-সংকট এমনকি সারা পৃথিবীর অর্থনীতিকে যখন ধাক্কা দিচ্ছে তখন ইকোনমিস্ট এই দায়টুকু নিলো-ই বা কেন?

খোলাচোখে বলা যেতে পারে, একটা পত্রিকা তার এথিকস-এর প্রয়োজনে(?) হয়ত এই কাজটি করেছে। শুধুই কি তাই? ব্রিটেনে চলছে যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচানোর জোর তৎপরতা। এর আগে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে এদের বাঁচাতে ব্রিটেন-আমরিকার নামী-দামী কৌঁসুলি নিয়োগের ব্যাপারটা। এর আগে আমরা জেনেছি কত শত কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হচ্ছে অপরাধীদের বাঁচানোর প্রক্রিয়ায়। যুদ্ধাপরাধী তথা সাঈদীর বিচার চূড়ান্ত হবার একটা মোক্ষম সময়ে কিন্তু এই কাজটি করলো ইকোনমিস্ট। এতে কি কোনো ইঙ্গিত আছে ? কেন-ই বা এই সময়টা বেছে নিলো ইকোনমিস্ট ? এ প্রশ্নটি ব্রিটেনের মূলধারার গণমাধ্যম কিংবা রাজনীতিতে আলোচিত বিষয় না হলেও বাংলাদেশে গনমাধ্যমকর্মীদের বিষয়টা ভেবে দেখতে হবে। এমনকি বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় যারা আসীন, তাদেরও ভাবনায় নেয়া প্রয়োজন এটা। এর রেশ ধরেই গত ক‘দিন আগে ব্রিটেন সফররত বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মণিকে জিজ্ঞেস করেছিলাম ইকোনমিস্টের এই স্কাইপি সংলাপ হ্যাকিং এর বিরুদ্ধে রাষ্ট্র কি কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে। কিংবা সরকার কি কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে? কারো প্ররোচনায় কি এ কাজটি করলো ইকোনমিস্ট ? জানিনা মন্ত্রী প্রশ্নের জবাব এড়িয়ে গেলেন কেন। ইকোনমিস্টের মতো বিশ্ব মানের পত্রিকাকে না চটানোর জন্যেই কি তিনি বলতে পারেন নি কিছু। শুধু উত্তর দিলেন----যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রয়োজনে যা যা প্রয়োজন, তা করছে সরকার। এটা কি কোনো সদুত্তর হলো ?

বিচারপতি নিজামুল  এবং ব্রাসেলস্ এ বাস করা আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ বিশেষজ্ঞের স্কাইপি সংলাপ ফাঁস করেছে ইকোনমিস্ট। এটা করতেই পারে। এটা করে ইকোনমিস্ট কি কোনো অপরাধ করেছে? সে প্রশ্ন আসতেই পারে। হ্যাকিং এখন বিশ্বজুড়ে একটা ওপেন সিক্রেট ব্যাপার। তবে সত্যি কথা বলতে কি এটা তথ্য-চুরির পর্যায়েই চলে যায়। এবং সে হিসেবে এটা এক ধরনের অপরাধও বটে। উইকিলিকস সংবাদ মাধ্যমটি বিখ্যাত হয়েছে বলতে গেলে শুধু হ্যাকিং করেই। উইকিলিকস এর কর্ণধার জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ সারা পৃথিবীর মানবতাবাদীদের জন্যে নিয়ে এসেছেন কিছু নতুন বার্তা। সাম্রাজ্যবাদীদের মুখোশ উন্মোচন করতে পেরেছেন তিনি জনসমক্ষে। কিন্তু এটা কি অন্যায়? অ্যাসাঞ্জ যা করেছেন, তা-কি অনৈতিক? বিশ্বমানবতার জন্যে তা কিন্তু কল্যাণ বয়ে এনেছে, এমনকি গণমাধ্যমের জন্যেও নিয়ে এসেছে এক যুগান্তকারী বার্তা। যদিও তাকে এর জন্যে মাসুল গুনতে হয়েছে, কারণ আইনি প্রক্রিয়ার মাঝেই অবস্থান করতে হবে তাকে। তা তিনি অস্ট্রেলিয়ায় বা পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকুন না কেন। কিন্তু তারপরও সত্যি কথাটা হলো, অ্যাসাঞ্জ এখন তার দেশে জনপ্রতিনিধি হবার জন্যে প্রস্তুতি নিচ্ছেন। সময় বলে দিচ্ছে অ্যাসাঞ্জ কিংবা তার উইকিলিকস-এর এ তথ্য-হ্যাকিং মানব সভ্যতার অগ্রযাত্রায় কি-ই অবদান রাখছে।

বিচারপতি নিজামুল হক-এর বিচারক জীবনের বাইরেও একটা জীবন আছে। তার বিচার প্রক্রিয়াকে আরও গ্রহণযোগ্য করতে তিনি বইয়ের বাইরে বিশেষজ্ঞের সাথে আলাপ-আলোচনা কি করতে পারেন না? এটাতো কোনো অনৈতিক বিষয় হতেই পারে না। এমনকি এ আলাপকে অন্যায় বলার মতো কোনো কারণও নেই। একজন বিচারক কোনোভাবেই ধর্মগ্রন্থের ফেরেশতা কিংবা দেবতা নন, আর সে হিসেবে তার ব্যক্তিগত আলাপচারিতা থাকবেই। সেজন্যেই হয়ত এমনকি সরকার নিয়েও তার সমালোচনা স্থান পেয়েছে ১৭ ঘন্টার ফোনালাপে। কিন্তু কথা হলো, এই আলাপচারিতা ফাঁস হওয়ায় বিচার বিলম্বিত হচ্ছে। এটা বাংলাদেশের তথা একটা জাতির আকাঙ্ক্ষাকে সাময়িক ধাক্কা দিয়েছে। অন্যকথায় অ্যাসাঞ্জ যে মানবিক দায়বোধ থেকে কিছু কিছু তথ্য ফাঁস করেছিলেন, তা ইকোনমিস্টের মানবতার সাথে যায় না। কারণ মানবতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে ধর্ষণ-খুন করা অপরাধীরদের বিচার এই হ্যাকিং এর মাধ্যমে বিলম্বিত হচ্ছে, বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এখানেই পার্থক্য, এখানেই বিভেদ। এখানেই প্রশ্ন ওঠে, কোন্ মিডিয়া মানবতার পক্ষের, আবার কোন্ মিডিয়া বায়্যাসড বা পক্ষপাতদুষ্ট।

এখন আসতে পারি বাংলাদেশ প্রসঙ্গে। বাংলাদেশে এ নিয়ে হয়েছে তুলকালাম কাণ্ড। বাংলাদেশে আমার দেশ পত্রিকা এ সংবাদটি ছাপিয়েছে। ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করেছে এই ফোনালাপ। নিঃসন্দেহে তা-ও সাংবাদিকতার বাইরে নয়। একটা সংবাদমাধ্যম তা করতেই পারে। যদিও বাংলাদেশে অনেক গণমাধ্যমই এটা এড়িয়ে গেছে। কিন্তু “আমার দেশ” এটা এড়িয়ে যায় নি। যুদ্ধাপরাধী বাঁচানোর এজেন্ডা বাস্তবায়নকারীদের মধ্যে অনেকেই আমার দেশকে টেনে আনেন। “আমার দেশ” এ কথোপকথন ছেপে সেই কাজটি করতেও পেরেছে। কিন্তু যে ব্যাপারটা ভাবনা জাগায়, তাহলো সরকার কেন-ই বা এই পত্রিকাকে নিয়ে এত নাটক সৃষ্টি করলো ?  যেহেতু ফেইসবুক-টুইটার তথা সামাজিক নেটওয়ার্কগুলোতে ব্যাপারটা সাথে সাথেই জায়গা করে নিয়েছিলো, সেহেতু  ‘আমার দেশ’কে নিয়ে টানা-হেঁচড়া করার কি কোন প্রয়োজন ছিলো ? বিচারপতি তার দায়ভার নিয়ে পদত্যাগ করে নজির সৃষ্টি করলেন অথচ সরকার করলো উল্টোটা। অহেতুক সাংবাদিকদের পিছু লেগে দেশ-বিদেশে আরেকটা আলোচনার উর্বর ক্ষেত্র তৈরি করে দিলো সরকার। অথচ এর কোনো প্রয়োজন ছিলো না। এ নিয়ে সাংবাদিক হয়রানি অবশ্যই কোনো ইতিবাচক যুক্তির মধ্যে পড়ে না। সরকারকে এমন আচরণ করা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। বিদেশি একটি সংবাদেরর বহুল আলোচিত সংবাদ বাংলা অনুবাদ করে ছাপানোর মাঝে আমার দেশের মূলত কোনো ক্রেডিট নেই। এটা যে কোনো কাগজ-ই প্রকাশ করতে পারতো। বাংলাদেশের আর কোনো কাগজ এ কাজটুকু করেনি। কেউই হয়ত চায় নি, এ নিয়ে ঘাঁটাঘাটি করে যুদ্ধাপরাধী বিচারের ইস্যুটাকে নেতিবাচক করে তুলতে। কিন্তু সরকারই মূলত বলটা তুলে দিলো  ‘আমার দেশ’-এর হাতে। তাদের ক্রেডিট দিয়ে দিলো সম্পাদককে স্বেচ্ছায় অবরুদ্ধ থাকার সুযোগ করে দিয়ে কিংবা সাংবাদিককে পালিয়ে বেড়ানোর পথ করে দিয়ে। খুব স্বাভাবিকভাবেই এই ইস্যুতে সাংবাদিক সমাজের একটা অংশ এই পালিয়ে বেড়ানো সাংবাদিকের পক্ষে দাঁড়াতেই পারে। এ নিয়ে অযথা সরকার কেন-ই বা ঐ অপশক্তিকে একটা ইস্যু তৈরির পথ করে দিচ্ছে ?

[email protected]
সম্পাদনা: জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিট

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।