ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

শাহবাগ চত্বর: দ্য স্পিরিট অব ৭১

নজরুল মিন্টো | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭৩৯ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ৯, ২০১৩
শাহবাগ চত্বর: দ্য স্পিরিট অব ৭১

শিরোনামটি সিএনএন থেকে ধার নেয়া। ১০টি বিশাল আকৃতির ছবিসহ বৃহস্পতিবার
বিশ্বের অন্যতম গণমাধ্যম সিএনএন অনলাইনের শিরোনাম ছিলো- `দ্য স্পিরিট
অব ’৭১ রাইজেস অ্যাট শাহবাগ স্কোয়ার ইন ঢাকা।

` কেবল সিএনএন-ই নয়; গত
কয়েকদিন ধরে বিবিসিসহ সারাবিশ্বের মিডিয়ার শিরোনামে ছিল বাংলাদেশ।
প্রতে্যকটি মিডিয়ায় উল্লেখ করা হয়েছে শাহবাগের এ জাগরণের কথা যার নেতৃত্ব
দিচ্ছে বাংলার তরুণ সমাজ, যারা ব্লগ এবং ফেসবুকসহ বিভিন্ন অনলাইন
সোশ্যাল মিডিয়ার সাথে সম্পৃক্ত (মোট সংখ্যা প্রায় ৩৩ লক্ষ)। ইরান,
সিরিয়া, কিংবা আফগানিস্তান নয়, সারা বিশ্বের দৃষ্টি এখন বাংলাদেশের দিকে।

সিটিজেন জার্নালিজমের অন্যতম প্লাটফর্ম এই ব্লগ। নতুনত্বের প্রতি আমার
আজন্ম টান। বিশেষ করে প্রযুক্তি বিশ্বে নতুন কিছু দেখলেই ঝাঁপিয়ে পড়ি।
এভাবেই আজ থেকে বছর চারেক আগে আমি ব্লগার্স-এর পাতায় নাম লিখিয়েছিলাম।
প্রথম সারির যে কয়টি ব্লগ আছে সবকটিতেই আমার অ্যাকাউন্ট আছে। লেখা আছে।
শুরুতে খুবই অ্যাকটিভ ছিলাম পরবর্তী সময়ে কিছু কিছু ব্লগারের আচরণ, এবং
তাদের রচনা দেখে আমি ব্লগিং থেকে দূরে সরে যাই। তবে এতদিনে ঢুঁ মারার যে
অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল তা বদলাতে পারি নি। বিভিন্ন তথে্যর খোঁজে প্রায়ই ব্লগে
যাই। অনেকের লেখা পড়ি। এভাবেই চলছিল।

 ইন্টারেকটিভ ডিজিটাল মিডিয়ার ছাত্র (১০-১২টা সোশ্যাল মিডিয়াতে ঘোরাঘুরি যার নিত্যদিনের কাজ) হয়েও স্বীকার
করতে দ্বিধা নেই, এই ব্লগ আর ফেসবুক যে কোনো একদিন বাঙালির চেতনায় এভাবে
নাড়া দেবে, ব্লগাররা কোনোদিন বাংলাদেশে আন্দোলনের নেতৃত্ব দেবেন চিন্তা
করি নি কখনও। আজ আমি গর্বের সঙ্গে বলতে চাই, আমিও একজন ব্লগার।

৫২, ৬৯, ৭১ এবং ৯০ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন আন্দোলনের ইতিহাসে দেখা যায় সেসব
আন্দোলনে ছিলেন ছাত্র-শিক্ষক, রাজনীতিবিদ এবং বিভিন্ন পেশাজীবীর মানুষ।
আরও ছিলেন বাংলার লেখক সমাজ, শিল্পী সমাজ তথা সাংস্কৃতিক কর্মীগণ। আজ
২০১৩ সালের আন্দোলনের সাথে যুক্ত হলো নতুন একটি নাম- `ব্লগার্স`। এ
আন্দোলনের ডাক দিয়েছেন তারা। তাদের আহবানে সাড়া দিয়েছে দেশের সকল শ্রেণি-পেশার মানুষ। এতোদিন যেন একটি ডাকের অপেক্ষায়ই ছিল বাংলার মানুষ।
তাদের প্রতি একাত্মতা ঘোষণা করে আজ জেলায় জেলায় তৈরি হয়েছে আন্দোলনের
মঞ্চ। সে মঞ্চকে ঘিরে রয়েছে এখন সর্বস্তরের মানুষ। ধ্বনিত হচ্ছে
`রাজাকারদের ফাঁসি চাই, ফাঁসি চাই` `একাত্তরের হাতিয়ার, গর্জে উঠুক
আরেকবার`। রাত-দিন এক করে একটানা প্রতিবাদ। এ এক অভিনব আন্দোলন! এ এক
অন্য রকম আয়োজন। এক অন্য রকম অনুভূতি। বাংলার মানুষ এ ধরনের আন্দোলন
কখনও দেখে নি। এ এক নতুন অভিজ্ঞতা!

আন্দোলনের সংবাদে উদ্বেলিত প্রবাসীরা। প্রজন্ম চত্বরের জয়ধ্বনি
আটলান্টিকের এ পারে বসে শোনা যাচ্ছে । এরই মধ্যে প্রবাসের তরুণ প্রজন্ম এ
আন্দোলনের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে বিভিন্ন শহরে আয়োজন করছে মানববন্ধন
ও প্রতিবাদ সভার। ফেসবুক, টুইটার, গুগল প্লাস, ব্লগে ব্লগে চলছে অসংখ্য
বার্তার গুনগুনানি। মুহুর্তের মধে্য খবর পৌঁছে যাচ্ছে অস্ট্রেলিয়া থেকে
কানাডা। প্যারিস থেকে টোকিও। বাঙালি আবার লড়াই করতে নেমেছে। এ লড়াই আজ
বাঙালির অস্তিত্বের লড়াই। এ লড়াই জিততে হবে। এ আন্দোলনে সরকারের
কর্তৃত্ব নেই, বিরোধী দলের কর্তৃত্ব নেই, সেনাবাহিনীর কর্তৃত্ব নেই,
কোনো বিশেষ দেশের কর্তৃত্ব নেই, জাতিসংঘের কর্তৃত্ব নেই। এ আন্দোলনের
কর্তৃত্ব কেবল বাংলার তরুণ সমাজের হাতে। এ তরুণরা বাংলার ব্লগার্স। আজ
মুক্তিযোদ্ধা ও ব্লগার্স সমার্থক শব্দ।

প্রজন্ম চত্ত্বরে উপস্থিত হয়ে এ আন্দোলনে অংশ নিতে না পারাটা জীবনের
একটা ব্যর্থতা বলে মনে হচ্ছিল। বিভিন্ন চ্যনেলের মাধ্যমে দেখতে পাচ্ছি
মানুষের আবেগ এবং উচ্ছ্বাস। কত মানুষ কতভাবে নিজেকে এ আন্দোলনে সম্পৃক্ত
করছে। আমরা যারা প্রবাসে রয়েছি আমার কেন পারবো না তাহলে? আমি আহবান
জানাচ্ছি, সকল প্রবাসী ভাইবোনদের প্রতি, আসুন, আমরা যে যেখানে আছি আমাদের
পরিবার-পরিজনদের বলি তারা যেন এ আন্দোলনে অংশ নেন। শাহবাগ চত্বরে গিয়ে যে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করতে হবে এমন কোনো কথা নেই। আমরা যদি আন্দোলনকারীদের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করি তাহলে তাদের আহবান অনুযায়ী
আমরা এবং আমাদের পরিবারের সদস্যরা স্বাধীনতা বিরোধীদের কোন
প্রতিষ্ঠানের সাথে সম্পর্ক রাখবো না। আমরা সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে
সমর্থন দিয়ে আন্দোলনকারীদের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করবো। আমরা আমাদের
সন্তানদের টেলিভিশনের মাধ্যমে, অনলাইনের মাধ্যমে নবজাগরণের এ দৃশ্য
দেখিয়ে তাদের চেতনায় মুক্তিযুদ্ধের বীজ বপন করে দেবো।

এ আন্দোলনে যারা নিজেদের সম্পৃক্ত করতে পারবেন না তারা আক্ষেপ করবেন
একদিন। যেমনটি মুক্তিযুদ্ধের মতো গৌরবময় অধ্যায়ে নিজেকে সম্পৃক্ত করতে
পারেন নি বলে অনেকে আজ আক্ষেপ করে থাকেন। এ ধরনের গৌরবময় সুযোগ কদাচিৎ
আসে। আমি আহবান জানাচ্ছি, দেশের সকল কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও
সাংস্কৃতিক কর্মীদের, আপনারা এ আন্দোলনের যোগ দিন। যাদের আত্মত্যাগের
বিনিময়ে একটি স্বাধীন দেশে বসে আপনি শিল্পের চর্চা করছেন তাদের প্রতি
শ্রদ্ধা জানাতে এ আন্দোলনের সাথে আপনাদের একাত্মতা জানানো উচিত। আপনারা
মুক্তিযুদ্ধবিরোধী কোনো মিডিয়ায় লিখবেন না, কোনো সাক্ষাৎকার দেবেন না।
কোনো পণে্যর প্রচারণায় সহযোগিতা করবেন না। জীবনে অর্থই সব নয়; বিবেক
দিয়ে পরিচালিত হোন।

রাজাকারদের সাথে তাদের সন্তানেরাও টাকা পয়সা দিয়ে এ আন্দোলনকে বানচাল
করার জন্য বিভিন্ন অপচেষ্টা চালাচ্ছে বলে খবরে প্রকাশ। এদের কাছ থেকে
হুঁশিয়ার থাকতে হবে। মনে রাখবেন, সুযোগ পেলেই এরা ছোবল দেবে।

জানা গেছে, এরা বিভিন্ন মুখোশের অন্তরালে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের ব্যক্তি সেজে
বিভিন্ন জায়গায় বক্তব্য দিয়ে বেড়াচ্ছে। প্রতে্যকটা রাজাকারের সন্তান
একেকটা কৌশল অবলম্বন করে চলে। অনেকে বলেন পিতার দায়ভার পুত্র কেন নেবে?
আমি মনে করি এ দায়ভার তাদের নিতেই হবে। এটাই স্বাভাবিক, এটাই দুনিয়ার
রীতি। একবার আমার সাথে মীর জাফর আলী খানের ৪র্থ/৫ম বংশধরের একজনের দেখা
হয়েছিল। সে বলেছিল তারা তাদের পূর্বপুরুষের পরিচয় দিতে সংকোচ বোধ করে।
আমি মনে করি, পূর্ব পুরুষের ঘৃণ্য কর্মের জন্য রাজাকারের সন্তানদেরও
সংকোচ দেখানো উচিত। লজ্জায় মুখ লুকিয়ে রাখা উচিত। এটাই তাদের প্রাপ্য।
এটা তাদের শাস্তি।

 অন্যদিকে পূর্ব পুরুষের কৃতকর্মের জন্য একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান গর্বিত হয়ে বুক উঁচু করে কথা বলবে। এটা তার অর্জন। রাজাকারের সন্তানেরা বিভিন্ন সভা-সমাবেশে, গোলটেবিল বৈঠকে, টেলিভিশনের টক শোতে জাতিকে জ্ঞান দেবে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলে বেড়াবে- আমি মেনে নিতে পারি না।

আজ শাহবাগের প্রজন্ম চত্বরের আন্দোলন কেবল রাজাকারদের ফাঁসির মধে্য আর সীমাবদ্ধ
নেই। এ আন্দোলনের মধে্য আমার মতো অনেকে স্বপ্ন দেখছেন এক নতুন জাগরণের,
এক যুগান্তকারী পরিবর্তনের। এ পরিবর্তন কেবল রাজনীতিতেই সীমাবদ্ধ থাকবে
না, এ পরিবর্তন আমাদের চিন্তা চেতনা ও সমাজ ব্যবস্থাতেও ব্যাপক প্রভাব
বিস্তার করবে। এ জয় সুনিশ্চিত।

নজরুল মিন্টো : ব্লগার, সাংবাদিক, লেখক
প্রধান সম্পাদক - দেশে বিদেশে, কানাডা
www.deshebideshe.com;জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।