ঢাকা, রবিবার, ২০ আশ্বিন ১৪৩১, ০৬ অক্টোবর ২০২৪, ০২ রবিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

সাগর-রুনি আমাদের অসহায়ত্বের প্রতীক হয়ে থাকবে

মাকছুদুল আলম খন্দকার খোরশেদ, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১৪২ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১১, ২০১৩
সাগর-রুনি আমাদের অসহায়ত্বের প্রতীক হয়ে থাকবে

সোমবার সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের বর্ষপূর্তি। এক বছর আগে এইদিনে সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি খুন হয়েছিলেন নিজেদের শয়নকক্ষে।

গত এক বছরে মামলার সমাধান তো দূরের কথা খুনের ক্লু পর্যনÍ নির্ণয় করতে পারে নি দেশের কোনো আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী। সাগর-রুনি খুনের বিচার প্রসঙ্গে সাগরের মা সালেহা মনির সরকারের কাছে জানতে চেয়েছেন ২৪ ঘন্টা-৪৮ ঘণ্টা, সাল, বছর না কত যুগ লাগবে?

সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের প্রায় সপ্তাহ দুয়েক পরে সাগর-রুনির একমাত্র সন্তান মেঘের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে আমার একটি লেখা একটি জাতীয় গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছিল, যার শিরোনাম ছিল “মেঘের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা’। মেঘের কাছে ক্ষমা চেয়েছিলাম তার পিতা-মাতার হত্যাকাণ্ডের রহস্য উন্মোচনে সরকারের ব্যর্থতার জন্য। মেঘের কাছে ক্ষমা চেয়েছিলাম আমাদের পুরাতন স্বরাষ্টমন্ত্রীর ৪৮ ঘন্টা, ৭ দিনের মাথায় মামলার মনিটরিং দায়িত্ব প্রধানমন্ত্রী কাঁধে নেয়া, চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ড হওয়া সত্ত্বেও মরদেহের ভিসেরা না করা, গ্রিল কাটা তত্ত্ব এবং সব মিলিয়ে সরকারের লুকোচুরির জন্য। আরো ক্ষমা চেয়েছিলাম চলমান জীবনে নতুন কোনো ইস্যু সামনে এলে মেঘকে ভুলে যাব বলে।

সম্প্রতি একটি অনলাইন নিউজ পোর্টালের খবরে চোখ ও মাউসের কারসার এক জায়গায় এসে আটকে গেল। শিরোনামটি হলো “মেঘের দায়িত্ব নিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী, কোনো খোঁজ নেয়া হয়নি”। আমার মনে পড়ে যায় ১২ মাস আগের লেখার কথা। আসলেই তো ভুলেই গেছি আমরা সবাই। খবরের ভিতরে গিয়ে জানতে পারি সাগর-রুনির মৃত্যুর পরে সাগর-রুনির মা, ভাই ও মেঘ ১৩ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রীর আমন্ত্রণে গণভবনে তার সাথে সাক্ষাৎ করেন। এ সময় প্রধানমন্ত্রী সাংবাদিক সম্পতির পরিবার,বিশেষ করে মেঘকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন:“আমি জানি স্বজন হারানার কি বেদনা। আমিও মেঘের মত বাবা-মাসহ পুরো পরিবার হারিয়েছি। ”
প্রধানমন্ত্রী আরো বলেন, ”মেঘের উন্নত জীবন গড়তে যা যা দরবার হবে-তিনি তা করবেন। ” মেঘের পরিবার থেকে শুরু করে দেশবাসী কষ্টের পাহাড় বুকে নিয়েও সান্ত্বনা পেয়েছিল শিশুটির ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়েছে মনে করে। খবরে আরো বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতির পরেও প্রধানমন্ত্রী কিংবা তার কার্যালয়ের কোনো কর্মকর্তা একদিনের জন্য ফোন করেও মেঘের কোনো খরব নেয় নি। রুনির মা আক্ষেপ করে বলেছেন, “প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে কত কর্মকর্তা একজনও তো এলো না”।

খবরটি পড়ে মন খারাপ হয়ে যায়। রাজনীতিকরা দেশবাসীর সাথে ওয়াদা করে ভুলে যান, এটি অনেক দিনের পুরনো অভ্যাস। কিন্তু একজন অবুঝ শিশুকে দেয়া ওয়াদা পূরণে প্রধানমন্ত্রীর এই ব্যর্থতা দেশবাসী ভালোভাবে নেবে কিনা সন্দেহ! প্রধানমন্ত্রী তার নিজের পরিবারের সদস্যদের নির্মম হত্যাকাণ্ডের কথা, স্বজন হারানোর বেদনার কথা বলে মেঘ ও তার পরিবারকে সান্ত্বনা দিলেও তার রাজনৈতিক হৃদয় মেঘের বাবা-মা হারানোকে স্পর্শ করতে পারে নি। যদি পারতো তবে অবুঝ ও অসহায় মেঘকে দেয়া ওয়াদা তিনি পূরণ করতেন।

দেশের প্রধানমন্ত্রী ওয়াদা ভংগ করলে আমাদের মত আম জনতার কি করার আছে! তারপরেও অবুঝ মেঘের কাছে দ্বিতীয় বারের মত ক্ষমতা প্রার্থনা করছি। সেই ক্ষেত্রে সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের পরে পুরাতন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুনের ৪৮ ঘন্টা, আইজিপির উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর মনিটরিং এত কিছুর পরেও মহামান্য উচ্চ আদালত পুলিশের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতিকে বোগাস ও শূন্য বলে অভিহিত করেছেন। পুলিশের কাজের সমালোচনা করে মহামান্য উচ্চ আদালত র‌্যাবকে তদন্তের দায়িত্বভার দেন। র‌্যাব দায়িত্ব পেয়ে পুনঃ ময়না তদন্তের জন্য কবর থেকে গত বছরের মে মাসে লাশ উত্তোলন করে ভিসেরা ও ডিএনএ পরীক্ষার জন্য নমুনা আমেরিকায় পাঠায়। দেশের মানুষ র‌্যাবের দায়িত্ব নেয়াটাকে আশার আলো মনে করেছিল। কিন্তু ডিএনএ ও র‌্যাবের ৬ মাসের তদন্ত ফল দেখেও আবার নিরাশ হয় সাগর-রুনির পরিবার ও দেশবাসী।

গত চার মাস আগে দায়িত্ব নেয়া নতুন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ম খা আলমগীর দায়িত্ব নিয়েই হত্যাকারীদের সনাক্ত ও রহস্য উন্মোচন করার জন্য ১০ দিনের প্যাকেজ ঘোষণা করেন। ঘোষণার ৮  দিন পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ঘোষণা দেন হত্যাকারীদের সনাক্ত ও গ্রেফতার করা গেছে। মহাখালীতে ডাঃ নিতাইকে হত্যাকারী গ্রিলকাটা চোরের দলই সাগর-রুনিকে হত্যা করেছে। কিন্তু এরপরে মন্ত্রী মহোদয় কিংবা তদন্তকারী দল কেউই আর মুখ খুলে কিছু জানাল না। গ্রেফতারকৃতরা সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ড প্রসঙ্গে স্বীকারোক্তি কিংবা কোনো তথ্য দিয়েছে কি? স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নাটকীয় ঘোষণা ও ফলাফল হিসাবে ‘অশ্বডিম্ব প্রাপ্তি’--এসবকিছুকেই ফালতু বলে মনে করেন সচেতন মানুষ। সবার ধারণা, সরকারই কেন জানি সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের রহস্য উন্মোচন থেকে সরে যাচ্ছে। মামলার বাদী রুনির ভাই জানিয়েছেন, গত তিন মাসে তদন্ত কর্মকর্তা তাদের সাথে কোনো যোগাযোগই করেন নি। এর অর্থ কি? নিশ্চয়ই তদন্ত কর্মকতা অন্য কোনো মামলা তদন্তে ব্যস্ত রয়েছেন এবং সাগর-রুনির মামলার ফাইলে ধুলোর স্তর যথারীতি মোটা হচ্ছে। গত একমাস আগে মেঘের নিরাপত্তার জন্য নিয়োজিত পুলিশ ও প্রত্যাহার করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী তো মেঘের উন্নত জীবন কিংবা তার পিতা-মাতা হত্যাকাণ্ডের বিচারের ব্যবস্থাই করলেন না, উল্টো হত্যাকাণ্ডের একমাত্র চাক্ষুস সাক্ষী মেঘের নিরাপত্তা বেষ্টনী পর্যন্ত তুলে নিলেন। তাহলে তো ধরেই নেয়া যার সরকার সাগর-রুনির হত্যাকাণ্ড ও মেঘের কষ্টের জীবন ভুলে গেছে।

সাগর-রুনির হত্যা রহস্য উন্মোচনের কথা বলে প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে মন্ত্রীরা পর্যন্ত মুখে ফেনা তুললেও সদিচ্ছার কোনো লক্ষণ নেই। হত্যাকাণ্ডের প্রায় এক বছর হলেও কোন ক্লুই পাওয়া না যাওয়ায় রহস্যের সৃষ্টি হয়েছে। অনেকেই প্রশ্ন করছেন, তাহলে সাগর-রুনিকে কি ভিনগ্রহের প্রাণীরা (এলিয়েনরা) এসে হত্যা করে আবার ভিনগ্রহে ফিরে গেছে? তা না হলে আসামি না হয় ধরা গেল না, সরকার এই হত্যাকান্ডের টিকিটিও ছুঁতে পারছে না কেন? নাকি সরকারের ঘনিষ্ঠ কেউ এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত বলেই অন্যানা হাজারো মামলার মতো করুন পরিণতির জন্যেই পরিকল্পিতভাবে সময় ক্ষেপণ করা হচ্ছে ভুলে যাওয়ার জন্য।

খুনের সময় সাগর-রুনির সেল ফোন ও সাগরের ব্যবহৃত ল্যাপটপটি খুনিরা নিয়ে যায় এবং হত্যাকাণ্ডের দিন দুয়েক পর সাগর সম্পাদিত এনার্জি বিষয়ক অনলাইন পোর্টাল থেকে সব তথ্য মুছে দেয় একটি চক্র। কিন্তু কোনো তদন্তকারী দলই এ পর্যন্ত সেলফোন দুটি ট্র্যাক করার কিংবা কারা কিভাবে অনলাইন পোর্টালটি মুছে দিল তা জানার চেষ্টা করেন নি। বর্তমানে আইটি বিশেষজ্ঞরা চাইলেই জানতে পারতেন কোন আইপি থেকে সাগরের ওয়েব সাইটটি মুছে দেয়া হয়েছে। আর এভাবেই সম্ভব হতো খুনিদের শনাক্ত করা। তাছাড়া সাগর-রুনি হত্যাকান্ডের পরে তাদের ভিসেরা পর্যন্ত পরীক্ষা করে নি পুলিশ। অথচ মফস্বলের খুনের পর্যন্ত পোস্ট মোর্টমের পরেই ভিসেরা পরীক্ষার জন্য শরীরে বিশেষ অঙ্গ প্রতঙ্গ মহাখালীতে ভিসেরা রিপোর্টের জন্য পাঠায়। তবে সাগর-রুনির মত চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ডের পরেও কেন পুলিশ ভিসেরা পরীক্ষা করলো না? তবে কি বলা যায় না সাগর-রুনিকে যারা হত্যা করেছে ও করিয়েছে তারা প্রথম দিন থেকেই তদন্তের গতি হাতে নিয়ে নিয়েছে? কিংবা মামলা তদন্তের অবহেলা ও দুর্বলতার জন্য কোনো কাউকে শো-কজ বা শাস্তি দেওয়া হয়েছে, এমনটিও তো শোনা যায় নি। মহামান্য আদালত নিজে উদ্যোগী হয়ে মামলার খোঁজ খবর না নিলে তো এখনও পর্যন্ত পুলিশ-ডিবিই তদন্তের নামে ভেলকিবাজি দেখাতো।

 তবে তো ধরেই নেয়া যায় সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের রহস্য উন্মোচনে সরকার আন্তরিক নন। আন্তরিক হলে এত গোজামিল কিংবা লুকোচুরি থাকতো না। আর সরকার প্রধান কর্তৃক ঘোষিত মেঘের সুযোগ-সুবিধার দেখভাল না করে উল্টো মেঘের নিরাপত্তায় নিয়োজিত পুলিশ তুলে নেয়াই কি প্রমাণ করে না আন্তরিকতার সংজ্ঞা কি?
সরকারপ্রধান থেকে শুরু করে আমরা পর্যন্ত সবাই সাগর-রুনি ও মেঘকে ভুলে গেলেও ভুলে যায়নি সাংবাদিক সমাজ। এদেশের সকল কিছু যেমন দুই ধারায় বিভক্ত, তেমনি সাংবাদিক সমাজও বিভক্ত ছিল এতদিন। এক পক্ষ ভালো বললে আরেক পক্ষ অবশ্যই তাকে খারাপ বলবে। এতদিন এভাবেই চলে আসছিল। কিন্তু সাগর রুনির হত্যাকান্ড সাংবাদিক সমাজকে কঠিন বাস্তবতার সম্মুখীন করে এক শক্ত ভিতের উপর দাঁড় করিয়েছে। সাংবাদিক সমাজের নেতৃত্বদানকারী ইকবাল সোবহান চৌধুরী,রুহুল আমিন গাজী কিংবা আবদাল আহম্মেদের এক কাতারে দাঁড়ানোকে আমি অবনত মস্তকে সম্মান করি, স্যালুট তাদের। তারা যদি বিচারের দবিঁতে কর্মসূচি চালু না রাখতেন তবে এতদিনে সাগর-রুনির মামলার ফাইনাল রির্পোট হয়ে যেত।

কিছুদিন পরপর সাংবাদিকদের কর্মসূচিতেই এখনও বেঁচে আছে সাগর-রুনি। নইলে ইস্যু প্রীতির কল্যাণে চলমান জীবনের ব্যস্ততা, তত্ত্বাবধায়ক সরকার, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, হলমার্ক কেলেংকারি, স্কাইপি বিতর্ক আর দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতিতে নাকাল নাগরিক জীবনে সাগর-রুনি কিংবা মেঘকে ভুলে যেতাম আমরা সবাই। তাই ধন্যবাদ সাংবাদিক সমাজের একতা’কে।
 
সাগর-রুনির প্রতি সীমাহীন অবহেলা আর লুকোচুরি, মেঘকে দেয়া প্রধানমন্ত্রীর ওয়াদা খেলাপ, মেঘের নিরাপত্তার নিয়োজিত পুলিশ প্রত্যাহার করায় মেঘের কাছে আবারো ক্ষমা চাই। মেঘ, তুমি হয়তো বড় হয়ে যখন বুঝতে পারবে তোমার বাবা-মায়ের হত্যাকারীদের খুঁজে বের করতে লুকোচুরি হয়েছে, তোমাকে দেয়া ওয়াদা স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী ভঙ্গ করেছেন, তখন যেন ভয়ে শিউরে না ওঠো তুমি--কোন দেশে তুমি বেড়ে উঠেছো একথা ভেবে? তোমার যেন মনে হয় সরকার তোমার সাথে প্রতারণা করলেও দেশবাসী তোমার সাথে ছিল, তোমার পিতা-মাতার সহকর্মীরা তোমার সাথে ছিল। তাই দ্বিতীয় বারের মত তোমার কাছে আমাদের ক্ষমা প্রার্থনা। সাগর-রুনি তোমরা বেঁচে থাকবে আমাদের অসহায়তে¦র প্রতীক হয়ে, তোমরা বেঁচে থাকবে সরকারের লুকোচুরি খেলার প্রতিবাদ হয়ে, সাগর-রুনি তোমরাই প্রমাণ করবে বাংলাদেশ সব সম্ভবের দেশ!

লেখক
মাকছুদুল আলম খন্দকার খোরশেদ
১৩নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর, নাসিক
আহবায়ক-নারায়ণগঞ্জ মহানগর যুবদল

বাংলাদেশ সময়: ১১৩২ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১১, ২০১৩

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।