ঢাকা, শনিবার, ১৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

আনপ্রেডিক্টেবল হিরো

জিনিয়া জাহিদ, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯০৯ ঘণ্টা, মার্চ ২৮, ২০১৩
আনপ্রেডিক্টেবল হিরো

রাজনীতিতে নাকি শেষ কথা বলে কোনো কথা নেই। নিজেদের বানানো এই সুবিধাবাদী থিওরির উপর ভর করে প্রায় সময়ই রাজনীতিবিদরা আজ যে কথা বলেন আগামীকাল তা পুরোপুরি ভুলে গিয়ে দাঁত কেলিয়ে সম্পূর্ণ বিপরীত কিছু করে আমাদের উপহার দেন।



প্রথম দিকে তাদের এই স্বঘোষিত থিওরির প্রয়োগে আমরা চমকে উঠতাম, ব্যথিত হতাম, হতাশ হতাম, রেগেও যেতাম। কিন্তু আমরা জনগণ কষ্টকর জীবনে রাজনীতিবিদদের এ থিওরি এখন নির্মল বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছি।
 
আমরা পয়সা দিয়ে টিকেট কিনে নাটক দেখার মতোই, রাজনীতিবিদদের নাটক দেখি। ওনারা যখন নিজেদের বানানো ডায়লগ নিজেরা ইচ্ছেকৃতভাবে ভুলে গিয়ে অন্য ডায়লগ দেন, তখন আমরা তৃতীয় সারির দর্শক সিটি বাজিয়ে হাততালি দেই। মনে মনে বলি, পয়সা উসুল।
 
ঠিক তেমনি দু’দিন আগে বাংলাদেশের রাজনীতির সবচেয়ে বড় আনপ্রেডিক্টেবল হিরোর অভিনয় দেখে আমাদের জনগণের পয়সা প্রায় উসুল হয়ে গেছে বলেই মনে হচ্ছে।

হ্যাঁ পাঠক, আমি ওয়ান অ্যান্ড অনলি হুসাইন মুহাম্মদ এরশাদের কথাই বলছি। তিনি ছাড়া এ দেশে এমন কেউ কি আছেন যার কাজে ও কথায় বিন্দুমাত্র মিল খুঁজে পাওয়া যায় না? তাকে টেক্কা দেওয়ার জন্য অবশ্য অতি অল্প কিছু স্যুট পড়া মিহিগলার রাজনীতিবিদ পেলেও পাওয়া যেতে পারে!!

রাজনীতির মঞ্চে ওয়ান অ্যান্ড অনলি এই আনপ্রেডিক্টেবল হিরোর সাম্প্রতিককালে ধারন করা অসাধারণ অ্যাকটিং নিয়ে আলোচনা করাই আমার আজকের লেখার উদ্দেশ্য।
 
গত ২৫ মার্চ জাতীয় পার্টি প্রধান হুসাইন মুহাম্মদ এরশাদ তার দলের এক আলোচনাসভায় মহাজোট ছাড়ার কথা চিন্তা করে দলীয় কর্মীদের পরবর্তী সিদ্ধান্তের জন্য  অপেক্ষা করতে বলেছিলেন। অথচ ঠিক পরদিন জিল্লুর রহমান (মিরপুর-বনানী) ফ্লাইওভার উদ্বোধন অনুষ্ঠানে তিনি সে কথা সম্পূর্ণ ভুলে গিয়ে মহাজোট প্রধান শেখ হাসিনা সরকারের পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দেন।
 
এখন যদি তিনি নির্বাচনের আগে প্রধানমন্ত্রীকে দেওয়া তার প্রতিশ্রুতি ভেঙে তা সম্পূর্ণ ভুলে অন্য কাউকে অন্য প্রতিশ্রুতি দেন, আর সেই বিখ্যাত ডায়ালগের মতো বলেন, “প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয় প্রতিশ্রুতি ভাঙার জন্য”, তাহলে কিন্তু আমরা প্রতিশ্রুতি ভাঙার দায় তাকে মোটেও দিতে পারি না। পারি কি?   
   
অবশ্য প্রতিশ্রুতি ভাঙার দায় একা এরশাদকে দেয়াও হয়তো ঠিক হচ্ছে না। জাতীয় পার্টির দাবি যে, গত নির্বাচনের আগে মহাজোটের পক্ষ থেকে এরশাদকে বেশ ক’টি প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। যার মধ্যে তাকে প্রেসিডেন্ট করা অথবা মধ্যপ্রাচ্যে প্রধানমন্ত্রীর মর্যাদায় বিশেষ দূত নিয়োগ করা এবং তার বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা প্রত্যাহার অন্যতম। বলাবাহুল্য জাতীয়পার্টির বহুল চর্চিত এসব প্রতিশ্রুতির একটাও এখন পর্যন্ত বাস্তবায়িত হয়নি।

কাজেই রাজনীতির মঞ্চে যদি এখন তিনি অভিমানী নায়কের মতো মহাজোট ছেড়ে অন্য কারো সঙ্গে জুটি বেঁধে ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্ন দেখেন তবে কি তাকে আমরা খুব দোষ দিতে পারি? পারতাম না, যদি না তিনি তার সিদ্ধান্তে অটল থাকতেন। সমস্যা হলো তিনি দিনরাত শুধুই প্রেসিডেন্ট হওয়ার স্বপ্ন দেখেন। আর এ জন্য বাকি সব কিছুই তার কাছে তুচ্ছ।

শাহবাগের গণমঞ্চ নিয়ে এরশাদের ইউটার্নে অবশ্য আমরা মোটেও অবাক হইনি। আমরা জানি এরশাদ যা বলেন ঠিক তার উল্টা করেন। তিনি যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে একাত্ম হবেন না, সে বিষয়ে কারও মনেই বিন্দুমাত্র সংশয় ছিল না। যেহেতু তিনি মিডিয়ায় সব সময় বিভিন্ন ধরনের কথা বলে তার উপস্থিতির প্রমাণ দিতে ব্যস্ত থাকেন, সেহেতু শাহবাগের গণমঞ্চ নিয়েও তিনি বরাবরের স্বভাবুনাযায়ী আজ এক কথা কাল আরেক কথা বলে রাজনীতির কালজয়ী সেই থিওরিকেই তার চেতনায় লালন করে যাচ্ছেন।  

দেশের গণতন্ত্রকে গলা টিপে হত্যা করে যখন সেই হত্যাকারী প্রথম আলোর মতো দৈনিকে বলেন, “জাতীয় পার্টি ছাড়া গণতন্ত্র বাঁচবে না” তখন আমরা তার এই কৌতুকে নির্মল আনন্দ উপভোগ করি।
 
রাজনীতির মঞ্চে সদ্য ৮৪তে পা দেওয়া এই সিনিয়র রাজনীতিবিদ যখন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জয়ী হয়ে আগামী পাঁচ বছরের জন্য রাষ্ট্রপতি-শাসিত সরকারব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতি হয়ে ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্ন দেখেন, তখন তারুণ্যদীপ্ত আমাদের তরুণদের তারুণ্যের জন্য তা নিতান্তই লজ্জাকর বিষয় হয়ে ওঠে বটে। তিনি ওয়ান অ্যান্ড অনলি এরশাদ বলেই হয়তো তার পক্ষেই এখনো এই বয়সে এই স্বপ্ন দেখা সম্ভব!!
 
সকাল-বিকাল সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করার জন্য যদি গিনেস বুকে কোনো স্বীকৃতি দেওয়ার প্রচলন থেকে থাকে, তবে জনাব এরশাদ কিন্তু তার এই দীর্ঘ রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে ‘দ্রুত সিদ্ধান্ত বদল’ শিরোনামে বিশ্ব রেকর্ড করতেন সে বিষয়ে আমরা নিশ্চিত।
 
রাজনীতির রঙ্গমঞ্চে আমরা জনগণ খুব শীঘ্রই সামনে আরো অনেক কিছু দেখতে পারব। তবে সদ্য খালি হওয়া প্রেসিডেন্ট পদটি যে এই আনপ্রেডিক্টেবল হিরোকে মহাজোটে আবার ফিরিয়ে এনেছে তা আমরা জানি। কোনো কারণে তিনি যদি সে পদ পেতে ব্যর্থ হন, তবে আনপ্রেডিক্টেবল হিরোকে দিয়ে সামনে আর কি কি হতে পারে তা কিন্তু আমরা জনগণ খুব সহজেই এখন প্রেডিক্ট করতে পারি।

জিনিয়া জাহিদ: বাংলাদেশের স্বনামধন্য একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। নরওয়ে থেকে "ডেভলপমেন্ট zinia-zahid-অ্যান্ড রিসোর্স ইকনমিক্স" এ এমএস শেষ করে বর্তমানে তিনি অস্ট্রেলিয়াতে পিএইচডি করছেন। সেখানে তিনি বাংলাদেশের "খাদ্যনীতি"নিয়ে গবেষণার পাশাপাশি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে নিয়োজিত আছেন।

বাংলাদেশ সময়: ০৮৪৯ ঘণ্টা, মার্চ ২৮, ২০১৩

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।