ঢাকা, শনিবার, ১৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

মাহমুদুর রহমান গ্রেফতার: অতপর...

জিনিয়া জাহিদ, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫১৩ ঘণ্টা, এপ্রিল ১১, ২০১৩
মাহমুদুর রহমান গ্রেফতার: অতপর...

বেশ কিছুদিন ধরে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের বিলুপ্তপ্রায় মেরুদণ্ডটির অস্তিত্ব আমরা অনুভব করছি। সম্প্রতি আওয়ামী লীগের প্রধান ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক বিবিসিকে দেয়া সাক্ষাতকারে ব্লাসফেমি আইনের প্রয়োজনহীনতার প্রতি সরকারের সুস্পষ্টতা এবং হেফাজতে ইসলামের দাবিদাওয়াকে শক্তভাবে মোকাবেলা করার কথা আমাদের জনগণের মাঝে দলটির মেরুদণ্ড যে কিঞ্চিত বিদ্যমান আছে তার প্রমাণ দিয়েছিল।


 
সেই সাথে দলের নেতারা যাদের বাকশক্তি প্রায় বিলুপ্ত হয়েছিল, তাদের মধ্যে মতিয়া চৌধুরী, দিপু মনি ও হানিফের নারীনীতির স্বপক্ষের হুঙ্কারও আমাদের আশান্বিত করেছে এইভেবে যে ওনারা জনগণের স্বপক্ষে তাদের হারানো কণ্ঠস্বর ফিরে পেয়েছেন!!
 
তবে সরকার এবার তার মেরুদণ্ডের উপস্থিতির চূড়ান্ত প্রমাণ তুলে ধরল "আমার দেশ" পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতার করে।
 
এ কথা ঠিক যে, বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের লাগাতার গ্রেফতার করে কারাগারে বসিয়ে রেখে আওয়ামিলীগ অলরেডি বিরোধীপক্ষের মেরুদণ্ড ভেঙে দেয়ার প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছিল। আজকাল হরতালের আগে-পিছে বক্তৃতা দেবার মত নেতাও বিএনপিতে দেখা যায় না।

হারাধনের পুত্রদের একে একে কারাগারে হারিয়ে যাবার মত এই এক মাহমুদুর রহমানই ছিলেন বিএনপির শেষ ভরসা, যিনি একা সরকারের বিরুদ্ধে একের পর এক বিভিন্ন খবর দিয়ে লড়াই করছিলেন। আওয়ামী লীগের জন্য ক্রমেই মাথাব্যথার কারণ হয়ে ওঠা  মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতার করে সরকার বিরোধীদল প্রতিহতের কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দিল!!
 
তবে এ কথা অনস্বীকার্য যে, মাহমুদুর রহমান বিভিন্ন সংবাদ পরিবেশনে হলুদ সাংবাদিকতার আশ্রয় নিয়েছিলেন। গুটি কয়েক ব্লগার যারা কিনা ব্লগে ধর্ম অবমাননাকর লেখা লিখে ধর্ম প্রিয় ব্লগারদের দ্বারা ব্লগেই প্রতিহত হয়েছিল, মাহমুদুর রহমান রংচং দিয়ে ফুলিয়ে ফাপিয়ে সেই সব বিস্মৃতপ্রায় লেখাগুলো এমনভাবে তার সংবাদপত্রে পরিবেশন করেছিলেন যেন বাংলাদেশের সবাই ওদের সেই সব লেখা পড়ে নাস্তিক হয়ে যাচ্ছে!!
 
এছাড়া ফটোশপের আশ্রয় নিয়েও শাহবাগে অনেক অনৈতিক কার্যকলাপ চলছে বলেও তিনি প্রোপাগান্ডা ছড়িয়েছেন বলে তার বিরুদ্ধে সচেতন জনগণ অভিযোগ করেন। এইসব সংবাদের সাথে বাস্তবতার বিশাল ফারাক রয়েছে।

মাহমুদুর রহমান গ্রেফতারে আদতে আওয়ামিলীগ বিভিন্নভাবে লাভবান হবে বলেই আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে।
 
সম্প্রতি তরুণ প্রজন্মের প্রায় সবাই (শিবির ও ছাত্রদল বাদে) ব্লগার গ্রেফতার ও শাহবাগের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে গড়ে তোলা গণজাগরণ মঞ্চ নিয়ে সরকারের বিমাতাসুলভ আচরণে ক্ষুব্ধ হয়েছে।   তারা মনে করে যে, দেশে সাম্প্রতিক কালে সৃষ্ট এই অস্তিক-নাস্তিক ইস্যু মূলত মাহমুদুর রহমানের সৃষ্টি। রাজনীতিতে নতুন সংযোজন হেফাজতে ইসলামের উত্থানও মাহমুদুর রহমানের ভূমিকা রয়েছে। শাহবাগ আন্দোলনকে বিভক্তির পিছনেও মাহমুদুর রহমান।
 
সম্প্রতি কয়েকজন ব্লগার গ্রেফতারে তরুণ প্রজন্মসহ সচেতন মহল থেকে দাবি করা হয় যে, ধর্ম অবমাননাকর লেখাগুলোর স্ক্রিন শট ছাপিয়ে মাহমুদুর রহমানও ধর্মের অবমাননা করেছেন এবং তাকেও গ্রেফতার করা হোক। তাদের দাবি, একই যাত্রায় ভিন্ন ফল হবে কেন?

তদুপরি, আসন্ন ভোটের বাজারে এই তরুণ প্রজন্ম গতবারের ন্যায় একটি বিশাল ফ্যাক্টর হয়ে দাড়াবে। মাদ্রাসায় পড়ুয়া আঠার বছরের নিচের কিশোরদের থেকে শাহবাগের সমর্থনে থাকা তরুণদেরকেই আওয়ামী লীগ হয়তো গুরুত্ব দেয়া সমীচীন মনে করে থাকবে। মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতারে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বলিয়ান তরুণ প্রজন্মের কাছে আওয়ামী লীগ তার হারানো আস্থা খুঁজে পাবে বলেই ধারণা করা যায়।
 
এ কথা ঠিক যে, মাহমুদুর রহমান গ্রেফতারে বিরোধীদল লাগাতার আন্দোলনে যাবে। কিন্তু তাতে হয়তো আওয়ামী লীগের তেমন যাবে-আসবে না। এমনিতেই সরকার পতনের এক দফা আন্দোলনে ও কেন্দ্রীয় নেতাদের ছাড়ানোর দাবিতে বিএনপি একের পর এক হরতাল দিয়ে যাচ্ছে। সম্প্রতি হরতালকে "মামুলি কর্মসূচি" হিসেবে ঘোষণা করে সরকার মূলত বিরোধীদলের লাগাতার হরতালের হুমকিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করেছেন বলেই ধারণা করা যায়।

মাহমুদুর রহমান গ্রেফতার না হলেও হরতাল হত, গ্রেফতার হলেও হবে। হরতাল করার ইস্যু তো বিরোধীদলের কাছে এমনিতেই রেডি আছে। মাহমুদুর রহমান গ্রেফতার সেই পুরান ইস্যুর ভিতরেই যুক্ত হয়ে যাবে। অর্থ্যাত বিরোধীদলের হরতালের প্রেসক্রিপশনে কোনো হের ফের হবে বলে মনে হয় না।

মাহমুদুর রহমান গ্রেফতার হলেও "আমার দেশ" পত্রিকা বন্ধ করে দিয়ে আওয়ামী লীগ নিজেদের পুরনো বাকশালী খেতাব পুনরুদ্ধার করবে না বলেই আশা করা যায়।

তবে মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতার করে সরকার বিরোধীদলের সাথে আসন্ন ইলেকশন নিয়ে কোনো গোপন আতাতে যাবে কি না সে সন্দেহও কিন্তু একেবারে উড়িয়ে দেয়া যায় না।

এভাবে ইলেকশনের আগে প্রধান দুই দলের একে অন্যের মেরুদণ্ড ভেঙে দেয়ার এই খেলা আমাদের রাজনীতিতে অনেক পুরনো। যুগে যুগে একই চিত্র আমরা দর্শকের সারিতে বসে দেখি। রাজপথে আমরা দুই দলের জন্য হানাহানি করি। প্রতিবারই আশায় থাকি এ অবস্থার পরিবর্তন হবে। নিজেদের আখের গুছানোর জন্য নয়, জনগনের আখের তৈরি করতে দুর্নীতিহীন সরকার গঠিত হবে।

সমস্যাসংকুল এই দেশে আশাই একমাত্র আমাদের বাঁচিয়ে রাখে।
Zinia-Zaheed
জিনিয়া জাহিদ: বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও ব্লগার।


বাংলাদেশ সময়: ১৫০৪ ঘণ্টা এপ্রিল ১১, ২০১৩

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।