ঢাকা, শনিবার, ১৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

ড. ইউনূসকে অভিনন্দন

আদনান সৈয়দ, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫৪৫ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৯, ২০১৩
ড. ইউনূসকে অভিনন্দন

নিউইয়র্ক থেকে: ক্লাসের সমস্ত নীরবতা ভেঙ্গে হঠাৎ করেই আমাদের সিটি ইউনিভার্সিটি অব নিউইয়র্কের ইংরেজি সাহিত্যের শিক্ষক ডেভিড আমার নাম উচ্চারণ করে বললেন, ‘‘আদনান নোবেল পেয়েছে, চলো আমরা সবাই তাকে অভিবাদন জানাই। ” ডেভিডের মুখে এ রকম ইয়ার্কি মার্কা কথা শুনে ক্লাসের সবাই আমার দিকে তাকিয়ে হেসে ফেটে পড়েন আর কি! আমারও মনে মনে ডেভিডের দিকে খুব রাগ হচ্ছিল- ‘বেটা ইয়ার্কি মারার আর জায়গা পেলি না?’।



কিন্তু ডেভিড নাছোড়বান্দা। তিনি এবার সরাসরি শিক্ষকের মঞ্চে তার পাশে গিয়ে দাঁড়ানোর জন্য আমাকে অনুরোধ করলেন। সব দেখে-শুনে আমার তো আত্মারাম খাঁচাছাড়া হয়, আর কি! শুধু মনে মনে ভাবছিলাম, এই পাগলাটার আজ হল কি? (ইংরেজি শিক্ষক ডেভিড ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাসে পাগলা এবং ক্ষ্যাপা হিসেবে বেশ নাম কুড়িয়েছিলেন)।

আমি মঞ্চে তার সামনে আসতেই এবার ডেভিড তার আসল কথায় এলেন- ‘‘আদনানের দেশের একজন মানুষ, নাম মুহাম্মদ ইউনূস আর তার গ্রামীণ ব্যাংক শান্তির জন্য নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। এই গর্ব আমাদের সবার। চলো, এর জন্য আমরা সবাই দাঁড়িয়ে আদনানকে অভিবাদন জানাই। ’’

সেটা ছিল ২০০৬ সালের কথা। সত্যি বলতে সেদিন আমি আমার চোখের আনন্দ অশ্রু ধরে রাখতে পারিনি। যখন আমরা দূর প্রবাসে বসে প্রতিনিয়ত দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা, দুর্নীতি, অনিয়ম, হত্যা, গুম, খুন ইত্যাদি শুনতে শুনতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম, ঠিক সেই সময়ে অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নোবেল প্রাপ্তিটা ছিল আমার মতো হাজার হাজার প্রবাসী বাংলাদেশির জন্য মরুভূমিতে এক পশলা বৃষ্টির মতোই।  

স্পষ্ট মনে আছে, গ্রামীণ ব্যাংক এবং ড. ইউনূস শান্তিতে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন- খবরটা যখন আমাদের নিউইয়র্ক প্রবাসীদের কানে এল, তখন নিউইয়র্কের বাঙালি পাড়া জ্যাকসন হাইটসে মিষ্টি খাওয়ার ধুম পড়ে গিয়েছিল। এই গর্বে সেদিন আমাদের বুকের ছাতি যেন দশ ফুট চওড়া হয়ে গিয়েছিল।  

ড. ইউনূস গত বুধবার ১৭ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বেসরকারি সম্মাননা ‘কংগ্রেসনাল স্বর্ণপদক’ এ ভুষিত হয়েছেন। আবারো তাকে অভিনন্দন! মার্কিন পরিষদের স্পিকার জন বোয়েনার আনুষ্ঠানিকভাবে যখন তার হাতে এই পদক তুলে দিচ্ছিলেন, তখন সে দৃশ্য দেখে দ্বিতীয় দফায় আবারো আনন্দ অশ্রু বর্ষণ করলাম।

১৯৭৬ সালে জর্জ ওয়াশিংটনকে দিয়ে যে পদকের যাত্রা শুরু হয়েছিল, সেই পদকটি যে খুবই ভারি এবং অহঙ্কার করার মতো একটা বিষয়, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। জেনারেল কলিন পাওয়েল, ফ্রাংক সিনাত্রা, মাদাম তারেসা, রোসা পার্ক, পোপ জন পল, মার্টিন লুথার কিংসহ অনেক বিশ্ববরেণ্য মানুষ এই পদকে ইতিমধ্যেই ভূষিত হয়েছেন। মুহাম্মদ ইউনূসের নামটিও এখন এই পদক তালিকায় যোগ হল। এই গর্ব শুধু ড. ইউনূসের নয়, এ গর্ব গোটা বাংলাদেশের।

‘আমরা দারিদ্র্যকে যাদুঘরে পাঠাবো’- মুহাম্মদ ইউনূসের এ মন্ত্রে উদ্দীপ্ত হয়ে গোটা পৃথিবীর মানুষ যখন আনন্দে সোচ্চার তখন অবাক হয়ে লক্ষ্য করি, খোদ নিজ ভূমিতেই এই মানবপ্রেমিক নিগৃহীত হয়ে আছেন! সরকার ও আওয়ামী লীগের অনেক নেতাই এখন পর্যন্ত ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রকাশ্যে সমালোচনা করে আসছেন! হয়তো সে কারণেই ড. ইউনূসের এ ‘কংগ্রেশনাল স্বর্ণপদক’ প্রাপ্তিতে বাংলাদেশের সরকারি পর্যায়ে কোথাও কোনো আলোড়ন চোখে পড়লো না।

তবে বিরোধী দলের নেতা খালেদা জিয়া তাকে অভিনন্দন জানালেও সরকারি পর্যায়ে এ ‘এড়িয়ে যাওয়া নীতি’ প্রকারান্তরে আমাদের হীনন্মন্যতারই যে চরম বহি:প্রকাশ, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

আবারো পুরনো একটি স্মৃতিতে ফিরে যাই। নোবেল প্রাপ্তির পর মুহাম্মদ ইউনূস নিউইয়র্ক এলেন। যুক্তরাষ্ট্র বসবাসরত আমরা প্রবাসী বাঙালিরা কুইন্স কলেজের কোলডেন হলে দল-মত নির্বিশেষ তাকে এক নাগরিক সংবর্ধনা দিয়েছিলাম। পিন পতন নীরবতায় ড. ইউনূস সেদিন আমাদের শুনিয়েছিলেন, গ্রামীণ ব্যাংকের সাফল্যের কথা। বলেছিলেন, কিভাবে দারিদ্র্যকে বাংলাদেশ তথা গোটা বিশ্ব থেকেই চিরতরে দূর করে দিতে চান তিনি।

হঠাৎ লক্ষ্য করছিলাম, আমার ডান পাশের চেয়ারে বসা এক বাঙালি ভদ্রলোক আনন্দে উত্তেজনায় তার কথায় উদ্বুদ্ধ হয়ে হাত তালি দিতে দিতে প্রায়ই দাঁড়িয়ে পড়ছিলেন আর বিড় বিড় করে মাথা ঝাঁকিয়ে কিসব যেন আপন মনেই বলছিলেন। আমার চোখাচোখি হতেই তিনি বললেন, ‘‘আরে বুঝলেন ভাই, ইউনূসের মতো আর দু’জন হইলেই আমাদের হইয়া যাইতো! আর যাই হোক  আমাদের আর এই বিদেশের মাটিতে পইচ্যা মরতে হইতো না। ’’

আমি কাঁধ ঝাকিয়ে তখন তার কথার প্রতি আমার সমর্থন জানিয়েছিলাম।

কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানই সমালোচনার উর্ধে নয়।   যে কোনো গঠনমূলক সমালোচনায় একজন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান পরিশুদ্ধ হতে বাধ্য। অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বা তার প্রতিষ্ঠান গ্রামীণ ব্যাংক নিশ্চয়ই সমালোচনার উর্ধ্বে হতে পারে না। ইউনূস অথবা তার প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যংকের গঠনমূলক সমালোচনা অবশ্যই করা যেতে পারে।

কিন্তু সমালোচনার নামে প্রতিনিয়ত ব্যক্তি ইউনূসের প্রতি বিষ বাক্য ছড়িয়ে সরকার নিজেই যে নিজেকে অনেক ছোট করে ফেলছে, সে কথা সরকারকে কে বোঝাবে? শেষ কথা হল, মুহাম্মদ ইউনূস গোটা বিশ্বেই একজন সম্মানিত ব্যক্তিত্ব।

এই নোবেল পাওয়া মানুষটাকে কি আমরা আমাদের নোংরা রাজনীতির বাইরে রাখতে পারি না?

লেখক: অ্যাক্টিভিস্ট, বøগার, ফ্রি-ল্যান্স জার্নালিস্ট
[email protected]

বাংলাদেশ সময়: ১৫৩৭ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৯, ২০১৩
সম্পাদনা: অশোকেশ রায়, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর- [email protected]

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।