ঢাকা, শনিবার, ১৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

ফটিকছড়ি, মানবতা যেখানে ডুকরে কাঁদে

নিজামুল হক বিপুল | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯৫৩ ঘণ্টা, এপ্রিল ২০, ২০১৩
ফটিকছড়ি, মানবতা যেখানে ডুকরে কাঁদে

ঘটনাস্থল চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি। যেখানে শ্লোগানে শ্লোগানে কোপানো হয়েছে একদল নিরস্ত্র মানুষকে।

কুপিয়েছে আরেক দল হিংস্র জানোয়ার। তারা বর্বর ও ভয়ঙ্কর এক উম্মাদনায় মেতে উঠেছিল সেদিন। এই ঘাতকদের রাজনৈতিক পরিচয় হচ্ছে- এরা জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্র শিবিরের স্থানীয় নেতাকর্মী। ধর্মকে পুঁজি করে এই ঘাতকরা গত ৪০ বছর রাজনৈতিক ফায়দা লুটছে। এখনও তারা একই কায়দায় নিজেদের স্বার্থ হাসিল করতে মরিয়া। কৌশল হিসেবে তারা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রকম মিথ্যা প্রপাগান্ডা ছড়িয়ে সাধারণ ধর্মপ্রাণ মানুষকে বিভ্রান্ত করে ধ্বংসযজ্ঞে মেতে উঠে, মানুষ হত্যা করে।
 
গত ১১ এপ্রিল চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির ভুজপুর গ্রামে যে নৃশংস এবং ইতিহাসের ভয়াবহ ও বর্বরতম হত্যাকাণ্ড ঘটেছে, যাকে গণহত্যা বললে অত্যক্তি বা অতিরঞ্জন বলা হবে না। সেই নারকীয় হত্যাযজ্ঞের একটি ভিডিও ক্লিপ ইন্টারনেটের কল্যাণে এখন ফেইসবুক, টুইটারসহ সামাজিক নেটওয়ার্কের বিভিন্ন মাধ্যমে ব্যাপকভাবে স্থান করে নিয়েছে। বাংলাদেশ তথা গোটা বিশ্ব এই দৃশ্য দেখছে। সেই ভিডিও ক্লিপটি আমার দেখার সুযোগ হয়েছিল বাংলা নববর্ষের দিন অর্থাৎ পহেলা বৈশাখ।
 
তারপর দিন সোমবার সকালে এই ক্লিপটি একাত্তর টিভিতে সংবাদ সংযোগে প্রচার করা হচ্ছিল। ঠিক এমন সময় আমার সাড়ে চার বছরের কন্যা রূদবা” স্কুলে যাবার জন্য জামা-কাপড় পরে প্রস্তুত। তার চোখ আটকে যায় টিভিতে। সে শ্লোগান শুনে শুনে আমাকে বার বার জিজ্ঞেস করছিল- বাবা এই লোকগুলো কি করছে? কাকে মারছে? এরা কি দুষ্ঠু লোক? এরা কি কাদের মোল্লা। শাহবাগের গণজাগরণের কারণে কাদের মোল্লার নামটি আমার মেয়ের মুখস্থ হয়ে গেছে। সঙ্গত কারণেই তার মুখে কাদের মোল্লার নাম উচ্চারণ হচ্ছে।

আমি তার প্রশ্নের জবাব এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করলে সে আমাকে বলে বাবা উত্তর দিচ্ছ না কেন? এই লোকগুলো কাকে মারছে বল? আমি তাকে বললাম, এগুলো তোমার দেখার দরকার নেই। স্কুলে চল। নাছোড়বান্ধা আমার কন্যা বলল না, আগে বল ওরা কাকে মারছে? বাধ্য হয়েই আমি তাকে বললাম, যারা মারছে এরা দুষ্ঠু লোক। আর যাদেরকে মারছে এরা নিরীহ ও নিরপরাধ।

যাকগে, এ প্রসঙ্গের অবতারণা করলাম এ কারণেই যে, ছোট্টও শিশুটিও বুঝতে পারছে একদল উম্মাদ কিছু লোককে নির্মমভাবে হত্যা করছে, যা একটি শিশুরও নজর এড়াতে পারেনি। অথচ নৃশংস এই ঘটনা আমাদের সামজের সুশীল এবং ভাড়াটে বুদ্ধিজীবীদের চোখ এড়িয়ে গেছে এবং যাচ্ছে। এখানে তারা নির্বাক!

আমি যেমন কোনো লেখক নই, তেমনি ভালো লিখতেও জানি না। শুধু মনের ভেতর জন্ম নেওয়া কিছু বাক্য কম্পিউটারের কি বোর্ডের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করছি।

সেদিন ফটিকছড়িতে যা ঘটেছে তা শুধু নারকীয়ই নয়, এ দৃশ্য একাত্তরকে মনে করিয়ে দেয়। ওই দিন জামায়াত-শিবিরের ডাকা হরতালের প্রতিবাদে একটি হরতাল বিরোধী মিছিল বের করে ফটিকছড়ি উপজেলা আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা ও সংসদ সদস্য প্রার্থী এটিএম পেয়ারুল ইসলামের নেতৃত্বে বের হওয়া এই মিছিলটি ছিল শান্তিপূর্ণ ও নিরস্ত্র। এতে কয়েক‘শ নেতাকর্মী অংশ নিয়েছিলেন। মোটরসাইকেল, চান্দের গাড়ি, প্রাইভেট কার, মাইক্রোবাসসহ শতাধিক যানবাহন যোগে বলতে গেলে হরতাল বিরোধী এই মিছিলটি ছিল মূলত একটি মোটরশোভাযাত্রা। আর এটিই হচ্ছে স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগি সংগঠনগুলোর অপরাধ।

সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবরে যতটুকু জানা গেছে, তাতে মিছিলটি যখন ফটিকছড়ির ভুজপুর বাজারে পৌঁছে তখনই চার দিক থেকে মিছিলকারীদের ঘিরে ফেলে স্থানীয় জামায়াত-শিবির, হেফাজতে ইসলাম এবং কুখ্যাত রাজাকার যুদ্ধাপরাধী সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর অনুসারীরা। তারা মিছিলের উপর অতর্কিতে হামলা চালায়। এর আগে এলাকার বিভিন্ন মসজিদ থেকে প্রচার করা হয় যে, নাস্তিকরা ভুজপুরে মসজিদ ও মাদ্রাসায় হামলা করেছে এবং স্থানীয় মাদ্রাসার বড়হুজুরকে তুলে নিয়ে গেছে। হত্যা করেছে মসজিদের ইমামকে। আর যায় কই, এমন মিথ্যা প্রচারে আশপাশের গ্রাম থেকে নারী-পুরুষরা যোগ দেয় হামলাকারী জামায়াত-শিবির ও হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে। তারপর চলে নারকীয় তাণ্ডব। মিছিলকারীরা ছিল একেবারেই নিরস্ত্র। তারা কোনো প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেনি। আত্মরক্ষার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। মোটরসাইকেল, গাড়িসহ যানবাহন রেখে যে যার মত করে পারে পালানোর এবং বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় নেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু হায়েনারা এতোটাই হিংস্র ছিল যে, নিরস্ত্র এই লোকগুলোকে ধরে ধরে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কোপাতে থাকে। মোটরসাইকেলসহ অন্যান্য যানবাহনে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। বাদ যায়নি ফায়ার সার্ভিসের গাড়িও।

ফটিকছড়ির ঘটনায় কতজন মারা গেছেন তার সঠিক হিসাব পাওয়া যায়নি। সংবাদমাধ্যমে চার থেকে পাঁচ জনের মৃত্যুর কথা নিশ্চিত করা হলেও স্থানীয় সূত্রগুলো এবং বিভিন্ন মাধ্যমে যেসব তথ্য জানা গেছে তাতে এ সংখ্যা অন্তত ১৮ থেকে ২০ জন হবে। তবে গুজব আছে মৃতের সংখ্যা আরো অনেক বেশি।
সাম্প্রতিক সময়ে দেশের ইতিহাসে ভুজপুরের প্রত্যন্ত একটি গ্রামে একসঙ্গে এতো লোক হত্যার কোনো ঘটনা ঘটেনি। অথচ মিডিয়ায় যেভাবে খবর প্রচার করা হয়েছে তাতে ঘটনার প্রকৃত চিত্র উঠে আসেনি। সে এক রহস্য! সাম্প্রতিক সময়ে দেশের ইলেকট্রনিক গণমাধ্যমগুলোতে রাতের বেলা টক শো ছাড়া অন্য কোনো অনুষ্ঠান খুব একটা চোখে পড়ে না। আর এসব টকশোতে ভাড়াটে বুদ্ধি বিক্রেতারা জাতিকে নানা জ্ঞান বিতরণ করে যাচ্ছেন রাতের পর রাত। বিশেষ করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং রায় পরবর্তি দেশের কয়েকটি স্থানে সহিংস ঘটনার পর এসব ইস্যুতে কড়া ভাষায় সরকারের সমালোচনা করে যাচ্ছেন। পারলে টক শো’র মাধ্যমেই তারা সরকারকে ক্ষমতা থেকে নামিয়ে ফেলেন এমন অবস্থা।
পুরান ঢাকায় বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ডের পর রাতের পর রাত টেলিভিশন চ্যানেলগুলো গরম করে রেখেছিলেন এই টকশোওয়ালারা। মানবতা যায় যায় বলে তারা চিৎকার করেছিলেন। অথচ আশ্চর্য হয়েছি, এসব টক শোতে ফটিকছড়ির ঘটনা নিয়ে কোনো আলোচনা নেই বললেই চলে। এখানে বিবেক নিরব, নির্বাক, নিথর! আজ তাদের কারো মুখেই ফটিকছড়ি নিয়ে কোনো যো নেই। সেখানে মানবতা লঙ্ঘন হয়নি(!) কারণ সেখানে যে আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগি সংগঠনের নেতাকর্মীরা মারা গেছেন। তাও আবার জামায়াত-শিবির এবং কথিত হেফাজতে ইসলামের লোকজন তাদেরকে পিটিয়ে, কুপিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করেছে। মানবতা এখানে ডুকরে কাঁদলেও ভাড়াটে বিবেকবানরা এখন চুপ। কিন্তু পুলিশ যদি এখন দেশের কোথাও তাদের (পুলিশ) উপর আক্রমন ঠেকাতে গুলি চালায় আর তাতে একজন লোকও মারা যায়, আমি নিশ্চিত ওই রাতে সুশীল নামদারী ভাড়াটে বুদ্ধিজীবীরা চিৎকার করে উঠবেন আর বলবেন, মানবতা গেল...মানবতা গেল...।

লেখক- সাংবাদিক, সিনিয়র রিপোর্টার, বাংলাদেশ প্রতিদিন

বাংলাদেশ সময়: ১৯৪৬ ঘণ্টা, এপ্রিল ২০, ২০১৩

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।