ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

দুদক কি আদৌ স্বাধীন?

জিনিয়া জাহিদ, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩২৬ ঘণ্টা, জুন ৩, ২০১৩
দুদক কি আদৌ স্বাধীন?

দুর্নীতিতে পাঁচ বারের সাবেক বিশ্বচ্যাম্পিয়ন এবং বর্তমানে দক্ষিণ এশিয়ার চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশে দুর্নীতি দমনের জন্য একটি স্বাধীন (?!) কমিশন আছে, যা "দুর্নীতি দমন কমিশন" বা সংক্ষেপে দুদক নামে পরিচিত হলেও দুর্মুখেরা অবশ্য তাকে "দুর্নীতিবাজ আশ্রয় কমিশন" নামেই ডাকতে পছন্দ করে।

স্বাধীন বাংলাদেশে দুর্নীতির মাত্রা বিন্দুমাত্র না কমে বরং তা মানুষের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বিস্তার লাভ করেছিল।

সারা বিশ্বে দুর্নীতি নামক প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হবার ট্রফিটি অটোমেটিক বাংলাদেশের কাছে চলে আসত। অবশেষে আন্তর্জাতিক চাপে ২০০৪ সালে দুর্নীতি দমন ব্যুরোকে বিলুপ্ত করে একটি স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশন গঠন করতে তত্কালীন বিএনপি সরকারকে বাধ্য করা হয়।

স্বাধীন বলা হলেও জন্মের পর থেকেই দুদক কি আসলেই কখনো কোনো সময়ের জন্য স্বাধীন ছিল বা আছে? জন্ম থেকেই দুদকে যে সরকার আসে সে সরকারের প্রতি নতজানুভঙ্গি দুদককে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে বারবার। আমাদের দুদক এতটাই স্বাধীন (!) একটি প্রতিষ্ঠান যে, সরকার বদলের সাথে সাথে দুদকে জড়িয়ে থাকা সব মুখগুলোও বদলে যায়। দুর্নীতি দমনের জন্য স্বাধীন (?) দুদকে সরকারের পছন্দমত লোকদের নিয়োগ দেয়া হয়!! সত্যি সেলুকাস, কি বিচিত্র আমাদের দেশপ্রেম, কতইনা আন্তরিক আমরা দুর্নীতির বিরুদ্ধে !!
 
যে প্রতিষ্ঠানে সরকারি দলের লোকেরা বসে থাকেন, তাদের কাছে কি আদৌ কোনো কিছু প্রত্যাশা করা সাজে? আর সাজে না এজন্যই, যে সরকারের আমলে যে দুর্নীতি হয়, সে সরকারের আমলে সেই দুর্নীতির বিরুদ্ধে কখনই তদন্ত হয় না। হলেও তা আলোর মুখ দেখে না কখনই। কোনো এক অদৃশ্য কারণে সেইসব দুর্নীতি বন্ধ না হয়ে বরং দুর্নীতির নতুন নতুন রূপ আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়।
 
স্বতস্ফূর্তভাবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে এবং দুর্নীতিবাজদের বিপক্ষে দুদকের কোনো কার্যক্রম আমাদের চোখেই পড়ে না। মাঝে মাঝে সংবাদপত্রে নিজেদের অস্ত্বিত্বের প্রমাণ দিতে মৃতপ্রায় এই প্রতিষ্ঠানের কোনো কর্তা ব্যক্তির বিবৃতি আমাদের দৃষ্টিগোচর হয় বটে, তবে তা অধিকাংশ সময়ই সরকারি কোনো পদস্থ ব্যক্তির পক্ষে সাফাই গাওয়া ছাড়া আর কিছু নয়।

আমাদের দেশের এই স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানটি এতটাই স্বাধীন যে, সরকারকে বলে দিতে হয় অমুক ব্যাপারটাতে দুর্নীতির অনুসন্ধান করুন কিংবা তমুকের নাম যেন কোনভাবেই দুর্নীতিবাজের তালিকায় না আসে। তাই তো আমরা কখনই জানব না আবুলেরা (সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন) কিভাবে দেশপ্রেমিক হয়। আমরা কখনই জানব না রেলের কালো বিড়াল কীভাবে থলের ভেতর বেড়ে ওঠে, দুষ্টু শেয়ারবাজার কীভাবে রাবিশে পরিণত হয়, হলমার্ক ও ডেসটিনির সাথে জড়িয়ে থাকা দুর্নীতিবাজদের পক্ষে অর্থমন্ত্রীর নির্লজ্জ গুণগান না চাইলেও শুনতে হয়। দুদকের নাকের ডগায় বসে রাজনীতিকদের সম্পদের হিসাব না দেয়া, চুনো-পুটি নেতাদেরও দামি গাড়ি হাঁকানোর মতো ঘটনা দেখেও না দেখার ভান করাকে দুদকের অস্ত্বিত্ব প্রশ্নবিদ্ধ করে বৈকি।

দুর্নীতি কে করছে আর কে করছে না তা কিন্তু দেখার জন্য দুদকের লোক দেখানি দীর্ঘমেয়াদী কোনো তদন্তদলের রিপোর্টের উপর নির্ভর করার দরকার হয় না। সাদা চোখে আমরা সাধারণ জনগণ কিন্তু খুব সহজেই দেখতে পারি কোন ব্যক্তিটি দুর্নীতিবাজ আর কে সৎ? বিশ্বাস না হলে একটু খেয়াল করে দেখুন। ভালো করে চেয়ে দেখুন আপনার চারপাশে। একই সরকারি চাকরিতে দু’বন্ধু থেকেও একজন রাতারাতি বাড়ি-গাড়ির মালিক বনে যায় কোন চেরাগের দৈত্যের কারসাজিতে? সরকারি ওষুধ বেচে হাসপাতালের পিয়নের কীভাবে থাকে পাঁচতলা আলিশান বাড়ি? সরকারি কর্মচারী-কর্মকর্তাদের ছেলেমেয়েরা কোন খুঁটির জোরে সেল্ফ-ফিন্যান্সে উন্নত দেশগুলোতে পড়াশুনা করতে যায়? একটু ভাবুন, উত্তর এমনিতেই মিলে যাবে। এর জন্য জনগণের টাকায় কয়েক সদস্যের তদন্ত দল করে, বিজনেস ক্লাসের টিকিটে বিদেশ ভ্রমণ না করলেও চলবে। সততা, সাহস ও আন্তরিকতা থাকলে দেশে থেকেও দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা সম্ভব।

চিহ্নিত দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কখনই কোনো দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয় না, এজন্যই আজ সবাই যেভাবে পারছে দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ছে। বাংলাদেশ নামক অপার সম্ভাবনার দেশটি শুধুমাত্র দুর্নীতির জন্য পিছিয়ে পড়ছে বারবার।

যে দল ক্ষমতায় আসে সেই দলে কে কত বেশি দুর্নীতি করতে পারে চলে তার সরব প্রতিযোগিতা। শুধু তাই নয়, আমাদের প্রধান দু’দলের মধ্যে চলে দুর্নীতির প্রতিযোগিতা। গত আমলের বিএনপির দুর্নীতিকে টেক্কা দিতে আওয়ামী লীগ আদা-জল খেয়ে মাঠে নেমেছে। বিএনপির দুর্নীতিকে ছাড়িয়ে যেতে না পারা হলো প্রেস্টিজ ইস্যু। বিএনপি ক্ষমতায় এলে তারাও আওয়ামী লীগের থেকে বেশি দুর্নীতি করার শপথ নিয়েই সংসদে যাবে। দুর্নীতি করাটাই যেন এখন আমাদের রাজনীতির আলটিমেট গোলে পরিনত হয়েছে।
 
পরিশেষে স্বাধীন (?) দুদকের কাছে খুব জানতে করছে, বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে করা আমাদের ভোটে নির্বাচিত কিংবা অনির্বাচিত দেশপ্রেমিক রাজনীতিক নেতাদের অতুলনীয় দেশপ্রেমের নমুনা হিসেবে করা দুর্নীতর প্রায় হাজারখানেকের ওপর মামলাগুলোর অগ্রগতি কতখানি? দয়া করে আপডেট জানাবেন কি? আপনাদের স্বাধীন অস্তিত্বের প্রমাণ দিন নতুবা আমাদের রক্ত পানি করা টাকায় দুর্নীতি বন্ধ করার নাম করে দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেবার প্রহসন বন্ধ করুন।

zinia-zahid-smজিনিয়া জাহিদ: বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, অর্থনীতিবিদ, গবেষক, কলামিস্ট এবং ব্লগার,

 

 বাংলাদেশ সময়: ১৩১২ ঘণ্টা, জুন ০৩, ২০১৩

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।