ঢাকা, মঙ্গলবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

সাদাসিধে কথা

বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা

মুহম্মদ জাফর ইকবাল | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০০০৩ ঘণ্টা, অক্টোবর ১১, ২০১৩
বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা

১.
কয়েক বছর আগে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা দিতে এসে একটা ছেলে গাড়ি অ্যাকসিডেন্টে মারা গিয়েছিল। আমি এ ঘটনার কথা কিছুতেই ভুলতে পারি না।

শুধু মনে হয়, কোনো দূর এক শহর থেকে ভর্তি পরীক্ষা দেয়ার জন্য এতো দূরে তাকে টেনে আনার জন্যই হয়তো তাকে অল্প বয়সে মারা যেতে হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার নামে সবাই মিলে যে ভয়ংকর একটি হৃদয়হীন পদ্ধতি দাঁড় কারিয়ে রেখেছে সেই পদ্ধতিই কি কোনোভাবে এর জন্য দায়ী নয়!

আবার ভর্তি পরীক্ষা আসছে। আমি জানি হাজার হাজার ছেলে মেয়ে তাদের অভিভাবকদের নিয়ে ভর্তি পরীক্ষা দেওয়ার জন্য এক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আরেক বিশ্ববিদ্যালয়ে পাগলের মতো ঘুরে বেড়াবে। খাওয়া ঘুম বিশ্রাম দূরে থাকুক, অনেক জায়গায় তাদের একটা বাথরুমেও থাকার সুযোগ পর্যন্ত থাকবে না।

অথচ এর কোনো প্রয়োজন ছিল না। খুব সহজেই ছাত্র-ছাত্রীদের এই ভয়ংকর অমানবিক ভোগান্তি থেকে মুক্তি দেয়ার সুযোগ ছিল। বাংলাদেশ সব কয়টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় যদি রাজি হতো তাহলে খুব সহজেই সবাই মিলে একটি (হ্যাঁ, মাত্র একটি) চমৎকার মানসম্মত ভর্তি পরীক্ষা নিয়েই এই দেশের সব ছাত্র-ছাত্রীকে নিজেদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য বিবেচনা করতে পারত।

এই সরকার আসার পর শিক্ষা মন্ত্রাণালয় সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়কে ডেকে সম্মিলিত একটি উদ্যোগ নিয়েছিল। সেখানে সব বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলররা ছিলেন এবং আমাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল বিষয়টির সম্ভাব্যতা নিয়ে একটা বক্তব্য দিতে। আমি একটু গাধা প্রকৃতির মানুষ, তাই সরল বিশ্বাসে সকল তথ্য উপাত্ত নিয়ে হাজির হয়েছিলাম। বক্তব্য শুরু করার আগেই অবশ্য টের পেয়েছিলাম আমার সেখানে হাজির হওয়াটাই বড় ধরনের নির্বুদ্ধিতা হয়েছে।

সেখানে বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলররা আসেন দেরি করে এবং চলে যান সবার আগে। যাবার আগে বলে যান যে, তাদের বহুল পরীক্ষিত একটা ভর্তি পরীক্ষা পদ্ধতি চালু আছে, সেটা নড়চড় করার কোনো ইচ্ছা তাদের নেই। গুরুত্বপূর্ণ ভাইস চ্যান্সেলররা বলেন, তারা কঠিন নিরাপত্তার মাঝে ভর্তি পরীক্ষা নেন, সবাই মিলে পরীক্ষা নিলে তাকে সেই নিরাপত্তার গ্যারান্টি কে দেবে?

একজন ভাইস চ্যান্সেলর খোলাখুলি বলেই ফেললেন, তিনি যদি সম্মিলিত ভর্তি পরীক্ষার মতো একটি প্রস্তাব নিয়ে তার বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে যান, তাহলে তার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা তার বারোটা বাজিয়ে ছাড়বে। বেশিরভাগ ভাইস চ্যান্সেলর অবশ্য আমার বক্তব্যের মাথা মুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারলেন না কিংবা বোঝার চেষ্টাও করলেন না। আমার ছেলেমানুষী বক্তব্য শুনে হতাশভাবে মাথা নাড়াতে থাকলেন।

শেষ পর্যন্ত কিছুই হলো না। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিজের মতো করে পরীক্ষা নিতে থাকলো। আমার ধারণা বিষয়টি আরও খারাপ হলো। বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মনে হয় প্রায় রাগ করেই ছোট ছোট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য নির্ধারিত পরীক্ষার দিনগুলোতে ইচ্ছে মতো তাদের ভর্তি পরীক্ষার তারিখ ফেলতে লাগলো। এতে বাধ্য হয়ে ছোট ছোট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শেষ মুহূর্তে তাদের পরীক্ষার তারিখ পাল্টাতে বাধ্য হলো। আমি জানি আমাদের পরপর দু’বছর কুয়েটের সাথে একই দিনে পরীক্ষা নিতে হয়েছে। যেসব ছেলে-মেয়েদের এদু’টি বিশ্ববিদ্যালয়েই পড়ার আগ্রহ ছিল তারা মন খারাপ করে ক্ষুব্ধ হয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশা ছেড়ে দিয়ে অন্য একটিতেই সন্তুষ্ট থাকতে বাধ্য হয়েছে।

কিছুদিন আগে ইউজিসি থেকে আবার সকল বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে সম্মিলিত ভর্তি পরীক্ষার সম্ভাব্যতা আলোচনা করার জন্য সব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রতিনিধিদের ডেকে পাঠানো হয়েছিল। ন্যাড়া দু’বার বেলতলায় যায় না।
কিন্তু এটি আমার প্রিয় বেল, তাই ন্যাড়া হয়েও আবার বেলতলায় গিয়েছিলাম।

আমি এবারে খানিকটা কৌতূক এবং অনেকখানি বিস্ময় রিয়ে আবিষ্কার করলাম সব বিশ্ববিদ্যালয়ই সম্মিলিত ভর্তি পরীক্ষার পক্ষে বক্তব্য দিলেন। শুধু তাই নয়, কখন কীভাবে এই পরীক্ষাটি নেয়া যায় সেই খুঁটিনাটি নিয়েও দীর্ঘ আলাপ আলোচনা হলো এবং আমি যেহেত‍ু নির্বোধ প্রকৃতির তাই আবার একটু আশা নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম।

দেখতে দেখতে আবার ভর্তি পরীক্ষার সময় এসেছে। দেখা গেল অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়নি। সব বিশ্ববিদ্যালয় তাদের নিজেদের ভর্তি পরীক্ষ‍া নিচ্ছে। কেউ কেউ বরং উল্টো পথে হাঁটতে শুরু করেছেন। শুধুমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় সন্তুষ্ট না থেকে প্রত্যেকটা বিভাগের জন্য আলাদা আলাদা ভর্তি পরীক্ষা নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন। এই দেশের হতভাগ্য ছাত্র-ছাত্রীদের পীড়ন করার জন্যে এর চাইতে নির্মম কিছু আবিষ্কার করা যায় কি না আমার সেটি জানা নেই।

এ বছর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা পদ্ধতির কোনোই পরিবর্তন হয়নি, সেটি অবশ্য পুরোপুরি সত্য নয়। খুব ছোট একটা পরিবর্তন হয়েছে। পরিবর্তন এতো ছোট যে হয়তো কারো চোখেই পড়বে না। কিন্তু আমার ধারণা পরিবর্তনটা গুরুত্বপূর্ণ। বিষয়টি খুলে বলা যাক:

কিছুদিন আগে যশোর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমাকে তাদের সমাবর্তন বক্তা হিসেবে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। (আমার জন্যে সেটি ছিল অনেক বড় একটা দায়িত্ব এবং অবশ্যই অনেক বড় সম্মান। ) সমাবর্তনের পুরো অনুষ্ঠান শেষ করে যখন ফিরে আসছি, তখন যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চান্সেলর আমাকে বললেন, ‘আমরা তো অনেকদিন থেকে সব বিশ্ববিদ্যালয় মিলেই একট‍া ভর্তি পরীক্ষার জন্য চেষ্টা করে আসছি। কথাবার্তাও হচ্ছে। কিন্তু কোনো কাজ তো হচ্ছে না। শুধু আমরা আর আপনারা মিলে একটা একটা যৌথ পরীক্ষা নিলে কেমন হয়? একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় মিলে যে একটা ভর্তি পরীক্ষা নেয়া যায় তারই একটা উদাহরণ তৈরি হোক। ’

আমি বললাম, ‘চমৎকার আইডিয়া। আপনার প্রস্তাবটা আমি আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ে যাব, দেখি সবাইকে রাজি করানো যায় কী না। ’

নিজেদের প্রশংসা করা ঠিক নয়, এরপরেও বলছি, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় অনেক ভবিষ্যৎমুখী, অনেক আধুনিক। যশোর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রস্তাবটা আমাদের একাডেমিক কাউন্সিলে উপস্থাপন করা মাত্রই সবাই সেটি সাগ্রহে লুফে নিলো। আমি সেটি যশোর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর মহোদয়কে জানালাম এবং তখন তারা খুঁটিনাটি আলাপ আলোচনা করার জন্য তাদের কয়েকজন ডিন, বিভাগীয় প্রধান, সিনিয়র শিক্ষক, তরুণ প্রযুক্তিবিদ নিয়ে সারারাত গাড়ি চালিয়ে যশোর থেকে সিলেটে হাজির হলেন।

সম্মিলিত ভর্তি পরীক্ষার জন্যে আমরা যে পদ্ধতিটি গ্রহণ করতে যাচ্ছি সেটি এমনভাবে দাঁড় করানো হয়েছে যেন এর কারণে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়কেই তাদের প্রচলিত কোনো নিয়মকেই পরিত্যাগ করতে হবে না। ভিন্ন ভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় তাদের ভিন্ন ভিন্ন নিয়ম পুরোপুরি বজায় রেখেই এ সুযোগটি নিতে পারবে। সেটি সম্ভব হয়েছে তার কারণ, আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় কখনোই বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো বিভাগের বিষয় নিয়ে পরীক্ষা নেওয়া হয় না। ঘুরে ফিরে সব সময়েই ছাত্র-ছাত্রীরা এইচএসসির বিষয়গুলোর উপর পরীক্ষা নেয়া হয়। অর্থাৎ যে ছাত্রটি কম্পিউটার সায়েন্স কিংবা কেমিকেল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের জন্য ভর্তি পরীক্ষা দিতে যাচ্ছে, তাকে কম্পিউটার সায়েন্স বা কেমিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে তার জ্ঞানের পরীক্ষা করা হয় না। পরীক্ষা করা হয় তার এইচএসসির পদার্থ বিজ্ঞান, গণিত, রসায়ন, ইংরেজি ইত্যাদি বিষয়ে।

যদি এইচএসসির পরীক্ষাটি সত্যি সত্যি ছাত্র-ছাত্রীর সত্যিকারের মেধা যাচাই করতে পারত এবং ফলাফল মাত্র কয়েকটা গ্রেডের মাঝে সীমাবদ্ধ করে ফেলা না হতো তাহলে আলাদাভাবে আম‍াদের কোনো ভর্তি পরীক্ষা নেয়ারই প্রয়োজন ছিল না। যেহেতু আমরা এইচএসসি পরীক্ষাটুকুর উপর পুরোপুরি নির্ভর করতে পারিনা, তাই সেই এইচএসসির বিষয়গুলোরই নতুন করে নিজেদের মতো করে পরীক্ষা নিই। কাজেই সম্মিলত ভর্তি পরীক্ষার মূল ধারণাটি হচ্ছে এইচএসসি পর্যায়ের প্রয়োজনীয় বিষয়গুলোর পরীক্ষা নিয়ে নেয়া।

‍তারপর যে বিশ্ববিদ্যালয় যে বিষয়ে মার্কস যেভাবে ব্যবহার করতে চায়, তাদের সেভাবে ব্যবহার করতে দিয়ে মেধা তালিকা তৈরি করে দেয়া হবে। এক সময় এটা খুব কঠিন ব্যাপার ছিল, কম্পিউটারের কারণে এখন এটা পানির মতো সহজ।

এটি যুগান্তকারী নতুন কোনো ধারণা নয়। SAT বা GRE তে ঠিক এরকমভাবেই পরীক্ষা নেয়া হয়। আমাদের একটা বাড়তি সুবিধ‍া রয়েছে টেলিটক মোবাইল টেলিফোনের কারণে ছাত্র-ছাত্রীদের এসএসসি বা এইচএসসির মার্কসগুলো সরাসরি পেয়ে যাই। যে বিশ্ববিদ্যালয় যেভাবে এ মার্কস ব্যবহার করতে চায়, তারা সেটি করতে পারবে। (আমাদের বিশ্ববিদালয় থেকে প্রথম যখন শুধু একটি এসএমএস দিয়ে রেজিস্ট্রেশনের মাধ্যমে পুরো প্রক্রিয়া শেষ করার পরিকল্পনা করেছিলাম তখন বনেদি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আমাদের অনেকরকম ভয়-ভীতি দেখিয়েছিল। এখন দেখি তারাও অনেকের সঙ্গে এই পদ্ধতি ব্যবহার করে যাচ্ছে।

একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় একসাথে পরীক্ষা নেয়ার একটা বড় সুবিধে হচ্ছে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন তৈরি করার সময় শুধু একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সহযোগিতা নিয়ে খুশি থাকতে হবে না। দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা বসে প্রশ্ন তৈরি করতে পারবেন। সে জন্য হয়তো তাদের দু’একদিন একসাথে বসতে হবে। কিন্তু কোনো শিক্ষকরাই সেটা করতে আপত্তি করবেন না।
 
এই পদ্ধতিটি গ্রহণ করা হলে সবচেয়ে বড় লাভ হবে ছাত্র-ছাত্রীদের। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে সারাদেশ থেকে ছাত্র-ছাত্রীরা পড়তে আসে, যার অর্থ সারাদেশ থেকে ছাত্র-ছাত্রীদের ভর্তি পরীক্ষা দিতে আসতে হয়। এবছর তাদের কষ্ট অনেক কমে যাবে। সেই উত্তর বঙ্গের ছাত্র-ছাত্রীদের কষ্ট করে সিলেট আসতে হবে না। তারা কাছাকাছি যশোর ক্যাম্পাসেই পরীক্ষা দিয়ে দিতে পারবে। ঠিক সে রকম সিলেট এলাকার কোনো ছাত্র-ছাত্রী যদি যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে চায়, তাকে আর কষ্ট করে যশোর যেতে হবে না, তারা সিলেটে বসে ভর্তি পরীক্ষা দিতে পারবে। একই প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা দিয়ে দুটো বিশ্ববিদ্যালয়ের যে কোনো বিভাগের জন্য বিবেচিত হতে পারবে।

আমাদের এই দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার তারিখ নভেম্বরের শেষে (৩০ নভেম্বর)। কিন্তু রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে। আমাদের তরুণ শিক্ষকরা সবকিছু গুছিয়ে রেখেছে। আমরা ইচ্ছে করলেই নেটে দেখতে পারি কতোজন এখন পর্যন্ত এই দুটো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিতে রেজিস্ট্রেশন করেছ। রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়া শেষ হতে এখনো কয়েক সপ্তাহ বাকি।

এর মাঝে আমরা দেখতে পাচ্ছি প্রতি দশজনের মধ্যে একজন ঠিক করেছে যশোরে বসে সিলেটের জন্য কিংবা সিলেটে বসে যশোরের জন্য ভর্তি পরীক্ষা দেবে। যার অর্থ ভর্তি পরীক্ষার সময় বিপুল সংখ্যক পরীক্ষার্থী আর তাদের অভিভাবকদের দেশের এক মাথা থেকে অন্য মাথায় না ঘুমিয়ে, না খেয়ে, না বিশ্রাম নিয়ে আসতে হবে না। ভবিষ্যতে যদি আমাদের এই উদ্যোগের সঙ্গে আরও বিশ্ববিদ্যালয় যোগ দেয় তাহলে কী চমৎকার একটা ঘটনাই না ঘটবে।

২.
আমাদের বিশ্বাস আমরা যে উদ্যোগটি নিয়েছি বেশ গুরুত্বপূর্ণ একটি উদ্যোগ। একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় মিলে যে একটি ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে ছাত্রছাত্রীদের ভোগান্তি কমানো সম্ভব সেটি হয়তো এবার প্রমাণ করা যাবে। অবশ্য এটি নতুন করে প্রমাণ করার কিছু নেই। মেডিকেলের ভর্তি পরীক্ষায় বহুদিন থেকে এটি করা হচ্ছে।

শুধু যে মেডিকেল কলেজের জন্য এটি করা হয় তা নয়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ও প্রতি বছর সারা দেশের অসংখ্য কলেজে তিন চার লাখ ছাত্র-ছাত্রীদের ভর্তি পরীক্ষা নেয়। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমরা একবার জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করার সুযোগ পেয়েছিলাম। তখন আমি সরাসরি নিজের চোখে এই বিশাল কর্মযজ্ঞটি দেখার সুযোগ পেয়েছিলাম। দীর্ঘদিন থেকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় দক্ষতার সঙ্গে এই পরীক্ষাটি চালিয়ে আসছে। যার অর্থ বাংলাদেশের সব কয়টি বিশ্ববিদ্যালয় মিলে একটি ভর্তি পরীক্ষা নিতে হলে যে কাজগুলো করতে হবে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতি বছর নীরবে এই কাজগুলো করে আসছে।

অথচ মজার ব্যাপার হলো আমাদের দেশের সংবাদমাধ্যম কখনোই এই বিশাল প্রক্রিয়াটি দেশের মানুষের নজরে আনেনি। কোনো একটা অজ্ঞাত কারণে আমাদের দেশের সংবাদমাধ্যম খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের নেতিবাচক খবরগুলো বের করে সেটা ফলাও করে প্রচার করতে পছন্দ করে। তাদের সত্যিকারের ইতিবাচক সংবাদটিও কাউকে জানাতে আগ্রহী হয় না।

আরও মজার ব্যাপার হলো, দেশের হাইফাই ইউনিভার্সিটির হাইফাই গ্রাজুয়েটদের প্রায় সবাই কিন্তু দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে, দেশ চালাচ্ছে কিন্তু জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রাজুয়েটরা। অথচ সংবাদমাধ্যমের এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য কোনো সমবেদনা নেই। কোনো মমতা নেই। আমাদের জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশাল সংখ্যক ছাত্র-ছাত্রী পড়াশোনা করে, দেশের সরকার যদি এই বিশ্ববিদ্যালয়টিকে একটু গুরুত্ব দিয়ে তাদের সমস্যাগুলো মিটিয়ে দিতে আগ্রহী হতো, তাহলে পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোর নয় আমার নিজের দেশের অনেক উপকার হতো।  

৩.
বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষা মানেই সব সমস্যার সমাধান নয়। দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অল্প কিছু আসন। পরিক্ষার্থী অসংখ্য। তাই বেশিরভাগ ছাত্র-ছাত্রীই আসলে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পায় না। জিপিএ ফাইভ পাওয়া অনেক ছাত্র-ছাত্রী যখন আবিষ্কার করে ভর্তি পরীক্ষার মেধা তালিকায় তাদের নাম নেই, তখন তারা একটা অনেক বড় ধাক্কা খায়। যে আত্মবিশ্বাস নিয়ে তারা এতোদিন লেখাপড়া করে আসছে, ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখে আসছে, হঠাৎ করে তাদের আত্মবিশ্বাস ধূলিস্মাৎ হয়ে যায়, স্বপ্ন খান খান হয়ে যায়।

আমি এই ছাত্র-ছাত্রীদের বলতে চাই, সবসময়ই কিন্তু এর জন্য তারা নিজেরা দায়ী নয়। এই দেশের অনেক নামিদামি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রশ্নই খুব নিম্নমানের। অনেক সময়ই মেধা তালিকায় ভালো করা আর লটারিতে নাম ওঠার মাঝে কোনো পার্থক্য নেই। হাইকোর্ট থেকে একবার আমাকে খুব বড় একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন একটা ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে মতামত দেয়ার জন্য ডেকেছিলো। আমার তখন সেই ইউনিটের প্রশ্নগুলো দেখার সুযোগ হয়েছিলো। আইনজীবীরা কোন প্রশ্নটি কোথা থেকে নেওয়া হয়েছে সেটা খুঁজে খুঁজে বের করে দাখিল করছিলেন এবং আমি এক ধরনের আতঙ্ক নিয়ে আবিষ্কার করছিলাম সেই ভর্তি পরীক্ষার প্রতিটি প্রশ্নই কোনো না কোনো গাইড বই থেকে নেওয়া।

কাজেই ভর্তি পরীক্ষার মেধা তালিকায় ছাত্র-ছাত্রীরা নিজেদের নাম খুঁজে না পেলে তারা যেনো মন খারাপ না করে, নিজের ওপর বিশ্বাস যেনো না হারায়। সবসময়ই সেটি মেধার অভাব নয়, অনেক সময় সেটি সঠিক গাইড বই মুখস্থ করার ইচ্ছের অভাবেও হতে পারে। এই দেশে যে ভর্তি কোচিংয়ের বিশাল একটা রমরমা ব্যবসা হতে থাকে তার একমাত্র কারণ আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় মুখস্থনির্ভর গাইড বইয়ের প্রশ্ন।

৪.
আমি মনে করি আমাদের সময় হয়েছে অন্তত বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ছাত্রছাত্রীদের সত্যিকারের সম্মিলিত একটি ভর্তি পরীক্ষা উপহার দেওয়ার। নিঃসন্দেহে তার আগে অনেকগুলো বাধা পার হয়ে আসতে হবে। কিছু কিছু বাধা হয়তো বেশ জটিল মনে হতে পারে। প্রায় দুঃসাধ্যও।

কিন্তু এ দেশের নতুন প্রজন্মের দিকে তাকিয়ে আমরা যদি সিদ্ধান্তটি নেই, তাহলে এ দেশের সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল শিক্ষক মিলে নিশ্চয়ই সব বাধা অতিক্রম করতে পারব। কিন্তু সিদ্ধান্তটি নিতে হবে।

যদি সেই সিদ্ধান্তটি নিতে না পারি তাহলে নতুন প্রজন্ম আমাদের ক্ষমা করবে না। আর সংবাদ মাধ্যম যদি ভর্তি প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার পর আমাদের ব্যাংক ব্যালেন্স কতোটুকু বেড়ে যায় সেই তথ্যটি প্রকাশ করে দেয়, তাহলে আমরা দেশের মানুষের সামনে লজ্জায় মুখও দেখাতে পারব না!

আমাদেরই ঠিক করতে হবে আমরা কী চাই।

মুহম্মদ জাফর ইকবাল: লেখক, কলামিস্ট, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক

বাংলাদেশ সময়: ০০০১ ঘণ্টা, অক্টোবর ১১, ২০১৩
এএ/এমজেডআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।