ঢাকা, মঙ্গলবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

কর্মসংস্থানে পিছিয়ে নেই কৃষক বধূরাও

লিয়াকত হোসেন খোকন, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০৩৬ ঘণ্টা, অক্টোবর ২০, ২০১৩
কর্মসংস্থানে পিছিয়ে নেই কৃষক বধূরাও

ঢাকা: কৃষক পরিবারের দ‍ারিদ্র বিমোচনে ঋণ দিয়ে কর্মসংস্থান কিংবা বাড়তি আয়ের ব্যবস্থার পথ দেখাচ্ছে কোনো কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠান। এজন্য দেশে দিন দিন কমছে দারিদ্রের হার।



কুমিল্লা শহরের পার্শ্ববর্তী এলাকা পাঁচথুবি পশ্চিম পাড়ায় গিয়ে সরেজমিন দেখা যায়, ওই গাঁয়েরই কয়েকজন মহিলা গড়ে তুলেছেন মহিলা সমিতি। মহিলা সমিতির সভানেত্রী জাহানারা বেগম জানালেন, সমিতির সদস্যদের মধ্যে কেউ করছেন সেলাইয়ের কাজ, কেউ বা সবজি আবাদ, গরু মোটাতাজাকরণ, হাঁস-মুরগি পালন কিংবা অন্য কোনো কাজ।

তারা কোনো না কোনো উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত হয়ে ফিরে পেয়েছেন সচ্ছল জীবন। অথচ একসময় তাদের ছিল দরিদ্র জীবন। কত যে ছিল দুঃখ-কষ্ট। সবই দূর হয়েছে আজ। পুরুষের পাশাপাশি বিভিন্ন কৃষিকাজসহ উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে সংসারে বাড়তি আয়ের ব্যবস্থা করতে পেরেছেন তারা।

জাহানারা বেগম জানান এক সময় আমি তো করেছি গরু মোটাতাজাকরণ কাজটি। দুই ঈদ এলেই গরু বিক্রি করে দিই। তিন থেকে চার মাস পর্যন্ত গরু পালন করি। গত ঈদে দুটি গরু বিক্রি থেকে লাভ পেয়েছিলাম ৮০ হাজার টাকা।

পাকা ঘরটি দেখিয়ে জাহানারা বেগম জানালেন, গরু মোটাতাজাকরণ কাজটি করে লাভের টাকা দিয়ে এই পাকা ঘরটি করেছি। আগে তো আমার ছিল ছনের ঘর। সেই অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে আজ। ফিরে পেয়েছি সচ্ছল জীবন।

আরেক সদস্য মর্জিনা বেগম জানালেন, সেলাই মেশিনে মেয়েদের বিভিন্ন জামা-কাপড় তৈরি করার জন্য নিয়মিত অর্ডার আসছে। সেজন্য আয় হচ্ছে বেশ ভালোই। প্রতি মাসে লাভ থাকছে ৫ থেকে ৬ হাজার টাকা। সেলাই মেশিন যখন ছিল না তখন দিন পার করতে হতো বড়ই কষ্টে। সেই কষ্টের দিন আজ আর নেই, ভালোই আছি এখন এই সেলাই মেশিন নিয়ে।

পাঁচথুবি পশ্চিম পাড়ার হনুফা বেগম, হাসিনা বেগম, শিরিন বেগম, জ্যোত্স্না বেগম প্রমুখও পল্লী দারিদ্র্ বিমোচন ফাউন্ডেশন থেকে ঋণ নিয়ে কেউ ফার্নিচার, মুদি নয়তো অন্য কোনো দোকান দিয়ে রোজগার করেছেন এখন।

এভাবেই পল্লী দারিদ্র বিমোচন ফাউন্ডেশনের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে গ্রামের সাধারণ মহিলারা কোনো না কোনো কাজের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন। দিন বদলের এই কর্মসূচিকে কঠোর শ্রম দিয়ে তারা দ্রুত লাভবান হচ্ছেন এবং প্রতিষ্ঠিত হচ্ছেন সমাজে।

অতীতের সেই দরিদ্র্ জীবন থেকে তারাও মুক্তি পাচ্ছেন। ঋণদানের কর্মসূচি দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়লে অচিরেই দূর করা সম্ভব হবে দারিদ্র। তবে তাদের সবার একটাই দাবি, ঋণের পরিমাণ বাড়াতে হবে আরও। যতই ঋণ বাড়বে ততই দ্রুত দারিদ্র দূর করা সম্ভব।

তাই সরকারের পল্লী দারিদ্র বিমোচন ফাউন্ডেশনসহ অন্যান্য সরকারি প্রতিষ্ঠান দেশের সর্বত্র দরিদ্রদের মধ্যে ঋণ প্রদান কর্মসূচি অব্যাহত রেখে দেশ থেকে অচিরেই দারিদ্র দূর করবে- এটাই যে এখন দেখার প্রত্যাশায়।
দারিদ্র দূর করা আজ এমন কোনো কঠিন কাজ নয়।

পল্লী দারিদ্র বিমোচন ফাউন্ডেশন দেশের বিভিন্ন এলাকায় দরিদ্রদের খুঁজে বের করে ঋণ দিয়ে কোনো না কোনো কাজে উত্সাহ দেয়ার কারণেই গ্রামের চিত্র পাল্টে যাচ্ছে দিন দিন। এদিকে দারিদ্র জয়ের দৃষ্টান্তের অভাব নেই।

সম্প্রতি কুমিল্লা শহর থেকে ১০ কিলোমিটার দক্ষিণে প্রতাপপুর গাঁয়ে গিয়ে অবাক হতেই হলো। একসময় যাদের অবস্থা ছিল খুবই খারাপ তারাও ঋণ নিয়ে গাভী পালন, মাছ চাষ, সবজি চাষ, সেলাইয়ের কাজ নয়তো অন্য কোনো কাজে সম্পৃক্ত হয়ে সচ্ছলতার পথ খুঁজে পেয়েছেন। গ্রামে গ্রামে গড়ে উঠেছে মহিলা সমিতি।

প্রতাপপুর মহিলা সমিতির সদস্য সংখ্যা ১৭ জন। এরা সবাই আজ সচ্ছল হয়েছেন। তারা জয় করেছেন দারিদ্রকে। সমিতির সভানেত্রী বিউটি আক্তার জানালেন, কুমিল্লায় পল্লী দারিদ্র বিমোচন ফাউন্ডেশনের ঋণ নিয়ে এ সময় লেয়ার অর্থা‍ৎ ডিম পাড়া মুরগির খামার স্থাপন করেছি। অবশ্য এ কাজটি করেছি দু’জনে মিলে।

অপরজন হলেন প্রতিবেশী তাসলিমা। দু’জনই আজ দূর করেছেন নিজ নিজ সংসারের অভাব-অনটন। মুরগির ডিম বিক্রি করে প্রতি মাসে তার লাভ থাকছে ১৫ হাজার টাকা। তাসলিমারও লাভ হচ্ছে ১৫ হাজার টাকা। এছাড়া মাছ চাষ করে, মাছ বিক্রি থেকে কিংবা সেলাইয়ের কাজ করেও তাসলিমা প্রতি মাসে উপার্জন করছেন প্রায় ১০ হাজার টাকা।

প্রতাপপুর মহিলা সমিতির অপর ১৫ সদস্যের মধ্যে প্রত্যেকেই সবজি বাগান করেছেন, কলার চাষ, মাছ চাষ ছাড়াও করেছেন গাভী পালন। সদস্য জরিনা আক্তার জানালেন, চারটি গাভী পালন করে প্রতিদিন পাচ্ছেন ১৩ কেজি দুধ। গাভী পালনের খরচ বাদ দিয়ে প্রতি মাসে গাভীর দুধ বিক্রি থেকে লাভ থাকছে ১২ হাজার টাকা।
সত্যিই অবাক হতে হলো প্রতাপপুরের পার্শ্ববর্তী গাঁও শ্রীমন্তপুরে গিয়েও। ওখানেও ১৭ জন মহিলা সদস্য গড়েছেন মহিলা সমিতি। তারাও পল্লী দারিদ্র্যবিমোচন ফাউন্ডেশনের কর্মীদের সহযোগিতা ও ঋণ পেয়ে মাছ চাষ, গাভী পালন, গরু মোটাতাজাকরণ কর্মসূচি হাতে নিয়ে দেখেছেন সাফল্যের মুখ।

একসময় দারিদ্র ছিলেন খুরশিদ, কোহিনুর, রাজিয়া, জহুরা এবং আরো অনেকের। এরা সবাই গাভী পালন, মাছ চাষ, সবজি চাষের মাধ্যমে আজ আয় রোজগার বাড়িয়ে পাকা বাড়ি করেছেন, কিনেছেন ধানি জমি।

এক সময় তাদের ছিল বড়ই অভাব। আজ সেই দুর্দিন তাদের জীবন থেকে কেটে গেছে। দেশের সর্বত্র এভাবে ঋণ কিংবা উত্সাহ ও সহযোগিতা প্রদান করে দরিদ্রদের সচ্ছল করার উদ্যোগ নেয়া হলে দেশ থেকে দারিদ্র দূর করা সম্ভব।

বাড়ছে মাছের উত্পাদন
কুমিল্লা জেলার চান্দিনা উপজেলা থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে মুরাদপুর গ্রাম। ওই গ্রামে রয়েছে ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় দেড়শ’ পুকুর। এর প্রতিটিতেই এখন চলছে মাছ চাষ। দরিদ্র পরিবারের বিশেষ করে মহিলারা এখন পুরুষের পাশাপাশি করছেন মাছ চাষও।

মাছ চাষ শুধু সীমাবদ্ধ থাকেনি পুকুরের মধ্যে। এর বিস্তৃতি ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্ব রোডের দুই পাশে মুক্ত জলাশয়ে ও কুমিল্লার বিভিন্ন বিলাঞ্চলেও। মাছ চাষে দরিদ্র জনসাধারণসহ সব শ্রেণির মানুষকে উত্সাহিত করেছে পল্লী দারিদ্র্য বিমোচন ফাউন্ডেশনের কর্মীরা।

কুমিল্লারই মুরাদপুরে গড়ে উঠেছে মহিলা সমিতি। এই সমিতির সভানেত্রী মিনারা বেগম জানালেন, মাছ চাষে এক অসাধারণ বিপ্লব ঘটিয়েছে এই কুমিল্লা জেলার প্রতিটি উপজেলায়।

ব্যাপকভাবে মাছ চাষ বৃদ্ধি পাওয়ায় এখন আর মাছের অভাব নেই। দরিদ্ররাও প্রতি জেলায় এখন মাছ খাওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন। মাছে-ভাতে বাঙালির সেই বাস্তব চিত্র ফুটে উঠেছে এই কুমিল্লার সর্বত্রই- গাঁও-গ্রামে।

তিনি আরও জানান, প্রায় প্রতিটি বাড়িতে এখন চলছে সবজি চাষাবাদ। গরু মোটাতাজা করেও কেউ কেউ বেশ লাভবান হয়েছেন। কেউবা গরু মোটাতাজা করে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাও করে নিয়েছেন। প্রতি বছর দুই ঈদের ২ থেকে ৩ মাস আগে থেকে রুগ্ন হাড্ডিসার গরু কেনার ধূম  পড়ে যায়।

২টি গরু ৪০ হাজার টাকায় কিনে ২ মাস লালনপালন করে এক লাখ টাকায় বিক্রি করা যায় এখন। এই যে আমার প্রতিবেশী আয়েশা বেগম দেড় মাস আগে ২টি গরু ৬০ হাজার টাকা দিয়ে কিনেছেন। এখন এ দুটি বিক্রি থেকে তার আয় হবে ১ লাখ টাকার ওপরে।

মাছ ধরার চাঁই তৈরি করে প্রতি মাসে ১৫ হাজার টাকা লাভ করছেন মুরাদপুর গাঁয়েরই খোরশেদা বেগম। তিনি জানালেন, দৈনিক ১০টি মাছ ধরার চাঁই বানাতে পারি এবং তাই-ই করছি। একেকটি চাঁই ১০০ থেকে ১২০ টাকায় বিক্রি করি। একটি চাঁই তৈরিতে খরচ পড়ে ৩০ থেকে ৩৫ টাকা। বাকি টাকা লাভ থাকে। চাঁই বানানোর কাজে আমাকে সহযোগিতা করে থাকেন আমার স্বামী কবির হোসেন।

চাঁই তৈরির কাজে বাঁশ, বেত ও প্লাস্টিক লাগে। এসব সামগ্রী কেনার জন্য পল্লী দারিদ্র্যবিমোচন ফাউন্ডেশন থেকে ঋণও নিয়েছি। ঋণ পাওয়ায় আমাদের বেশ সুবিধাও হয়েছে। বাড়ি বাড়ি এসে কেউবা চাঁই কিনে নিয়ে যাচ্ছে। এ ধরনের চাঁই দিয়ে ক্রেতারা ছোট-মাঝারি সব ধরনের মাছ ধরছেন। চাঁইভরা মাছ পেলে তা ৪০০ থেকে ৫০০ টাকায় বিক্রি করাও সম্ভব।

খোরশেদা বেগম আরও জানালেন, চাঁই বানানোর কাজ শিখেছি বাবা-মায়ের কাছে। তখন বাবার বাড়ি রসুলপুরে থাকতাম। স্বামীর সংসারে এলেও চাঁই তৈরি করছি, চাঁই তৈরি করে বেশ আনন্দ-অনুভব করি। কেননা চাঁই দিয়ে মাছ ধরা যায়, আর সেই মাছ তো আমরাই খাচ্ছি।

মুরাদপুর গ্রামের মহিলা সমিতির সভানেত্রী মিনারা বেগম জানালেন, ২৭ সদস্য নিয়ে আমাদের সমিতি। সকালেই মাছ চাষের সঙ্গে জড়িত। এক সময় কুমিল্লায় মাছের বেশ অভাব ছিল। সেই দিন এখন আর নেই। গ্রামের সবার মধ্যে বেশ সচেতনতা বোধ জেগেছে।

‘হাজামজা পুকুর ফেলে রাখা যাবে না। ’ সেজন্য সর্বত্রই প্রতিটি ছোট-বড় পুকুর, দীঘি, জলাশয় ও বিলাঞ্চল এসেছে মাছ চাষের আওতায়। ব্যাপকভাবে মাছ চাষ করার কারণে কুমিল্লার সর্বত্রই জলাশয়ে উত্পাদিত হচ্ছে রুই, কই, সিলভার কার্প, তেলাপিয়া, মিরের কার্প, পাঙ্গাশ, চিংড়ি কত কী মাছ! যা কিনা কুমিল্লাসহ এর নামে পাশের সর্বত্রই মাছের চাহিদা পূরণে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে।

কুমিল্লা জেলায় আজ মাছ চাষে যে বিপ্লব ঘটেছে, তা প্রশংসনীয় বটে। তবে দেশের সর্বত্র যদি এভাবে পুকুর, দীঘি, মুক্ত জলাশয়ে মাছ চাষের বিস্তৃতি ঘটত তাহলে মাছে-ভাতে বাঙালির সেই সুদিন ও ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনা সম্ভব।

বাংলাদেশ সময়: ১০৩৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ২০, ২০১৩,
এসএস/জিসিপি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।