ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

আত্মহত্যার সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যাকরণ

রাজীব মীর, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪৫৭ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৬, ২০১৪
আত্মহত্যার সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যাকরণ

আজ জানুয়ারি ৬। অলকের বহু শিক্ষার্থী ও শুভাকাঙ্ক্ষীর কষ্টের দিন, পরিবারের বেদনার বিষে আক্রান্ত হওয়ার দিন।

বছর কয়েক আগে এদিন তিনি আত্মহত্যা করেছিলেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও  সাংবাদিকতা বিভাগের সহকারি অধ্যাপক ড. অ্যান্ড্রু অলক দেওয়ারী চিত্তে বড় অস্থির ছিলেন, তাঁকে অস্থির করে রাখাও হয়েছিলো। বিয়ে ও সামাজিক মর্যাদা ঘিরে পারিবারিক চাপ তাকে সর্বক্ষণ তাড়িয়ে বেড়াতো। বিভাগের প্রভাবশালী কিছু সহকর্মী তিনি যে পরীক্ষা কমিটির দায়িত্ব নিতে অক্ষমতা প্রকাশ করতেন, সেখানে থাকতেই তাকে বাধ্য করতেন ও পরে হেসে কুটিকুটি হতেন। সকল যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও একটা প্লানিং মিটিং ডেকে তাকে সহজেই সহযোগী অধ্যাপক পদে উন্নীত করা যেত, কিন্তু নিয়মের বেড়াজালে ফেলে হিংসার অনলে তাকে পুড়িয়ে মারা হয়েছে। সহকর্মীদের আঞ্চলিকতার অহংকার আর তীব্র বিদ্বেষপ্রসূত বাক্যবান সংখ্যালঘু হিসেবে তাকে বেঁচে থাকতে বাধা দিয়েছিলো, তাই হাজার হাজার মানুষকে কাঁদিয়ে তিনি নিজ দায়িত্বে মরবার কাজটি সুইসাইড নোট লিখে সুচারুভাবে সম্পন্ন করেছিলেন।

তখন আমি বিভাগটির চেয়ারের দায়িত্বে, তাই ঝাপসা চোখে আইন, লাশকাটা ঘর আর বিবেকের আমলাতান্ত্রিক সংঘর্ষে অদ্ভুত এক যাতনায় দিনাতিপাত করেছি। মনে আছে তাঁর মৃত্যুর কিছুদিন আগে বিমানবন্দরে পৌঁছে দেয়ার সময় বিভাগের পরীক্ষার কাজে বহিঃ পরীক্ষক হয়ে আসা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান  উপাচার্য ড. আরেফিন সিদ্দিকীর কাছে অলকদার অনুরোধ, স্যার প্লিজ, আজগরকে একটু বলে দিন আমি এ কমিটিতে থাকবো না। কী হয়েছিলো মনে নেই, তবে এটুকু মনে আছে, আত্মহত্যার অব্যবহিত পূর্বসময়ে আরেফিন স্যারের প্রতি দাদার তীব্র অভিমান জন্মেছিলো। স্যার বেশি কথা বলেন না, অসাধারণ মানুষ, নিঃসন্দেহে। পোস্টমর্টেমের পর চট্টগ্রাম থেকে লাশ গ্রামের বাড়ি বরিশালে নেওয়ার পথে সংসদভবন চত্বরে দেখতে এসে  লাশের প্রহরি বিভাগের কোন এক শিক্ষককে বলেই ফেললেন, অলককে মেরেই ফেললে! অন্তত বাংলাদেশের সাংবাদিকতা জগতের শিক্ষার্থীরা সকলেই জানেন, অভিভাবকত্ব আর ব্যক্তিত্বের সমন্বিত গুণে অধ্যাপক আরেফিন সিদ্দিক কতটা অবিশ্বাস্যরকমের নির্ভরযোগ্য ও বিশ্বাসযোগ্য। কিন্তু অত্যধিক কাজের চাপে হয়তো অলকদার অভিমানী মনের অনেকটা ব্যথা স্যারও আন্দাজ করতে সক্ষম হননি।

সে যাই হোক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে পড়াকালীন আরেক অদ্ভুত আত্মহত্যাজনিত প্রচেষ্টা বেশ আলোড়ন তুললো। বিভাগের এক নতুন শিক্ষক সারা ঢাকায় অভিজাত ধরনের দড়ি বা রশি সংগ্রহ করে বেড়াচ্ছেন, আত্মহত্যা করবেন বলে। সবচে দামি ও সুদৃশ্য সে রশির খোঁজে তার চোখে ঘুম নেই। না তিনি ঘুমান, না আমরা! অবশেষে তৌহিদুল আনোয়ার স্যারের হস্তক্ষেপে অদ্ভুত এক রোমান্টিক জীবনযাপনের মধ্য দিয়ে তিনি আজও বেঁচে আছেন, হাজার রকম কাজও করছেন!

সম্প্রতি এক বারবনিতার প্রেমের পাল্লায় পড়ে আমারও অদ্ভুত অভিমান হয়েছিলো, মরবার ইচ্ছে হয়েছিলো। রোবায়েত ফেরদৌস বলেছিলো, জীবনের ক্যানভাস অনেক বড়, অনেক কাজ করবার আছে, মরবেন না প্লিজ! সারাজীবনের প্রিয়তম মেয়ে বন্ধুটি বলেছিলো, তোমাকে মরতে নেই! মরিনি, আর।

রাজনৈতিক বন্ধে ভোলায় নিজ বাড়িতে বেড়াতে গেলাম। শুনতে পেলাম, সবচে সংস্কৃতিবান মেয়ে বন্ধুটি আত্মহত্যার প্রচেষ্টাকালে মাঝপথে পাড়াপড়শি তাকে   উদ্বার করেছে। তার হাতের লেখা অপূর্ব, সে অত্যন্ত প্রগতিশীল, দেখতেও দারুণ। সে কেন মরতে চাইবে? ধর্মান্ধ সমাজ ও পরিবার তার চলাফেরা ও গতিবিধিকে প্রতিনিয়ত দোষারোপ করছে, সে সেই চাপ আর  নিতে পারছে না! আমি বললাম, মরার আগে ভাবলি না, তোকে সমর্থন করে এমন একজন আমি তো এখনও আছি!

নদীর তীব্র বাতাস আর তাজা মাছের স্বাদ নিয়ে ঢাকায় ফিরে বন্ধুর সাথে দেখা করবো বলে ফোন দিলাম, সে কাঁদছে! তাঁর নামী ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের অত্যন্ত কড়া শিক্ষকের ছেলে অরণ্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আত্মহত্যা করেছে। খুব বিনয়ী ও মেধাবী অরণ্য তার পরিবারের উচ্চাশা পূরণ করতে গিয়ে পরীক্ষায় আশানুরূপ ফল করতে পারছিলো না। মাঝে সাইকোলজিস্টের পরামর্শে দেশে এসে ঘুরে যাওযার সময় মাকে বলেছে, সে আর ওখানে যেতে চায় না। তাকে যেতে বাধ্য করা হয়েছিলো; সে নিজে নিজে চিরতরে চলে গেলো। তার মা কাঁদছে আর বলছে, ওরে অরণ্য! আয় তোকে শিখিয়ে দেই, কিভাবে বেঁচে থাকতে হয়। এ কাজ নিজে নিজে করতে নেই, এ কাজ তোর নিজের নয় রে, বাবা!

কাজটি তাহলে কার? কে নির্দেশ দিচ্ছে, কে মরছে, কেন মরছে! কে দায় নেবে এসকল হত্যার!! দেশে যে হারে বোমাবাজি আর ককটেল ফুটছে, কেউ এর প্রত্যক্ষ শিকার হচ্ছে, হাত পা আর জীবন হারাচ্ছে আবার কেউ আতংকে বেঁচে থেকেই মরছে। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে গত চল্লিশ দিনে ১২৩ জন প্রাণ হারিয়েছে। ১১১ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আগুন দিয়েছে নির্বাচনবিরোধীরা। হত্যাকারীগণ কি অজানা অচেনা! যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রক্রিয়া বানচালের জন্য জামাত শিবির পরিকল্পিত হত্যা ও বোমাবাজির মতো সহিংসতার ঘটনা ঘটাচ্ছে। এটা কি তবে সহিংসতার মাধ্যমে রাজনৈতিক  আত্মহত্যা নয়!

আত্মহত্যা মানবজাতির একটা বিশেষ সমস্যা। অন্য যে কোনো প্রাণি কোনো রোগে বা অন্য কোনো প্রাণির আঘাতে মারা যেতে পারে কিন্তু কেবল মানুষই একমাত্র প্রজাতি যে নিজে নিজের প্রাণ নাশ করতে পারে। আত্মহত্যা হচ্ছে যখন কোনো ব্যক্তি স্বেচ্ছায় তার নিজের জীবনাবসান ঘটায় অথবা সে উদ্দেশ্যে প্রচেষ্টা গ্রহণ করে অথবা যদি কোনো ব্যক্তির মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা থাকে। আসলে এটা ব্যক্তি বা দলের আচরণ যা তাদের ধ্বংস ডেকে আনে, সেদিকে তাদের পরিচালিত করে।

ভাবনার শুরু সেখান থেকেই, কেন এই আত্মহত্যা, কী সেই জীবন যন্ত্রণা যা জীবন মৃত্যুর সীমারেখাকে অতিক্রম করে পৌঁছে দেয় অন্য জগতে, যেখানে মৃত্যু হয় স্বাভাবিক।

বিখ্যাত ফরাসি দার্শনিক ও সমাজতাত্ত্বিক এমিল ডুর্কহাইম আত্মহত্যাকে তিনভাগে ভাগ করেন, (১) প্রযুক্তির উন্নতির সাথে সাথে সমাজবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ায় একাকীত্বের ভারে পীড়িত হয়ে  ব্যক্তি নিজের  জীবনের সঙ্গে যোগসূত্র হারিয়ে ফেলে, আসে আত্মহত্যা। (২) গোষ্ঠী, দল বা সমাজের স্বার্থে আত্মবলিদান করে ব্যক্তি এখানে আত্মতৃপ্তি পায়। প্রাচীনকালে জাপানে  সামুরাই নামের যোদ্ধাদের হারাকিরি প্রথায় আত্মহত্যা সুবিদিত। ঠিক যখন একজন সামুরাই মনে করতেন যে তার যোদ্ধাজীবনে নেমে এসেছে অসম্মান— তখনই তিনি কাঠের ধারারো ছুরি দিয়ে আত্মহত্যা করতেন। (৩) দিন বদলের সঙ্গে মানুষের চাহিদা, আশা আকাঙ্ক্ষা বাড়ছে, কিন্তু সমাজ যখন ব্যক্তির চাহিদা পূরণে অক্ষম হয় তখন আসে সমাজের প্রতি ক্ষোভ, এরই পরিণতিতে আসে আত্মহত্যা। এভাবে অহংবাদী ও অনন্বয়বাদী আত্মহত্যা একে অপরকে শক্তিশালীও করে।

কিন্তু আত্মহত্যার প্রতিকার আজ আর অসম্ভব নয়। চাই গণ সচেতনতা, গবেষণা আর মানুষের প্রতি সহানুভূতি— একটু সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়ার প্রবণতা। আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের বন্ধু রবীন তখন প্রেমিকা হারানোর বেদনায় আত্মহত্যার উদ্দেশ্যে অনেকগুলো ঘুমের বড়ি গিলেছিলো, আমি আর সলিমুল্লা হলের হলসুদ্ধ ছাত্রদের নিরলস প্রচেষ্টায় সে যাত্রা  রক্ষা পেয়েছিলো। আজ সে বিমানবাহিনীর অনেক বড় অফিসার, বিদেশে স্ত্রী সন্তান নিয়ে বেশ কাটাচ্ছে। আমার আরেক বন্ধু আবু নাসের রাজীব, ইংল্যান্ড  থেকে পড়াশোনা শেষে দেশে ফিরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জার্নালে একটা নিবন্ধ ছাপতে পারেনি, তার নিজের সম্মানিত শিক্ষক রিভিউ রিপোর্ট দিতে অযথা গড়িমশি করছিলেন। পিএইচডি ডিগ্রি শেষ করে এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটা নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে  তিনি   শিক্ষকতা করছেন। রাগে ক্ষোভে দেশ ছেড়ে যাওয়ার আগে তার একটি লেখার শিরোনাম ছিলো, এ শহর অভিমান বোঝে না।

অলক বা অরণ্যের আত্মহত্যা কিংবা  বোমা ককটেল সহিংসতার প্রলয় ঘটিয়ে নিরপরাধ সাধারণ মানুষকে হত্যার মাধ্যমে যে রাজনৈতিক আত্মহত্যা, এসবের জন্য দায়ী প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ সামাজিক ও রাজনৈতিক কুশীলব  আমরা সবাই— ‘অই সকল আত্মার আর্তযন্ত্রণা এবং অভিমান  বুঝতে পারি তো!’

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ,জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

বাংলাদেশ সময়: ১৪১৪ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৬, ২০১৪
সম্পাদনা: তানিম কবির, বিভাগীয় সম্পাদক শিল্প-সাহিত্য

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।