সবাই যার পরশ পেতে চায় তার নাম শান্তি। কোন শান্তি প্রয়োজন? শারীরিক না মানসিক।
এই শান্তির ছোঁয়া পাওয়ার জন্য কিছু কিছু মানুষ ধন-সম্পত্তির পাহাড় গড়ে তুলেছেন। কেউবা ভোগ-বিলাসে মজে আছেন। কেউবা ক্ষমতায়নে ব্যস্ত আছেন। কেউবা জোর-জবর আর মরণ খেলায় মেতে আছেন। কেউবা অন্যের সুখ আর স্বপ্ন কেড়ে নেওয়ার মত জঘন্যতম পাপকর্মে সদা রমিত আছেন।
আসলে তারা কি শান্তির মুখ দেখেছেন? মজার ব্যাপার হল, যে ব্যক্তি সর্বদা অশান্তি সৃষ্টি করে সেও শান্তি চায়, শান্তিকে ভলোবাসে এবং শান্তির ভিখারি হতে চায়। অনেক পিতামাতা শখ করে তাদের সন্তানের নাম রাখেন শান্তি। জানি না তাদের দেখে কিংবা তাদের জীবন দর্শনে মানুষ শান্তি অনুভব করতে পারে কি না। এটাও জানি না যে সে নিজে কতটা শান্তি পেয়েছে।
সমাজে কিংবা দেশে এমনও মানুষ আছে যারা দামী দামী খাবার খায়, গাড়িতে চড়ে, বাড়িতে থাকে, অঢেল ধন-দৌলত, প্রভাব প্রতিপত্তি সম্পন্ন। তাদের দেখে যারা নিম্ন মানের জীবন যাপন করে তারা মনে করে পৃথিবীর সমস্ত সুখ শান্তি ওদের ঘিরে রেখেছে। তাদের আপসোস হয় এই শান্তি তাদের কপালে কেন ধরে না। অতিরিক্ত চাহিদা পূর্ণ করতে না পেরে অনেক সময় তারা অশান্তির অনলে দহন হতে থাকে। তারা অনেকটা পেট ভরে তবু চোখ ভরে না এই স্বভাবের হয়।
সত্যিকারের বিষয় হল, যাদের দেখলে তারা সুখী মনে করে আসলে তারা অনেকক্ষেত্রে ততটা সুখী নয়। ধরা যাক, স্বামী-স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে নিয়ে কোন একটি একক পরিবার রচিত হল। তাদের গাড়ি-বাড়ি, জমি-জমা, ধন-দৌলত সবই আছে। কিন্তু স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বনিবনা নেই। অথবা স্বামীর চরিত্র ভাল নয়, নতুবা স্ত্রীর চরিত্র ভাল নয়। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কোন খাদ নেই। উভয়ের মধ্যের মনের মিল আছে। দুজন দুজনকে খুব ভালবাসে। কিন্তু তাদের ছেলেটা একেবারে বাজে স্বভাবের। মাদকাসক্ত আর বখাটে। মায়ের গর্ভের সন্তান বটে কিন্তু গর্বের সন্তান নয়। অথবা মেয়েটি বিপদগামী হয়েছে। শাসনের বাইরে জীবনযাপন করছে। পিতামাতাকে সামাজিকভাবে হেয়প্রতিপন্ন করেছে। হয়তোবা পরিবারের কারো সাথে কারোর বনিবনা নেই। কে কখন আসে কখন যায়, কখন শোয়, কখন খায় তার কোন নিয়মনীতি নেই। অথচ সবাই একই ছাদের নিচে থাকে।
এবার একটি যৌথ পরিবারের কথা ধরা যাক। দাদা-দাদী, কাকা-কাকী, চাচা-চাচীর কথা বাদ দিলাম। স্রেফ ছেলের পিতামাতা অর্থাৎ ছেলের বউয়ের শ্বশুর-শাশুড়ির কথা বলা যাক। তার স্বামী নিজের পিতামাতার ভরণপোষণ করবে সেটা তার পছন্দ নয়। স্বামীর সেবা কিছুটা করতে পারলেও শ্বশুর-শাশুড়ির সেবা করা তার জন্য বাড়তি ঝামেলা। অথচ তার কোন ধরনের অভাব রাখা হয় না।
সংসারে এমনও কতো নারী আছে তারা নিজের স্বামীকে শুধু নিজের অধিকারের বস্তু বলে মনে করে। সে তার যেমন স্বামী তেমনি কারো সন্তান, কারো ভাই। তাদের প্রতিও যে তার দায়িত্ব কর্তব্য আছে তা সে বুঝতে নারাজ। কোন পরিবারে যদি একাধিক পুত্র সন্তান থাকে তাহলে তো আর কথাই নেই। জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে সে মনে করে তার সুখ ভাগ বাটোয়ারা হয়ে যাচ্ছে। সে কথায় কথায় অশান্তি সৃষ্টি করে। অথবা স্বামীর মা অর্থাৎ তার শ্বাশুড়ি খুব বজ্জাত স্বভাবের। কারণে-অকারণে শুধু পুত্রবধূর দোষ কুড়াতে ব্যস্ত থাকে। শত খেটেও কোন সুন্দর ব্যবহার পাওয়া যায় না। কখন ছেলেকে দিয়ে ছেলের বউকে পেটাবে সেই সুযোগের অপেক্ষায় থাকে। পাড়া পড়শির কাছে অযথা পুত্রবধূর বদনাম করে বেড়ায়। বউ-ছেলের মধ্যে অশান্তি সৃষ্টি করে দিতে পারলে খুব আনন্দ পায়। ছেলের বউ মাসে বিশ দিন বাপের বাড়িতে পড়ে থাকলে খুব খুশী হয়।
আর এক শ্রেণীর পরিবারআছে, যে পরিবারের স্বামী, স্ত্রী, ছেলে, মেয়ে সবাই চাকরিজীবী। সবাই যার যার রোজগার করতে সক্ষম। কেউ কারো উপর নির্ভরশীল নয়। তাই কেউ কারো শাসন মানতেও রাজী নয়। নিজ নিজ পূর্ণ স্বাধীনতায় ইচ্ছামাফিক জীবনযাপনে অভ্যস্ত। এই ধরনের পরিবারগুলোতে শান্তি থাকতে পারে কিনা? শান্তি পেতে হলে আগে নিজেকে শান্ত হতে হয়। অশান্তির জন্ম দেওয়া কোন ব্যক্তি কখনো শান্ত হতে পারে না। পারিবারিক শান্তির সাথে বিশ্বশান্তির যোগসূত্র কোথায়? আমি বলব, পরিবার থেকে শান্তি বিশ্ব পর্যন্ত গড়িয়েছে। যেমনি করে মনীষীরা বলেছিলেন-
‘ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বালিকণা, বিন্দু বিন্দু জল,
গড়ে তোলে মহাদেশ সাগর অতল। ’
বলতে চাই, কিছু পরিবারের সমষ্টিতে সমাজ সৃষ্টি হয়। সমাজের সমন্বয়ে গ্রাম রচিত হয়। কতগুলো গ্রামের সমষ্টিতে ইউনিয়ন গড়ে উঠে। ইউনিয়নের সমষ্টিতে রচিত হয় থানা। থানা থেকে জেলা, জেলা থেকে বিভাগ, বিভাগ থেকে দেশ, দেশ থেকে বিশ্ব। বাংলাদেশে ৮৫ হাজার গ্রাম নিয়ে ৬৪ জেলা গড়ে উঠেছে। ৬৪ জেলার সমষ্টির নাম প্রিয় বাংলাদেশ। প্রায় ১৬ কোটি মানুষের এই দেশে পরিবারের সংখ্যা অসংখ্য। এই পরিবারগুলো না থাকলে দেশের প্রয়োজন কোথায়? তাহলে আমরা যদি পরিবারগুলোকে পুড়িয়ে মাড়িয়ে দেশ গড়ার স্বপ্ন দেখি তা কি কখনো সম্ভব! একটি গ্রামের প্রতিটি পরিবারে যদি অশান্তি বিরাজ করে তাহলে পুরো গ্রামে অশান্তি বিরাজ করবে। একটি ইউনিয়ন, একটি থানা, একটি জেলা, একটি বিভাগের অধীনে বসবাসরত সিংহভাগ বা প্রতিটি পরিবারে অশান্তি বিরাজ করলে তাহলে পুরো জেলায় অশান্তি বিরাজ করবে। দেশের প্রত্যেকটি জেলায় যদি অশান্তি বিরাজ করে তাহলে গোটা দেশ অশান্তির দাবানলে জ্বলবে। আর বিশ্বের প্রত্যেকটি দেশে যদি অশান্তি বিরাজ করে তাহলে বিশ্বব্যাপী অশান্তি বিরাজ করবে।
তাই বলতে হয়, পারিবারিক শান্তিকে পায়ে দলে বিশ্বশান্তি কামনার কোন বালাই নাই। কারণ কামনা প্রার্থনায় মনের আশা যতটা সিদ্ধ করা যায় না তার চেয়ে বেশি পূর্ণ হয় কাজে কর্মে আর প্রচেষ্ঠায়। তৃণমূল পর্যায় থেকে গঠন করে নিতে পারলে একটি দল মাঠ পর্যায়ে এসে শক্তিশালী হয়ে উঠে। একইভাবে পারিবারিক স্তর থেকে শান্তি নিশ্চিত করা হলে দেশীয় শান্তি বজায় থাকবে। রাষ্ট্রীয় শান্তি বজায় থাকলে বিশ্বশান্তির পরশ পাওয়া কঠিন হবে না। তাই আমাদের সবার প্রাথমিক এব প্রধান কাজ হবে যার যার পারিবারিক শান্তি নিশ্চিত করা। অনেকের কাছে সংসার বলতে একজন পুরুষ এবং একজন নারীর মধ্যে দৈহিক স¤পর্ক গড়ার একটি পূর্ণ স্বাধীনতা মাত্র। তাদের সম্পর্কের হাত ধরে তাদের কোলে আসবে সন্তান-সন্ততি। এই হল অনেকের ঘরসংসার।
আমাদের দেশে একটি শব্দ সামাজিকভাবে বহুল ব্যবহ্নত এবং প্রচলিত হয়ে আসছে। মেয়ে উপযুক্ত হয়েছে, ছেলে উপযুক্ত হয়েছে। বিয়ে দিতে হবে, ঘরে বউ আনতে হবে। এখানে কোন দৃষ্টিকোণ থেকে ‘উপযুক্ত’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে! ফিজিক্যাল ফিটনেস বা শারীরিক গঠনটাকে একনাগাড়ে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। আমাদের দেশের প্রচলিত আইন অনুসারে একজন মেয়ের বয়স ১৮ বছর এবং একজন পুরুষের বয়স ২১ বছর হলে সে বিয়ের যোগ্যপাত্র/পাত্রী হতে পারে।
একটা বিষয় মোটেও গুরুত্ব পায় না যে বিয়ের উপযুক্ত হওয়া আর সংসারের উপযুক্ত হওয়া একই বিষয় নয়। যারা শুধু বিয়ের উপযুক্ত যোগ্যতা নিয়ে সংসার পাতে এবং পরিবার গড়ে তোলে সে পরিবারে কখনো শান্তি আসতে পারে না। সংসার পাতার ক্ষেত্রে একটি ছেলের স্বাস্থ্য, সম্পত্তি এবং কাজ করার ক্ষমতা এইটুকু যথেষ্ট। আর একটি মেয়ের ক্ষেত্রে তার শারীরিক ফিটনেস এবং একখানা আকর্ষণীয় চেহারা থাকলে যথেষ্ট হয়।
একটি সংসার রচনা করতে গিয়ে যখন কেবল এই বাহ্যিক গুনাবলী গুলো মূখ্য হয়ে দাড়াঁয়- পাত্র-পাত্রীর মন-মানসিকতা, সততা, আন্তরিকতা, চরিত্র, জ্ঞান, বিবেক, প্রজ্ঞা ইত্যাদি চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য গৌণ হয়ে যায় তখন পরিবার অশান্তির উৎসভূমি হওয়াটা স্বাভাবিক। তাই অনেকের বিয়ে হয় কিন্তু সংসার হয় না। সবাই একই ছাদের নিচে থাকে। কিন্তু পরিবার হয় না। কবিতার সুরে বলতে চাই-
হে শান্তি, তোমায় খুঁজে মরে ওরা
দেশে দেশে সর্বত্রে
মন্দিরে মাথা ঠুকিয়ে কাতর স্বরে শান্তি মাগে
হে প্রভু, আমায় শান্তি দাও
অথচ তুমি আছ সবার ঘরে ঘরে
বিশ্বশান্তির জন্মদাতা রূপে
তবুও সবাই তোমার পরশ না পায়।
[email protected]
বাংলাদেশ সময়: ২০২২ ঘণ্টা, জুলাই ২৯, ২০১৪