ঢাকা, শুক্রবার, ৫ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

মুক্তমত

ইবোলা প্রচারণার আড়ালে পশ্চিম আফ্রিকার তেল নিয়ন্ত্রণ!

জে সি কলিনস | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬১৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৯, ২০১৪
ইবোলা প্রচারণার আড়ালে পশ্চিম আফ্রিকার তেল নিয়ন্ত্রণ!

এ মুহূর্তে মার্কিন সেনাবাহিনী পশ্চিম আফ্রিকায় কোনো বড়ধরনের পরিকল্পনায় বাগড়া দিতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। এটাকে বলা হয় তাদের গেম প্ল্যান।

অঞ্চলটির লাইবেরিয়া ও গিনির মতো দেশগুলোতে ছড়িয়ে পড়া ইবোলা ভাইরাস নিয়ে বিশ্বব্যাপী যে প্রপাগান্ডা ও প্রচারণা চলছে তারই আড়ালে এই পরিকল্পনাকে লুকায়ে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছে। ইতিমধ্যে আমরা গণমাধ্যমের খবর থেকে জেনেছি, পশ্চিম আফ্রিকায় তিন হাজার সেনা পাঠিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ইবোলা ভাইরাস মোকাবেলায় সহায়তা করতে তাদেরকে পাঠানো হয়েছে বলে দাবি করে যুক্তরাষ্ট্র।  

গত মাসেই পশ্চিম আফ্রিকায় সেনা পাঠানোর খবরটি জানিয়েছে মার্কিন সংবাদপত্রগুলো। নিউইয়র্ক টাইমসের এক খবরে বলা হয়, ‘পশ্চিম আফ্রিকা জুড়ে ছড়িয়ে পড়া ইবোলা মোকাবেলায় আরো জোরদার ভূমিকা পালনে প্রেসিডেন্ট ওবামা সেনাবাহিনী পাঠানোর ঘোষণা দিয়েছেন। একইসঙ্গে তিনি এই ভয়াবহ ভাইরাসের সংক্রমণ ও ছড়িয়ে পড়া প্রতিহত করতে চিকিৎসা সরঞ্জাম ও বিশেষজ্ঞ পাঠানোর কথা বলেছেন।   
  
যে খবরের পরই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পশ্চিম আফ্রিকার ব্যাপারে খুবই কৌতূহলী হয়ে ওঠে তা হল তেল সংক্রান্ত খবর। গত মে মাসে নাইজেরিয়ার বিজনেস ডে নামের একটি পত্রিকা তাদের অনলাইন সংস্করণে পশ্চিম আফ্রিকায় তেলের খনি আবিষ্কার নিয়ে এমনি খবর জানায়। পত্রিকাটির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ওই অঞ্চলে বেশ কয়েকটি নতুন তেলের খনি আবিষ্কার করা হয়েছে। তাতে বিশ্বের প্রায় এক তৃতীয়াংশ তেলের মজুদ আছে বলে পত্রিকাটি দাবি করে। এ খবর প্রকাশ হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্র খুব নড়েচড়ে বসে।  

পত্রিকাটিতে বলা হয়, ‘পশ্চিম আফ্রিকা। যাকে তৃতীয় বিশ্ব মনে করা হয়। অঞ্চলটিতে কয়েকটি নতুন তেলের খনি আবিষ্কার হয়েছে। বিশেষ করে একটি নাইজারের উপকূলীয় এলাকার অববাহীকায় এবং অপরটি গিনির উপসাগরীয় এলাকায়। মার্কিন ভূতত্ত্ব জরিপ সংস্থার মতে, পশ্চিম আফ্রিকার উপকূলীয় এলাকার যেখানে তেল আবিষ্কৃত হয়েছে সেখানে যে পরিমাণ তেল অনুমান করা হয়েছে তা ৩ হাজার ২শ মিলিয়ন ব্যারেল হবে। সাম্প্রতিক কালের সবচেয়ে বড় তেলক্ষেত্র ঘানার জুবিলি ফিল্ডে তুল্লো তেল আবিষ্কারের পর গিনির এই তেলক্ষেত্র সবচেয়ে বড় আবিষ্কার। ২০০৭ সাল থেকে পশ্চিম আফ্রিকায় এই তেল অনুসন্ধান শুরু হয়। নতুন আরো দুটি তেলক্ষেত্র আবিষ্কার হয়েছে। একটি লাইবেরিয়ায়। অন্যটি সিয়েরালিওনে। (আন্তর্জাতিক দৃষ্টি অন্যদিকে সরিয়ে রাখতে ঠিক আজকে গিনি, লাইবেরিয়া ও সিয়েরালিওন এই তিন দেশেই ইবোলা ছড়িয়েছে বলে বিশ্বব্যাপী প্রচারণা চালানো হচ্ছে। )তবে গত এক দশক ধরে মৌরিতানিয়ার তেল আবিষ্কারের বিষয়টি এখনো ভুয়া মনে করা হচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে নাইজার হয়ে উঠল তেল উৎপাদনকারী। আর মালি বাণিজ্যিকভাবে জলভিত্তিক কার্বন আবিষ্কার করতে যাচ্ছে। ’   
 
পত্রিকাটিতে আরো বলা হয়, ‘সিয়েরালিওন, লাইবেরিয়া ও গ্যাবোনের প্রতিবেশি দেশগুলোতে তেল অনুসন্ধান তৎপরতায় ছেদ পড়েছে। তারপরও তারা আশা করে আছে, চুনামাটি ও প্রাক-নোনা মাটির এলাকাগুলোতেই জুবিলির মতো বড় ধরনের তেলক্ষেত্র আবিষ্কার হবে। এদিকে গিনিতে তুল্লো কর্তৃপক্ষ ভূমিকম্পনজনিত জরিপের দায়িত্ব নিয়েছে। তারা মনে করছে, গিনির ওই নতুন আবিষ্কৃত তেলক্ষেত্রে কমপক্ষে ১০ বিলিয়ন ব্যারেল তেলের সম্ভাব্য মজুদ রয়েছে। গিনি, ঘানা, মালি ও লাইবেরিয়ায় মূলত সিমবা নামের একটি কোম্পানি তেল অনুসন্ধান চালিয়ে যাচ্ছে। এদিকে আইভরি কোস্ট গৃহযুদ্ধসহ বেশ কিছু রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের মধ্য দিয়ে গেলেও দেশটিতে রাশিয়ার তেল কোম্পানি লুকওয়েল সম্ভাব্য তেল অনুসন্ধান চালাতে প্রায় ৪শ’ মিলিয়ন ডলারের একটি চুক্তি করতে যাচ্ছে। ’      
     
অতএব আফ্রিকার এ অঞ্চলটিতে তেল আর ইবোলা নিয়ে যে চিত্র দেখা যাচ্ছে তাকে শুধু প্রক্সি ওয়ার বা নকল যুদ্ধ বলা যায়। মানে এতদিন আমরা পূর্ব ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যে এই প্রক্সি ওয়ারের চিত্র দেখেছি। এখন নতুন করে আমরা এই প্রক্সি ওয়ার দেখছি পশ্চিম আফ্রিকায়। তবে আমরা মনে করি পশ্চিম আফ্রিকার বড় বড় এসব তেলক্ষেত্র একই ধরনের প্রক্সি ওয়ারের কৌশল নয়। এখানে অন্যধরনের বিষয় আশয় রয়েছে। কারণ এ বিষয়ে আরো গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার রয়েছে। বিষয়টির গভীরে ঢুকবার জন্য বিজনেস ডেই’র ওই প্রতিবেদনটির নিচের এই অংশটি পড়ে দেখা যাক:      

 ‘এ মুহূর্তে মনোযোগ স্থানান্তর হয়ে গেছে একদম পূর্ব আফ্রিকায়। সাম্প্রতিক তেল আবিষ্কারগুলো হল মোজাম্বিক, কেনিয়া, তানজানিয়া, উগান্ডায়। তবে সর্বশেষ পশ্চিম আফ্রিকার গিনি, লাইবেরিয়া ও সিয়েরালিওনসহ সবমিলিয়ে আবিষ্কারের যে বিশাল চিত্র তৈরি হয়েছে তাই মূলত অঞ্চলটিতে এভাবে বৈশ্বিক মনোযোগের গুরুত্বপূর্ণ স্থানান্তর ঘটিয়েছে। এমনকি এসব আবিষ্কারকে ঘিরেই এখন বড় ধরনের বিনিয়োগের তোড়জোর চলছে। ২০১২ সালের মধ্যেই পূর্ব আফ্রিকায় অর্ধশতাধিক অনুসন্ধান সম্পন্ন করা হয়। ধারণা করা হয়, বিশ্বব্যাপী বিদ্যমান যেসব তেল ও গ্যাস ক্ষেত্র রয়েছে তার অর্ধেকেরও বেশি তেল-গ্যাস রয়েছে এসব আবিষ্কারে। ’     

অঞ্চলটিতে শুধু যে মার্কিন মুলুকের মনোযোগ তৈরি হয়েছে তা নয়, গোটা বিশ্বের প্রধান শক্তিগুলোরই নজর এখন এই পশ্চিম আফ্রিকায়। যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি চীন ও রাশিয়া ব্যাপকভাবে সক্রিয়। পশ্চিম আফ্রিকায় চীন কী করবে ২০১২ সালে দেশটি তার একটি নীতি ও কর্ম-পরিকল্পনা প্রকাশ করেছে। ওই পরিকল্পনামূলক পত্রের শিরোনাম ছিল, ‘পূর্ব আফ্রিকার তেল এবং গ্যাস খাত নিয়ে চীনের অবস্থান: সম্পর্কের এক নতুন মডেল’(China’s role in the East African oil and gas sector: a new model of engagement)। তাহলে আমরা জানছি, পূর্ব আফ্রিকার তেল ও গ্যাসের নিয়ন্ত্রণের জন্য চীন কিভাবে নিজেকে সক্রিয়ভাবে এবং কৌশলগতভাবে তৈরি করে ফেলেছে।   

এই লেখার প্রতি আস্থা ও বিশ্বাসের জন্য আরো গুরুত্বপূর্ণ আফ্রিকান সোর্স যুক্ত করলাম। ‘Exploration in West Africa’s Frontier Could Unlock 9 Billion Barrels in 2014’ (গুগুল লিংক)—এটি মধ্য আফ্রিকার জ্বালানি নিয়ে তাদের ইকো ব্যাংক-প্যান আফ্রিকান ব্যাংক এর একটি ডকুমেন্ট।   
ডকুমেন্টটির নীতিগত এই অংশটি পড়ে নেয়া যাক: ‘গত চার বছরে পশ্চিম আফ্রিকার কয়েকটি দেশের সম্পদ অর্জনে তেল ও গ্যাস বিষয়ক স্বাধীন কোম্পানিগুলো ২০০ মিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল জাম্বিয়া, গিনি, গিনি-বিসাউ, সেনেগাল, সিয়েরালিওন ও লাইবেরিয়া। ’  
অতএব পশ্চিম আফ্রিকার মানচিত্রের সাথে অঞ্চলটির আবিষ্কৃত তেলের মানচিত্রও মিলিয়ে দেখা যায়। এখানে মার্কিন ভূতত্ত্ব জরিপ সংস্থার (ইউএসজিএস)


এবার একইসঙ্গে অঞ্চলটির যে এলাকায় তেল আবিষ্কার হয়েছে ঠিক একই অঞ্চল থেকে যে ইবোলা ছড়িয়ে পড়েছে তার একটি ম্যাপ দেখুন। ম্যাপটিও তুলেছে ঠিক যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বেসরকারী সংস্থা ইউএসইড ও সিডিসি।

ফলে এই দুটি ম্যাপকে তুলনা করে দেখার পর আপনি নির্দ্বিধায় আক্ষরিকভাবেই ভিতর থেকে খুব চাপ নিতে পারেন। মানে এরপর এতে সিদ্ধান্তও নিতে পারেন যে, ইবোলা ঠেকানোর চেয়ে মূলত উপকূলের এসব তেলক্ষেত্র রক্ষা করতেই পশ্চিম আফ্রিকায় ৩ হাজার মার্কিন সেনা পাঠানোর কারণ।

কিন্তু শুধু এই কারণেই মার্কিন সেনা প্রেরণ নয়, বরং এখানে আরো বড় ধরনের পরিকল্পনা ও কৌশল কার‌্যকর করতে বহুমুখি উদ্যোগ ও প্রচেষ্টা কাজ করছে। এই দাবির সম্ভাবনার পক্ষে অনেক বেশি জোরালো ও শক্তিশালী ডকুমেন্ট রয়েছে। যেসব ডকুমেন্ট নিরীক্ষা করে দেখার পর অনায়াসে বোঝা যায়, এই ইবোলা ভাইরাসটিও মূলত মেনুফেকচার বা পরিকল্পনা করে কৃত্রিমভাবে তৈরি করা হয়েছে। এরপর সেটি আন্তর্জাতিক ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে। দয়া করে এই লিংকে ঢুকুন। http://philosophyofmetrics.com/2014/08/02/global-pandemic-and-quarantine/। এখানে ‘Global Pandemic and Quarantin’ শিরোনামের এই প্রতিবেদনটিতে দেখা যাবে, ইবোলা সংক্রামক ভাইরাসের কারণ দেখিয়ে কেমন করে আন্তর্জাতিক পুঁজি বাজার বন্ধ করে দেয়ার অজুহাত তোলা হয় এবং একইসঙ্গে পশ্চিমা ও প্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে বিবাহ আইনকে সংকুচিত করে আনার আওয়াজ তোলা হয়। এটি  অবশ্য আফ্রিকান অঞ্চলের বর্তমান পুরনো ব্যবস্থাকে বহুপক্ষীয় অর্থনৈতিক সিস্টেমে রূপান্তরের সম্ভাবনা তৈরি করবে।

অঞ্চলটিতে এই অর্থনৈতিক রূপান্তর মোটামুটি শুরু হয়েছে ২০০৮ সালে। এখনো সেটি খুবই ধীরগতিতে চলছে। এই অবস্থা ২০১৮ সাল পর‌্যন্ত চলবে ধারণা করা হচ্ছে। ইবোলা মহামারি তারই অংশ। এই ভাইরাস প্রচেষ্টা মূলত অঞ্চলটির চলমান অর্থনৈতিক গতিকে আরো শ্লথ করে দেয়ারই কথিত অর্থনৈতিক পলিসি। একইসঙ্গে এটি পশ্চিম ও পূর্ব আফ্রিকায় নানান ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক পরিবর্তনের ঘটনাও ঘটাবে।    

একদিকে পূর্ব আফ্রিকার ক্ষেত্রগুলোতে চীনের নিয়ন্ত্রণ যাচ্ছে অপরদিকে পশ্চিম আফ্রিকায় যাচ্ছে মার্কিন নিয়ন্ত্রণ। তাহলে এই দুই পক্ষের নিয়ন্ত্রণের মধ্য দিয়ে সেখানে কি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটতে পারে? দুই পক্ষই যুগপৎভাবে মধ্য আফ্রিকায়ও ঢুকে পড়েছে। এই পরিস্থিতিতে এ মুহূর্তে সেখানে প্রক্সি ওয়ার কোন কাঠামোতে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে? তবে এ অবস্থায় লিবিয়ার মতো উত্তর আফ্রিকার দেশগুলো অনেক বেশি কৌশলমুখী হবে। আগে যেমনটি ছিল তার চেয়ে বেশি তার ভাববে।    

সূত্র: ফিলোসফি অব মেট্রিকস

অনুবাদ: শাহাদাৎ তৈয়ব

বাংলাদেশ সময়: ১৬১০ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৯, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।