ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

উদ্যোক্তা হওয়ার পেছনে নানান সংকট ।। জিয়া হাসান

উদ্যে‍াক্তা/মুক্ত্রমত | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭০৬ ঘণ্টা, নভেম্বর ৮, ২০১৪
উদ্যোক্তা হওয়ার পেছনে নানান সংকট ।। জিয়া হাসান ছবি: সংগৃহীত

শেষ পর্ব

আমি যে আলোচনা ৫০ লাখ টাকার উদাহরণ দিয়ে করেছি তা ২ লাখ টাকার প্রজেক্টের জন্যেও হতে পারে। ১০ লাখের জন্যেও হতে পারে।

এই খুদে উদ্যোক্তাদের চ্যালেঞ্জটা আরো অনেক বেশি। কারণ তার ইনফ্রাস্ট্রাকচারের কস্টটা তার অনেক বেশি গায়ে লাগে। ফলে এই সমস্যাগুলো সমাধানে সরকারের দায় আছে।

১।   ইঙ্কিউবিশেন কি সেইটা বোঝা। ইঙ্কিউবেশান নিয়ে আলোচনা অনেক বড়। ইঙ্কিউবেশানের মানে হলো, ডিমে তা দিয়ে বাচ্চা ফোটানো। এইখানে উদ্যোক্তা হইলো, ডিম আর সরকার হইলো, মা মুর্গি। সরকারকে এইখানে, তা দিয়ে ডিম ফোটাতে হয়। এরপরে, ডিম একটা মুর্গি হয়ে পৃথিবীকে উদ্ধার করে। আমাদের দেশের ম্যানুফাকচারিং ইন্ডাস্ট্রিকে গড়ে তুলতে হলে, এইভাবে তা দিয়ে সরকারকে বাচ্চা ফোটাতে হবে।

২। এসএমই সেন্টার করা যেগুলোতে ছোট ছোট রেডি প্লট থাকবে, যেখানে গ্যাস বিদ্যুৎ সব থাকবে। এগুলো নতুন উদ্যোক্তারা অল্প খরচে ভাড়া নিতে পারবে। আমাদের দেশে বিসিক এই কন্সেপ্টে তৈরি হয়েছে। বিসিকে যেসব প্রজেক্ট  ঢাকার বা চট্টগ্রামের পাশে আছে সেগুলো বড় বড় কর্পোরেটরা দখল করে নিছে।   অনেক ক্ষেত্রে, অনেক উদ্যোক্ত সুযোগ নিয়েছেও। ফলে বিসিককে এই ক্রেডিট দিতে হবে। কিন্তু, এভাবে  ঢাকা এবং প্রধান শহরের পাশে সহজলভ্য ভাবে ছোট ছোট প্রজেক্ট করতে হবে, বিসিক মডেলে। সরকার যদি এইগুলো না-ই করে, তো সরকারের এতো কোটি কোটি টাকার প্রজেক্টের কাজটাই বা কি!

৩। বাংলাদেশের বাকির সংস্কৃতি এবং সমস্যা দূর করতে স্মল কোর্ট করা। এইটার একটা আলাদা শাখা থাকবে প্রতিটা জেলা শহরে, প্রতিটা থানায় বা উপজেলায়। যাতে,  বাকি নিয়ে কেউ ফাঁকি দিতে না পারে। বাংলাদেশে অনেক ব্যবসায়ী আছে, এমনকি বড় বড় ব্যবসায়ী আছে—যারা কোটি কোটি টাকা বাকি নিয়ে অনেক উদ্যোক্তাকে পথে বসিয়ে দিয়ে গেছে। আমি শুনেছি,  ঢাকার একটা বড় সুপার মার্কেট অপারেশন বন্ধ করে দেয়ার পরে তার সাপ্লায়ারদের কোনো টাকা ফেরত দেয় নাই। কিন্তু এখনো সেই কোমাপ্নির মালিকেরা কোটি কোটি টাকা দামের গাড়ি হাঁকিয়ে দিন কাটায়, সিঙ্গাপুর যায় ভেকেশনে। কিন্তু সেই সাপ্লায়াররা পরিবারসহ না খেয়ে আছে। এগুলো বন্ধ করতে, কার্যকর লিগাল এবং স্ট্রাকচারাল ফ্রেমওয়ার্ক লাগবে। শুধু কথা বললে হবে না।  

বাংলাদেশের কোর্ট সিস্টেমে যেখানে রায় পেতে ১০ বছর লাগে, সেখানে বাকি ওয়ালারা যায়ও না। কারণ, তাতে ১০ বছরে শুধু জুতার শুকতলি ক্ষয় হবে।

এজন্যে, আলাদা করে স্মল কোর্ট করতে হবে প্রতিটা থানায় আলাদা জুডিশিয়াল অথরিটি, ফাইনান্স এবং একাউন্টিং বোঝা জনবল দিয়ে এবং তাদের শাস্তির অধিকার দিয়ে।

৪। ওয়ান স্টপ শপ করতে হবে, যেখানে একজন উদ্যোক্তা একবার আবেদন করে সব সরকারি লাইসেন্স পেতে পারে।

আমি চীনের গুয়াঞ্জুর কথা শুনেছি, যেখানে একটা ওয়ান স্টপ শপে গিয়ে একজন উদ্যোক্তা এক ঘণ্টার মধ্যে সব লাইন্সেন্স নিয়ে আসতে পারে। চীন পারলে, আমরাও পারবো। চিন্তা করে দেখেন, এইটা জাস্ট ইচ্ছা আর প্রয়োগের ব্যাপার। এটা ইমপ্লিমেন্ট করতে সরকারকে বিশ্বব্যাংক থেকে ১০০০ কোটি টাকার মতো বড় ধরনের ঋণ নিতে হবে না। জাস্ট সদ্দিছা প্রকাশ করতে হবে।

৫। ট্রেনিং। একজন নতুন উদ্যোক্তা কিছু ক্লাসিক ভুল করেন। যেমন একাউন্টিংটাকে ঠিক মতো না সাজানো। যেমন ভুল পার্টনার বেছে নেয়া। যেমন, ফাইনান্সকে গুরুত্ব না দেয়া। প্রডাক্টকে বেশি গুরুত্ব দিতে গিয়ে মার্কেটিংয়ে নজর না দেয়া। নিজে নিজে সব কিছু করার চেষ্টা করা। পিপল ম্যানেজমেন্টে ভুল করা। ইত্যাদি ইত্যাদি। এই ভুলগুলো প্রায় সকল নবীন উদ্যোক্তা করে থাকেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে একজন নবীন উদ্যোক্তার অভিজ্ঞতার অভাবে এই সম্পর্কে সচেতনতা থাকে না। আগের থেকে ট্রেনিং নিলে এই ভুলগুলো থেকে বের হয়ে আসা সম্ভব। কারণ, নিজের ভুল করা থেকে অন্যের ভুল থেকে শেখা ভালো। সরকার উদ্যোক্তাদের জন্যে এই ধরনের ট্রেনিং করাতে পারে।

এই অল্প সাইজের প্রজেক্টেই এক কোটি টাকার উপরে ইনভেস্টমেন্ট করার এই সমস্যা চীনে নাই। ইন্ডিয়াতেও নাই। কারণ যে মেশিনগুলো বাংলাদেশিদেরকে আমদানি করতে হচ্ছে সেগুলো তারা অর্ধেক দামেই পাচ্ছে। ইন্ডিয়াতে কিছু বুরক্রেসি আছে, কিন্তু চীনে সেই বুরক্রেসি আমলাতান্ত্রিক জটিলতা নাই। এবং ইন্ডিয়াতে মোদী সরকার এসে সেই বুরক্রেসিগুলো দূর করবে বলে প্রতিশ্রুতি দেয়াতেই মোদী আজকে ক্ষমতায় আসতে পেরেছে।

ফলে চীন বা ইন্ডিয়াতে একজন উদ্যোক্তা একই প্রডাক্টে তার বাংলাদেশী প্রতিপক্ষ থেকে অর্ধেক দামে প্রোডাক্ট মার্কেটে আনতে পারে। এইটা অনেক বড় পার্থক্য। কারণ একজন উদ্যোক্তা যদি ৫০ লক্ষ টাকা ইনভেস্ট করে, মাসে ৩ লাখ টাকা কামায়, সেটা তার জন্যে বেশ লাভজনক। সেজন্যে সেসব দেশে উদ্যোক্তারা নেমে যাচ্ছে ম্যানুফাকচারিংয়ে। কারণ তার রিস্ক কম। তার বাকি মার যাওয়ার চান্সও নাই। সরকারকে চিন্তা করতে হবে, কি করলে একজন উদ্যোক্তার এই খরচ দেড় কোটি টাকা থেকে ৫০ লাখে নামিয়ে আনা যায়। এভাবে কোয়ান্টিটিভ এনালিসিস করতে হবে।   

৫০ লক্ষ টাকা থেকে এক কোটি টাকার পার্থক্য অনেক বেশি। এটুকু পার্থক্য দূর করতে পারলেই অনেক নতুন উদ্যোক্তা ম্যানুফাকচারিং করতে মাঠে নামতে পারবে, যারা আগে পারত না।

এগুলো করলে বাংলাদেশে নতুন উদ্যোক্তা তৈরি হবে। অনেক নতুন উদ্যোক্তা আছে যাদের মাথায় আইডিয়া আছে। যার ফলে অর্থনীতিতে একটা রিপল ইফেক্ট হবে।

এই উদ্যোক্তাদের হাতে নতুন  চাকরি বা কর্মসংস্থা সৃষ্টি হবে। সেই চাকরির আয়ে বিভিন্ন পরিবার  আরো প্রোডাক্ট কিনবে ফলে আরো নতুন নতুন প্রোডাক্টের চাহিদা বাড়বে। যখন যথেষ্ট চাহিদা হবে, তখন সব প্রোডাক্টের চাহিদা মেটাতে ও দেশীয় প্রোডাকশন করতে আরো নতুন উদ্যোক্তা আসবে। এবং একইসঙ্গে আমদানিও কমে আসবে। এর ফলে আরো একটা জিনিস হবে। মানে যখন অনেক উদ্যোক্তার সক্ষমতা জন্মাবে এবং বাংলাদেশে যেহেতু লেবার প্রাইস কম তাই বাংলাদেশের মানুষের অর্থনৈতিক সক্ষমতার অভাবের কারণে উদ্যোক্তাকে কম খরচে প্রোডাক্ট বানানো শিখতে হবে। এতে করে তখন ধীরে ধীরে কিছু বিদেশি  এসে বলবে, আচ্ছা তুমি যে এতো কমে বানাচ্ছা আমাকেও এইটা আমার দেশের জন্যে বানিয়ে দাও।

বাংলাদেশ তখন শুধু গার্মেন্টস না, আরো অনেক প্রোডাক্ট বিদেশে পাঠাতে পারবে। এইভাবে ধীরে ধীরে বাংলাদেশ চীন বা ইন্ডিয়া হবে। ওরা ঠিক এভাবেই আগাইছে। এটা  এতোই সিম্পল। এটাই রাস্তা।

ফলে আরো একটা কাজ হবে। সেটা হলো বাংলাদেশের এই উদ্যোক্তাদের জন্যে মেশিনারিজ বানাতে গিয়ে আমাদের সেমি ভারি মেশিনারিজ ইন্ডাস্ট্রি ডেভেলপ করতে হবে।

কিন্তু আমরা যতো গান গাই এবং যাই বলি সরকারের যেই উদ্যোগগুলোর কথা বলেছি সেগুলোর উদ্যোগ না নিলে, এই স্বপ্ন দিবা স্বপ্নই রয়ে যাবে।
তাই কাজটা উদ্যোক্তার এগিয়ে আসার বিষয় নয়। উদ্যোক্তারা এগিয়েই আছে। কাজটা সরকারের। সরকারের কাজ হলো উদ্যোক্তাদের বাধা দূর করা। উদ্যোগের পরিবেশ সৃষ্টি করা। এটা সরকার বোঝে কিনা এবং সরকার এটা করবে কিনা, সেটাই বাংলাদেশের উদ্যোক্তাদের চ্যালেঞ্জ।

লেখক: প্রাবন্ধিক

বাংলাদেশ সময়: ১৭০৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ৮, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।